এডভোকেট বদিউল আলম : একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | শুক্রবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সদালাপী, মিষ্টিভাষী, নিরহংকারী এডভোকেট আলহাজ্ব বদিউল আলম ছিলেন এ দেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী, স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন এবং স্বাধীনতাত্তোর অনেক উত্থানপতন ও ঘাতপ্রতিঘাতের নীরব সাক্ষী। আইন পেশার পাশাপাশি তিনি এক সময় প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।

তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে অভিজ্ঞতার ভান্ডার এতই সমৃদ্ধ ছিল যা তাঁর সান্নিধ্যে আসা যে কেউই সহজে বুঝতে পারেন। ৮০ এর দশকের শুরু থেকে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আইন পেশার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনি একজন সুলেখকও ছিলেন। তাঁর লিখিত একাধিক বই পাঠক মহলে সাড়া জাগায়।

পারিবারিক জীবনে এডভোকেট বদিউল আলম সাহেব আমার বেশ পুরানো আত্মীয়। তাঁর আপন মামা শ্বশুর আমার আপন ভাগনী জামাতা। সে সুবাধে তিনি আমাকে নানা বলে সম্বোধন করতেন। আমিও তাকে নানা বলে সম্বোধন করতাম। তবে যোগাযোগ ছিল অল্প।

এডভোকেট সাহেবের ছোট ছেলের সঙ্গে আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ের পর থেকে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়। ঘনিষ্টতা লাভের পর তাকে খুব কাছ থেকে বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি মহৎপ্রাণ, নিরহংকারী ও উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন।

এডভোকেট বদিউল আমল সাহেব ফৌজদারী মামলা পরিচালনা করতেন। সাধারণত ফৌজদারী মামলার আইনজীবীরা কথায় একটু পটু বলে প্রবাদ আছে। কিন্তু এডভোকেট বদিউল আলম সাহেবকে দেখতাম তার ব্যতিক্রম। তিনি বেশী কথা বলতেন না। প্রায়ই ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা করে চলতেন। উচ্চ মর্যাদার লোকদের মধ্যে আমাদের দেশে নিরহংকার ও উদার প্রাণ ব্যক্তিত্বের খুবই অভাব।

আইন পেশার পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একাধিক শিক্ষা, সেবা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বহু শিক্ষা, সেবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখেন।

এডভোকেট সাহেব প্রায় বলতেন চট্টগ্রামে আমারই সবচেয়ে বেশী জুনিয়র রয়েছে। জুনিয়র আইনজীবীরা তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। আইন সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে তার কাছে আসলে তিনি সহায়তা করতে বিরক্ত বোধ করতেন না।

ইতিমধ্যে অনেক আইনজীবী তার এই মহৎ গুণসহ তার সম্পর্কে লিখেছেন। তার মধ্যে একাধিক গুণের সমন্বয় ঘটায় তিনি চট্টগ্রাম শহরে ছিলেন সবমহলের সর্বজন শ্রদ্ধেয়। একইভাবে নিজ গ্রামেও। তিনি ছিলেন কর্মবীর ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেও তিনি নিজ পেশা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

আমার মতে তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ট পাওনা হল মহান আল্লাহ পাক তাঁকে মৃত্যু বঞ্চনা না দিয়ে পরিণত বয়সে বিদায় দিয়েছেন। অনেক মানুষকে মৃত্যু বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতে দেখা যায়। কারণ প্রতিটি মানুষ মৃত্যু বঞ্চনাকে ভয় পেয়ে থাকেন।

পৃথিবীতে অকর্মণ্য, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা এবং বিছানায় প্রতিনিয়ত পায়খানা প্রশ্রাব করা এসব কিছু নিয়ে স্ত্রী, পরিবার ও পরিজনের কাছে মুখাপেক্ষী হওয়া কোন অবস্থাতেই মানুষের জন্য শোভনীয় নয় বলে অনেকে আল্লাহর কাছে এ মুক্তির প্রার্থনা করে থাকেন।

তাঁর চির বিদায়ের দিনটিও ছিল পবিত্র দিন অর্থাৎ আরাফাতের দিন। সৌদি আরবের মক্কা মোকাররম এলাকায় ঐ দিন সূর্যাস্ত ছিল বিকাল ৬ টা ২৫৩০ মিনিটের মধ্যে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় রাত ৯ টা ২৫৩০ মিনিট। এডভোকেট সাহেব যখন চির বিদায় নেন সে বছর মহান আল্লাহ পাকের প্রায় ৩০ লক্ষ দাওয়াতী মেহমান তথা সম্মানিত হাজী সাহেবান আরাফাত অক্‌ফ (অবস্থান করা) করার পর বিদায়ের উদ্দেশ্যে প্রতিক্ষায় ছিলেন।

আমি ও আমার ভাই মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী সে সময় আরাফাতে তথা হজ্বে থাকায় এডভোকেট সাহেবের জানাজা ও দাফনে শরীক হতে পারি নাই। পরদিন মিনায় আমরা টেলিফোনে সংবাদ পেয়ে তাঁর জন্য আল্লাহর দরবারে তার খাস এলাকায় বসে দোয়া করি।

দেশে ফিরে তাঁরই স্মরণে আয়োজিত স্মরণ সভায় (শোক সভা) যোগদান করি। চট্টগ্রাম মুসলিম হলে আয়োজিত শোক সভায় প্রধান অতিথি সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীর বক্তব্য শুনে এডভোকেট সাহেবের ব্যাপারেও আরও অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেছিলেন, এডভোকেট বদিউল আলম সাহেব কম কথা বলতেন এবং যা বলতেন তা মেপে বলতেন। তিনি বলেন, বদিউল আলম সাহেব কম কথা বলতেন তা আইনের গভীরে গিয়ে বলতেন।

ফলে জজ সাহেবরা তাঁকে সমীহ করতেন। তিনি চেম্বারে চায়ের আপ্যায়ন করে আইন নিয়ে আলাপ করতেন। আইন বিষয়ের উপর জ্ঞানের গভীরতার কারণে এডভোকেট সাহেবকে বিচারকগণ বিশেষ মূল্যায়ন করতেন বিধায় তার কাছে ব্যাপক সাড়া পড়তো মোয়াক্কেলদের। ফলে তার চেম্বার মোয়াক্কেলদের ভীড় থাকত সব সময়।

দৈনিক পূর্বকোণে তিনি প্রায় কলাম লিখতেন। তার শেষ লেখা ছিল ভারতের কাশ্মির রাজ্যের শ্রীনগর ও চীন ভ্রমণের উপর। তিনি মৃত্যুবরণের কিছুদিন আগে কাশ্মীর ও গণচীন ভ্রমণ করেছিলেন।

এই দুই দেশের উপর লেখা প্রবন্ধ নিয়ে আমার সাথে বেশ কয়েকবার আলাপ আলোচনা করেছিলেন। আমার নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম নিয়ে বিভিন্ন সময় আমার সাথে মত বিনিময় করতেন। মহান আল্লাহ পাক এডভোকেট বদিউল আলম সাহেবকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১