এমপিটি সিম নিয়ে যেভাবে অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৬ মে, ২০২২ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা, আইসসহ নানা ধরনের মাদক। চট্টগ্রাম হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মিয়ানমারের সিম এমপিটি। মাত্র দুই বছরে নতুন যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে অপরাধীদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে মিয়ানমার পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস (এমপিটি)-এর ফ্রিকোয়েন্সি সিম। অপরাধ করে সহজেই পার পেতে অপরাধীরা এখন নিয়মিতই ব্যবহার করছে মিয়ানমারের এই সিম। সমপ্রতি উখিয়া, টেকনাফ ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আইস ও এমপিটি সিমের চালানসহ বেশ কিছু রোহিঙ্গা ধরা পড়েছে। আটককৃতরা জানিয়েছে, রাখাইনে এমপিটি সিমের দাম খুব কম। এছাড়া সীমান্তের দুই পাড়েই এর নেটওয়ার্ক আছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও এই কোম্পানির নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেজন্যই রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সিমের চাহিদা বাড়ছে। এ জন্য তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চোরাইপথে নিয়ে আসছে এমপিটি সিম।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এমপিটি মূলত মিয়ানমারের সিমকার্ড। কঙবাজারের সীমান্ত এবং তার আশপাশ এলাকায় এই এমপিটি সিম খুবই জনপ্রিয়। মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে এটি এখন নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম। এতে করে ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের পরস্পরের মধ্যে হওয়া কথা দেশের মধ্যে অবস্থিত মুঠোফোন সিম কোম্পানিগুলোর শনাক্তের আওতার বাইরে থাকে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে কঙবাজারের টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী এলাকা হয়ে নৌপথে মাদক ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন বার্মিজ পণ্যের চোরাকারবারিরা এমপিটি ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করছে। এই সিম ব্যবহারের কারণে দেশের মধ্যে থাকা বড় কারবারিদের সহজে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। বিদেশের মতো রোমিং পদ্ধতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানেও ব্যবহার করা যাচ্ছে এই এমপিটি সিম। ফলে সহজেই মাদক কারবারিরা বিভিন্ন ভাবে তাদের গ্রাহকদের কাছে ইয়াবা, আইস, এলএসডিসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য পৌঁছে দিচ্ছে।
সূত্র জানায়, মিয়ানমারের মংডু সীমান্তসহ আশেপাশের এলাকাজুড়ে বসানো হয়েছে এমপিটি মোবাইলের ফ্রিকোয়েন্সি টাওয়ার। এ ছাড়া এমপিটি নামের একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানের টাওয়ার বসিয়ে বাংলাদেশে এমপিটি রেজিস্টার্ড সিম পাঠাচ্ছে মিয়ানমার। মাদক এবং চোরাকারবারিরা এ সিমের মাধ্যমে মিয়ানমারে অবস্থিত মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নাফ নদীসহ মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আনা হয় এমপিটির সিম। যারা সিম আনেন তাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী। পকেটে বা ব্যাগে করে খুব সহজেই তারা একসঙ্গে ২০০ থেকে ৩০০ সিম মিয়ানমার থেকে আনেন। সিমের প্যাকেট মিয়ানমারে ফেলে আসেন। বাংলাদেশে আনার পর বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তা বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে পরিচিতি অর্থাৎ রেফারেন্স লাগে। একজন সিম ব্যবসায়ী জানান, প্রতিটি সিম কেনা পড়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। বাংলাদেশে আনার পর তা বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। এমপিটি সিম কেনার পর গ্রাহক *১২৪# (স্টারওয়ানটুফোরহ্যাশ)-এ ডায়াল করে নিজের নম্বর ও ব্যালান্স দেখে নিতে পারেন। সিমগুলো মিয়ানমারের নাগরিকদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমার পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস (এমপিটি) এর সিম ব্যবহারের কারণে মাদক-কারবারিদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও রোমিং সুবিধায় ব্যবহার করা যাচ্ছে এমপিটি সিম।
টেকনাফকেন্দ্রিক মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মো. হোছেন ওরফে খোকন এবং তার সহযোগী মোহাম্মদ রফিক ঢাকায় র‌্যাবের হাতে আটকের পর জানান, মিয়ানমারে তাদের নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। টেকনাফ সীমান্তে নিজেদের নিরাপত্তায় তারা এমপিটি সিম ব্যবহার করে। তারা এ সিমের মাধ্যমে মিয়ানমারে থাকা মাদক-কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
এর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে টেকনাফে হ্নীলা ইউনিয়নে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নুরুল আমিন (৪৩) নামে এক রোহিঙ্গা ডাকাত নিহত হন। ওই ডাকাতের ব্যাগ থেকে র‌্যাব ১১টি এমপিটি সিম উদ্ধার করে। এছাড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের এইচ ব্লকে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে রোহিঙ্গা ডাকাত জিয়াউর রহমানকে। তার কাছেও মেলে এমপিটি সিম। শুধু তাই নয়, কঙবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অর্ধশতাধিক ডাকাতকে গ্রেপ্তারের পর নয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে তারা ডাকাতির আগে যোগাযোগের জন্য এমপিটি সিম ব্যবহারের কথা স্বীকার করেন।
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আইস-কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সীমান্তবর্তী নদী পথ বা মিয়ানমারের সিম এমপিটি ব্যবহার করত মো. হোছেন ওরফে খোকন। গত পাঁচ বছর ধরে খোকন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। ধরা পড়ার কয়েক মাস আগে থেকে সে আইসের চালান আনা শুরু করে। তার সঙ্গে মিয়ানমারের মাদক-কারবারিদের সুসম্পর্ক রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সে এমপিটি সিম ব্যবহার করে। মিয়ানমারে যাতায়াত এবং সেখানকার মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এমপিটি সিম নিরাপদ মনে করে খোকন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামে মাদকবিরোধী অভিযানে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, মিয়ানমারে থাকা মাদক-কারবারিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয় তাদের। এ জন্য তারা এমপিটি সিম ব্যবহার করে।
জানা যায়, এক দেশের নেটওয়ার্ক অন্য দেশে প্রবেশ এবং তা ব্যবহারের কোনো বৈধতা নাই। এটা ক্রস বর্ডার ইস্যু। বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমার কেউ কারও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে না। আইপিও রুলস আছে। তবু অবৈধভাবে এমপিটি সিম ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা নিজেদের আড়াল করতে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় দুর্গম পাহাড় থেকে তিন শ্রমিককে অপহরণ
পরবর্তী নিবন্ধটিসিবি’র ১১০ টাকায় সয়াবিন বিক্রির কার্যক্রম স্থগিত