এবার ৭ কোটি টাকার সিটি স্ক্যান মেশিনও অচল

রতন বড়ুয়া

| সোমবার , ১২ জুন, ২০২৩ at ৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ

এমআরআই, একটি ক্যাথল্যাব (এনজিওগ্রাম), ব্র্যাকিথেরাপি ও মেমোগ্রাফির পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অচল মেশিনের তালিকায় এবার যুক্ত হল একমাত্র সিটি স্ক্যান মেশিনও। গত ৬ জুন যান্ত্রিক ত্রুটিতে মেশিনটি (সিটি স্ক্যান) অকেজো হয়ে পড়ে। এতে করে সরকারি কম খরচের এই সিটি স্ক্যান সেবাও বন্ধ হয়ে গেছে গরীবের হাসপাতাল খ্যাত চমেক হাসপাতালে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গরিবঅসহায় রোগীরা। হাসপাতালের কম খরচের সেবা বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে কয়েকগুণ বেশি ফিতে বেসরকারি ল্যাবডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই সেবা নিতে হচ্ছে তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছেপরীক্ষা ভেদে সিটি স্ক্যান বাবদ চমেক হাসপাতালে ফি ২ হাজার ও ৪ হাজার টাকা। কিন্তু চমেক হাসপাতালের ২ হাজার টাকার এ ফি প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৩ হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। আর হাসপাতালের চার হাজার টাকার এ ফি বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। যান্ত্রিক ত্রুটিতে সিটি স্ক্যান মেশিনের সেবা বন্ধ থাকার তথ্য নিশ্চিত করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, রেডিওলজি বিভাগ থেকে মেশিনটি অচল হয়ে পড়ার তথ্য পেয়েই আমরা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করেছি, চিঠিও দিয়েছি। প্রতিষ্ঠানটির লোকজন এসে মেশিনটি সচলকরণের চেষ্টা করছে। তবে তারা জানিয়েছেমেশিনটির একটি পার্টস নষ্ট হয়ে গেছে। যেটি দেশের বাইরে থেকে আনতে হবে। তবে যাই বলুক, যত দ্রুত সম্ভব এই মেশিন সচল করতে আমরা তাদের বলে দিয়েছি।

প্রসঙ্গত, হাসপাতালের ভারি মেডিকেল যন্ত্রপাতির মধ্যে আগে থেকেই এমআরআই, দুটি ক্যাথল্যাবের (এনজিওগ্রাম) একটি, ব্র্যাকিথেরাপি ও মেমোগ্রাফি মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এর মাঝে রেডিওলজি বিভাগের একমাত্র এমআরআই মেশিনটি গত বছরের (২০২২ সালের) মে মাস থেকে অকেজো। এর দাম প্রায় দশ কোটি টাকা। হৃদরোগ বিভাগে থাকা দুটি এনজিওগ্রাম মেশিনের একটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে (দেড় বছরের বেশি) অকেজো। মেশিনটির দাম ৫ কোটি টাকা। একটি টিউব নষ্ট হওয়ায় মেশিনটি আর কাজ করছেনা। ওই টিউবের দামও কোটি টাকার কম নয়। ওয়ার্ডে থাকা অপর মেশিনটিও প্রায় সময় ডিস্টার্ব দিচ্ছে। যেকোন সময় এই মেশিনটিও অচল হয়ে যেতে পারে বলে ওয়ার্ডের ডাক্তাররা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ক্যান্সার ওয়ার্ডে নারীদের জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত একমাত্র ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি গত বছরের ৬ জুন থেকে অকেজো। মেশিনটির দাম প্রায় ৬ কোটি টাকা। ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই মেশিন চট্টগ্রামের আর কোথাও নেই। এখন জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ব্র্যাকিথেরাপি দিতে হলে ঢাকা যাওয়া ছাড়া নিরুপায়। রেডিওলজি বিভাগে থাকা ম্যামোগ্রাফি মেশিনটিও অকেজো হয়ে আছে বছরের বেশি সময় ধরে। নারীর স্তনে টিউমারক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় অত্যাধুনিক এই যন্ত্র। যান্ত্রিক ক্রুটিতে গত বছরের শুরু থেকে এই সেবাও বন্ধ রয়েছে। মেশিনটির দাম কোটি টাকার কম নয়। সর্বশেষ অচল মেশিনের এ তালিকায় যুক্ত হল রেডিওলজি বিভাগের সিটি স্ক্যান মেশিনও। জাপানি হিটাচি ব্র্যান্ডের (১২৮ স্লাইস) অত্যাধুনিক এ মেশিনের দাম প্রায় ৭ কোটি টাকা বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে, একের পর এক অচল হওয়ার পর ভারি মেডিকেল যন্ত্রপাতির মধ্যে বর্তমানে মাত্র কয়েকটি মেশিনের সেবা চালু আছে গরীব রোগীদের চিকিৎসা সেবায় একমাত্র ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত চমেক হাসপাতালে। এর মধ্যে ক্যান্সার বিভাগের রেডিওথেরাপি মেশিন একটি। বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকটা বিরতিহীন ভাবেই প্রায় দশ কোটি টাকার এ মেশিনের সেবা পাচ্ছে চট্টগ্রামের ক্যান্সার রোগীরা। সেবা চালু থাকা অপর মেশিনের মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ বিভাগের ক্যাথল্যাব (এনজিওগ্রাম)। উল্লেখ্য, দুটি এনজিওগ্রাম মেশিন রয়েছে হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে। এর মাঝে একটি দেড় বছর ধরে অকেজো। সচল থাকা অপর মেশিনে রোগীরা সেবা পেয়ে আসছেন। তবে অতিরিক্ত চাপে যেকোন মুহুর্তে এই এনজিওগ্রামটিও অকোজে হয়ে যেতে পারে বলে ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

দফায় দফায় তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি ডজন খানেক চিঠি চালাচালির পরও এসব ভারি যন্ত্রপাতি সচল করতে পারছেনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবিএসব ভারি মেডিকেল যন্ত্রপাতি সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপো (সিএমএসডি)’র মাধ্যমে ক্রয় করে হাসপাতালে সরবরাহ দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাই এ ধরণের কোন যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়লে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রথমে সিএমএসডি বা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়ে থাকে। পরে সিএমএসডি সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ওই যন্ত্র মেরামতের জন্য তাগিদ দিয়ে থাকে। সাধারণত ওয়্যারেন্টি সময় থাকা পর্যন্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দ্রুত সময়ে মেশিন মেরামতে সচেষ্ট থাকে। তবে ওয়্যারেন্টি সময়সীমা শেষ হয়ে গেলে জটিলতার সৃষ্টি হয়। মেশিন মেরামতে গড়িমসির পাশাপাশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত বিল দাবি করে থাকে। এ নিয়ে দর কষাকষি করেই দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। সর্বশেষ যান্ত্রিক ক্রটি দেখা দেয়া সিটি স্ক্যান মেশিনটির ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়্যারেন্টি সময়সীমা আছে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের সিনিয়র স্টোর অফিসার ডা. হুমায়ুন কবীর। আর খবর দেয়ার পরপরই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে মেশিনটি সারানোর কাজ করছে বলে জানান চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।

হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়২০০৪ সাল থেকে চালু হওয়া আগের সিটি স্ক্যান মেশিনটির সেবা অব্যাহত থাকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। তবে ওই বছরের (২০১৪ সালের) আগষ্ট মাসে পুরণো মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে। ওই সময় থেকে হাসপাতালে সিটি স্ক্যান সেবা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে দেশের ৫টি সরকারি হাসপাতালের জন্য ৫টি সিটি স্ক্যান মেশিন বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দের পর ৫টি সিটি স্ক্যান মেশিন সরবরাহে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড’র সাথে সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপো (সিএমএসডি)’র একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। ৫টির মধ্যে একটি মেশিন বরাদ্দ দেয়া হয় চমেক হাসপাতালে। বাকি চারটি মেশিন বরাদ্দ পায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকার কিডনি হাসপাতাল, ইএনটি হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ২০১৮ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে বরাদ্দ দেয়া মেশিনটি চমেক হাসপাতালে পৌঁছে। হাসপাতালের রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগে মেশিনটি স্থাপনের কাজ শুরু করে সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড। স্থাপনের কাজ শেষে ২০১৯ সালের মার্চে নতুন এই সিটি স্ক্যান মেশিনের সেবা পুরোদমে চালু হয় বলে জানান হাসপাতালের রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের প্রধান ডা. সুভাষ মজুমদার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেতু ভেঙে রড চুরি আ. লীগ নেতা কারাগারে
পরবর্তী নিবন্ধপিকআপচালক সাইফুলের আমৃত্যু কারাদণ্ড