এবার ডেঙ্গুর কবলে চট্টগ্রাম

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

রাজধানী ঢাকার পর এবার ডেঙ্গুর কবলে পড়েছে চট্টগ্রামও। বিশেষ করে গত মাস দেড়েক ধরে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের হার উদ্বেগজনক। শেষ ৩৬ দিনে মহানগরসহ চট্টগ্রামে ২৭২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে যা গত দশ মাসে শনাক্তের সমান। চলতি বছরের দশ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর পর্যন্ত) মোট ২৭৮ জন রোগী শনাক্ত হয়। কিন্তু গত নভেম্বর ও চলতি ডিসেম্বরের ৬ দিনে (মোট ৩৬ দিনে) ২৭২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রামে।
সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত (৬ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫০ জনে। আর আক্রান্তদের মাঝে এ পর্যন্ত মোট ৮ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। শীতকালে এর প্রকোপ কমে। কিন্তু এবার শীতকালে এসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। বিয়ষটি নিয়ে চিন্তিত খোদ স্বাস্থ্য বিভাগও। উদ্বেগের কথা জানিয়ে এরইমাঝে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। গতকাল রাতে তিনি আজাদীকে বলেন, হঠাৎ করে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এটি এলার্মিং বলে আমরাও মনে করছি। বিষয়টি অবগত করে আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি। আর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকেও এ চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন। এদিকে, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ডেঙ্গুর চিকিৎসায় সার্বিকভাবে প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, আক্রান্তদের চিকিৎসার প্রস্তুতি হিসেবে বেশ কয়েক মাস আগেই মেডিসিনের তিনটি ওয়ার্ডে আলাদা ডেঙ্গু কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। সেখানেই আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ২০ জন রোগী এখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আমাদের চিকিৎসক-নার্সরা আগে থেকেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। রোগী বাড়লেও পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের শতভাগ প্রস্তুতি রয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় ও চমেক হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী- গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দশ মাসে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ২৭৮ জন। এর মাঝে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ১৭৯ জন রোগী। আর চমেক হাসপাতালের বাইরে মহানগর ও জেলার অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শনাক্ত হয়েছে ৯৯ জন। সবমিলিয়ে জানুয়ারি-অক্টোবর পর্যন্ত (দশ মাসে) চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা ২৭৮ জন।
কিন্তু সদ্য শেষ হওয়া নভেম্বর ও ডিসেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত (মোট ৩৬ দিনে) ২৭২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মাঝে শুধু চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ১৪০ জন। আর চমেক হাসপাতালের বাইরে মহানগর ও জেলার অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ১৩২ জন। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে চমেক হাসপাতাল বাদ দিয়ে মহানগর ও জেলার সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে থাকে সিভিল সার্জন কার্যালয়। আর চমেক হাসপাতালের তথ্য সরাসরি পাঠানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী- মহানগর ও জেলার সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য হাসপাতালে (চমেক হাসপাতাল ছাড়া) চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত শূন্য, জুলাই মাসে ৭ জন, আগস্ট মাসে ৩৯ জন, সেপ্টেম্বরে ২৬ জন এবং অক্টোবরে ২৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হয়। কিন্তু নভেম্বর এক মাসেই শনাক্ত হয়েছে ১১৪ জন। আর চলতি ডিসেম্বরের প্রথম ৬ দিনে আরো ১৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।
অন্যদিকে, জানুয়ারিতে ৪ জন রোগী শনাক্ত হলেও ফেব্রুয়ারি-জুন পর্যন্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি চমেক হাসপাতালে। তবে জুলাইয়ে ৫ জন, আগস্টে ২৮ জন, সেপ্টেম্বরে ৫৪ জন এবং অক্টোবরে ৮৮ জন রোগী চিকিৎসা নেয়। কিন্তু নভেম্বর এক মাসে এ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১১৭ জন। আর চলতি ডিসেম্বরের প্রথম ৬ দিনে আরো ২৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে চমেক হাসপাতালে। সবমিলিয়ে চমেক হাসপাতালে (৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্তের সংখ্যা ৩১৯ জন। আর একই সময়ে (৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) মহানগর ও জেলার সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য হাসপাতালে শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২৩১ জন।

ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া রোগ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নুরুল হায়দার। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মাঝে এ পর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছেন তিনি। এর বাইরে চমেক হাসপাতালে এ পর্যন্ত ৩ জন রোগীর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। সবমিলিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মাঝে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মোট ৮ জনের মৃত্যুর তথ্য মিলেছে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ থেমে নেই উল্লেখ করে চট্টগ্রামের প্রাক্তন সিভিল সার্জন ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। কিন্তু এবার শীতেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এটি চিন্তার বিষয়। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়েও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে- ২০১৯ সালে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় (চমেক হাসপাতালের তথ্যসহ) ২ হাজার ৫৪৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় অন্তত ৭ জনের। চমেক হাসপাতালের তথ্য ছাড়া ২০২০ সালে ১৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য জানায় সিভিল সার্জন কার্যালয়। সঠিক ভাবে রিপোর্টিং না হওয়ায় গতবছর ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত চিত্র আসেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফের জরিপ চালাতে আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিম : শীতকালেও ডেঙ্গুর প্রকোপের বিষয়টি অস্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। এর কারণ খুঁজে বের করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৬ সদস্যের একটি টিম চট্টগ্রামে আসার কথা রয়েছে। সিভিল সার্জনের চিঠির প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী আজাদীকে বলেন, চিঠির পর বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট লাইন ডাইরেক্টরের সাথে আমার কথা হয়েছে। সার্ভে বা জরিপ চালাতে ঢাকা থেকে ১৬ সদস্যের একটি টিম পাঠানো হবে বলে তিনি আমাকে জানিয়েছেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্পট থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এ টিম আসার কথা রয়েছে বলেও জানান সিভিল সার্জন। উল্লেখ্য, গত বছরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশ কয়টি টিম চট্টগ্রামে মশা জরিপ পরিচালনা করে। বিভিন্ন স্পট থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে তা ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সিভিল সার্জন কার্যালয়, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় ও চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগে খোঁজ নিয়েও ওই জরিপের ফল সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে : রাষ্ট্রপতি
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে মদ তৈরির কারখানা!