এমন বিশ্ব গড়ি যেনো অটিজমদের প্রতিভা বিকশিত হয়

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস আগামীকাল

ডা. বাসনা রানী মুহুরী | শুক্রবার , ১ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ০২ এপ্রিল ২০২২ পালিত হচ্ছে ১৫তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। কভিডোত্তর বিশ্বে অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্নদের প্রতিভাবিকাশের মাধ্যমে স্বাবলম্বি করে গড়ে তোলাই হউক অন্যতম লক্ষ্য। অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসওর্ডার মানব প্রজন্মের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা স্নায়ুবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতার প্রতিফলন। তাই জন্ম থেকেই এটা হয় যদিও, অটিজমের লক্ষণগুলো এক থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যেই পুরোপুরি প্রতিভাত হয়, অনেকের ক্ষেত্রে আরো কম বয়সেও পরিলক্ষিত হয়।
অটিজম এ শব্দটি এখন বহুল পরিচিত একটি শব্দ। সিডিসি- আমেরিকার পরিসংখ্যান মতে বর্তমানে প্রতি ৪৪ জনে একজন অটিজন বৈশিষ্ট সম্পন্ন। ছেলেদের মধ্যে প্রতি ২৭ জনে একজন এবং মেয়েদের মধ্যে প্রতি ১১৬ জনে একজন অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন।
আমাদের দেশের সঠিক পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও বিভিন্ন গবেষায় দেখা গেছে এর হার ০.৮% থেকে ৩%। আমাদের দেশে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে কমপক্ষে ১৭ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি ১০ হাজার ছেলেশিশুর মধ্যে ২৪ জন এবং প্রতি ১০ হাজার মেয়ে শিশুর মধ্যে প্রায় ১০ জন অটিজমে আক্রান্ত (সূত্র:দেশরূপান্তর)। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চলমান জরিপ প্রতিবেদনে প্রাপ্ত জরিপ অনুযায়ী নিবন্ধিত অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তির সংখ্যা এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৬ হাজার, যদিওবাস্তবে এসংখ্যা আরও কয়েকগুন বেশী হবে; কারণ অটিজমের হার দেশ, ধর্ম, বর্ণে কোনো ভেদাভেদ নেই পৃথিবীর সবদেশেই প্রায় সমান তা বিভিন্ন গবেষণায় প্রতিভাত।
অটিজমের জন্য কোনো একটি মাত্র কারণ দায়ী এটা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি, তবে এটা জানা গেছে অনেকগুলো কারণ যুক্ত থাকতে পারে- জেনেটিক বা বংশগত, পরিবেশ গত প্রভাব অন্যতম। তাছাড়াও গর্ভকালীন এবং প্রসবকালীন নানা জটিলতা, সময়ের পূর্বে জন্ম গ্রহণ, জন্মের সময় কম ওজন ইত্যাদিও প্রভাব ফেলতে পারে, এসব বিভিন্ন গবেষায় প্রাপ্ত ফলাফল অটিজমের জন্য।
কারণ যা হোক না কেন অটিজম স্নায়ুবিক বিকাশ জনিত সমস্যার বহিপ্রকাশ, এটা সারা জীবনের সমস্যা। যত দ্রুত লক্ষণগুলো দেখে সনাক্ত করা যায় এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায় অটিজম থেকে উত্তরণ তবেই সম্ভব। কারণ অটিজমের থেকে উত্তরনের জন্য তেমন কোনো ঔষধ নেই, প্রয়োজন সমস্যা অনুযায়ী ব্যবহারিক পদ্ধতি প্রয়োগ। অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্নরা প্রত্যকে একে অন্যের থেকে ভিন্ন। সব বৈশিষ্ট বা লক্ষণ সবার মধ্যে সমান না যেমন তেমন মাত্রাও ভিন্ন, কারো কম, কারও বেশী। মূল সমস্যা হলো সামাজিকতায়, মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগে – তাই অন্যের সাথে যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্ক তৈরী করতে পারে না ; তাছাড়াও থাকে কাজে সীমাবদ্ধতা এবং একই কাজ বারবার করার প্রবণতা, পরিবর্তনের বিরোধিতা ইত্যাদি। তাছাড়া সেন্সরি বা ইন্দ্রীয়গত সমস্যার জন্য নানারকম আচরণগত সমস্যা দেখা যায় একেকজনের মধ্যেএক এক রকম। যত সমস্যাই থাকনা কেন, দ্রুত সনাক্ত করে যথোপযোগী ব্যবস্থা নিলে এই শিশুরাও অন্যান্য শিশুদের মত উন্নতি করতে পারে মূল স্রোতধারায় একিভূত হতে পারে।
যে কোনো বয়সে অটিজম নিরুপণে বিশেষ লক্ষণগুলো হলো-
একা থাকতে পছন্দ করে, অন্যের চোখে চোখ রেখে তাকায় না, অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারে না, মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগ করতে পারে না বা দেরিতে কথা বলে বা কথা বলা শুরু করেও কেউ কেউ তা হারিয়ে ফেলে, একই কথা বা শব্দ বার বার বলতে থাকে, একই নিয়মে চলতে পছন্দ করে, চারপাশের কোনো পরিবর্তন পছন্দ করে না বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। একই আচরণ বারবার করতে থাকে যেমন: অস্বাভাবিক হাতনাড়ানো, অকারণে একইভাবে দুলতে বা ঘুরতে থাকে। বিশেষ কোনো শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ, স্বাদ, আলো বা রং এর প্রতি অতিমাত্রায় বা কম মাত্রায় সংবেদনশীলতা দেখায়। কিন্তু অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন শিশু বা ব্যক্তিদের অনেকেরই বিশেষ কোনো না কোন সুপ্ত প্রতিভা বা পারদর্শিতা থাকে, যা সঠিক ব্যবস্থাপনা, সহায়তা কম বয়স থেকেই পেলে বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের মধ্যে।
এজন্য প্রয়োজন অটিজমকে গ্রহণ করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য। চাই সামাজিক সচেতনতা, সহায়তা ।
কাউকে পেছনে ফেলে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের বাইরে রেখে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও সম্ভব নয়। তাই সদাশয় প্রতিবন্ধী বান্ধব সরকার প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে যেমন আইন করেছেন তেমন বিভিন্ন কর্মসূচীও চলমান রেখেছেন।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য নিউরোডেভালোপম্‌ন্টাল ডিসএবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্ট আইন ও বিধিমালা (২০১৩, ২০১৫)। বিশেষ শিক্ষানীতিমালা, চাকরীর ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ, শিক্ষাভাতা, চিকিৎসাভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা, ইন্সুরেন্সসুবিধা সহ নানা সুযোগ সুবিধা, বাবা/ মার অবর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের পেনশন এর অধিকার, সুবর্ণ নাগরিক কার্ড প্রদান ইত্যাদি।
তাছাড়াও প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্তকরণ, এবং সেবা প্রদানের জন্যও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং বাস্তবায়নের পর্যায়ে আছে অনেকগুলো কর্মপরিকল্পনা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসহ অন্যসব প্রয়োজনীয় মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগে।
এসব সুযোগ সুবিধার সঠিক ব্যবহার এবং প্রয়োগের মাধ্যমে অটিজম বৈশিষ্ট সম্পন্নরাও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মত সমাজের মূলস্রোত ধারায় ফিরে আসতে পারে, স্বাবলম্বী হতে পারে, পরিবারের তথা দেশের উন্নয়নে, অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারে। শুধু প্রয়োজন তাদেরকে গ্রহণ করা, সহযোগিতা করা, সকল কুসংস্কারকে বর্জন করে তাদের প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করা, যতই দ্রুত করা যায় প্রাথমিক অবস্থা থেকে ততই উত্তরণ সম্ভব। তারা হবে না পরিবারের তথা সমাজের বোঝা, হয়ে উঠতে পারে একজন সুনাগরিক আপনার আমার মত, সেও অবদান রাখতে পারে অনেক উন্নয়নে। আসুন সবাই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই, বিকশিত করি অটিজম বৈশিষ্ট সম্পন্নদের সুপ্ত প্রতিভা। শিক্ষা ক্ষেত্রে চাই সত্যিকারের সমন্বিত শিক্ষার সুযোগ এবং বাস্তবায়ন। বিশেষায়িত শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন যেখানে সকল বিশেষ চাহিদা সম্পন্নরা শিক্ষার সুযোগ পায়, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও চাই সহায়ক এবং সহযোগী পরিবেশ যেখানে অবহেলা, অবজ্ঞা, অত্যাচার নয়, পায় সহযোগিতা। আইনের আলোকে সকল অধিকার ভোগের জন্য চাই আরও বেশী সচেতনতা এবং সহযোগিতা; তবেই এবারকার বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আশা করি।
লেখক : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও অটিজম সন্তানের মা,
সভাপতি, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধকমার্স কলেজ ছাত্রলীগের শোভাযাত্রা