জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী | শুক্রবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

মিরাজুন্নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর এক বিস্ময়কর মু’জিযা

মহাগ্রন্থ আল কুরআনের আলোকে মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম: মিরাজুন্নবীর বিস্ময়কর ঘটনা পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত দ্বারা প্রমানিত। মহীয়ান প্রভূ আল্লাহ জাল্লাশানুহু পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “পবিত্রতা মহান সত্বার যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে রাতের একাংশে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পরিভ্রমণ করালেন, যে মসজিদে আকসার চতুষ্পার্শে আমি বরকত রেখেছি। (এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য হলো) আমি আমার কুদরতের নিদর্শনাদি তাঁকে দেখাবো, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (আল কুরআন, সূরা বনী ইসরাইল: , পারা: ১৭)

হাদীসের আলোকে মিরাজুন্নবী: . মিরাজুন্নবীর বিস্ময়কর ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরনী অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমানিত। যা নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধসূত্রে প্রমাণিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রভূকে দু’বার দেখেছেন একবার কপালের চোখে, আরেকবার অন্তরের চোখে। (মাওয়াহিবে লাদুনিয়া, খন্ড: , পৃ: ৩৭)

. হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা মুসা আলাইহি সালামকে আল্লাহর সাথে কথা বলার সুযোগ দান করেছেন। আর আমাকে তাঁর কুদরতী দর্শন দান করেছেন। মকামে মাহমুদ শাফায়াতে কুবরা ও হাউজে কাউসার দান করে আমাকে মহিমান্বিত করেছেন। (ইমাম দায়লামী, মসনাদুল ফিরদাউস, হাদীস: ৬০০, জামিউল আহাদীস, হাদীস: ৬৬৯২)

মিরাজ নবীজির মু’জিজা মূলত: আল্লাহর কুদরত: প্রচলিত নিয়মের বিপরীত কোনো কর্ম সংগঠিত হলে তা হল আল্লাহর কুদরত।

পিতা মাতা বিহীন হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা, হযরত হাওয়া (🙂 কে “মা” বিহীন সৃষ্টি করা, হযরত ইসা আলাইহিস সালাম কে পিতা বিহীন সৃষ্টি করা সবই আল্লাহর কুদরত। অভ্যাস ও নিয়মের বিপরীত কোন কর্ম আল্লাহর নবী কর্তৃক প্রকাশিত হলে তা হলো মু’জিজা। হযরত মুসা (:)’র লাঠি মোবারক সর্পে পরিণত হওয়া, হযরত ঈসা আ: কর্তৃক মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করা।

জন্মান্ধ ব্যক্তিকে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেয়া, আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা, অস্তমিত সূর্য উদিত করা, পাথর ও কংকর কলেমা পাঠ করা, নবীজির নূরানী আঙ্গুল মোবারক হতে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়া ইত্যাদি ঘটনাবলী নবীদের মু’জিযার অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহর অলীদের পক্ষ থেকে অলৌকিক ভাবে নিয়ম বহির্ভূত সংগঠিত কর্ম ও ঘটনাবলীকে কারামত বলা হয়। যেমন বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (.) কর্তৃক একই সময়ে সত্তর জন মুরীদের ঘরে উপস্থিত হওয়া ও ইফতার করা, হিন্দাল অলী খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতি (.) কর্তৃক আনা সাগরের পানি এক পেয়ালাতে ভর্তি করা ইত্যাদি।

আল্লাহর নিদর্শন হোক নবীদের মু’জিজা হোক কিংবা অলীদের কারামত হোক এ সবই মূলত: আল্লাহর কুদরত তথা সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর কুদরতী শক্তির বহি: প্রকাশ। নবীজির মিরাজ এমন এক উজ্জ্বলতম মু’জিযা ও বিস্ময়কর ঘটনা যা এক শ্রেণির জ্ঞান পাপী অবিশ্বাসীগণ স্বীকার করেনা।

জাগ্রত অবস্থায় নবীজির স্বশরীরে মিরাজকে অস্বীকার করা সুস্পষ্ট গোমরাহী ও ধর্ম বিরোধীতার শামিল। মিরাজের সকালে সংঘটিত ঘটনাবলী শ্রবণের পর জাহান্নামীদের সর্দার আবু জেহেল মিরাজের সত্যতা অস্বীকার করলো ঠাট্টা বিদ্রুপ করলো, জাহান্নামী আবু জেহেল যিন্দিকে পরিণত হলো।

মিরাজের ঘটনাবলী শ্রবণমাত্রই হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু মনে প্রাণে সত্যতা স্বীকার করে নিল, মহান আল্লাহর বিশেষ দয়া অনুগ্রহে তিনি ধন্য হলেন, সিদ্দিক তথা সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত হলেন।

মিরাজ স্বপ্নে নয়, সশরীরে ও জাগ্রতাবস্থায় সংঘটিত হয়েছে: মহান আল্লাহ মিরাজের বর্ণনায় “আসরা বিআবদিহি” বলেছেন, কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত “আসরা” বিআবদিহি” বলেছেন, কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত “আবদ” শব্দটি আরবের পরিভাষায় কেবল আত্মা বা দেহের জন্য ব্যবহার হয় না বরং আত্মা ও দেহ উভয়ের সমষ্টিকে আবদ বলা হয়। আয়াতে “আবদ” শব্দের ব্যবহার স্বশরীরে মিরাজ সংগঠিত হওয়ার উৎকৃষ্ট দলীল।

মিরাজের ঘটনা বর্ণনায় “সুবহানা” শব্দের রহস্য: মিরাজের ঘটনার শুরু করার প্রারম্ভে আল্লাহ তা’আলা সুবহানা শব্দ উল্লেখ করে আল্লাহ স্বীয় সত্বার পবিত্রতা বর্ণনা করেছেন, শব্দটি বিস্ময়কর ও আশ্চর্যজনক বাপারে ব্যবহার হয়। তাফসীর ও হাদীস বিশারদগনের দৃষ্টিতে মিরাজের ঘটনাটি খুবই বিস্ময়কর ও আশ্চর্যজনক যা মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি বিবেকের উর্ধ্বে।

আল্লাহ তা’আলার পবিত্র সত্তা সকল প্রকার অক্ষমতা দূর্বলতা ও অপারগতা থেকে মুক্ত ও পূত:পবিত্র। মিরাজের রজনীতে তাঁর প্রিয় হাবীবকে উর্দ্বজগতের পরিভ্রমণের দাবী তো স্বয়ং আল্লাহর, এ ঘটনা তো তাঁরই ইচ্ছায় হয়েছে, তিনি তো সর্বপ্রকার অক্ষমতা থেকে পবিত্র, সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

সুতরাং নবীজিকে রাতের কিছু অংশে সশরীরে উর্দ্ধজগতে নিয়ে যাওয়া নভোমন্ডলের প্রতিটি স্তরে নিরাপদে গমন করা, প্রথম আসমান থেকে সপ্ত আসমান পর্যন্ত পরিভ্রমন করা, জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করা, সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করা, দীদারে এলাহী অর্জন করা মহান আল্লাহর সাথে সৃষ্টিরাজির প্রতিটি বিষয়ে কথোপকথন করা, মহান আল্লাহর হাদীয়া উপঠোকন সালাতের উপহার নিয়ে অতিদ্রুত ফিরে আসা জ্ঞান বিবেকের মানদন্ডে অসম্ভব ও কঠিন মনে হলেও সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নিকট কঠিন কিছু নয়।

তিনি তাঁর প্রিয় হাবীবকে মিরাজ দান করে তাঁর কুদরতী শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। [শানে হাবীবুর রহমান, পৃ: ১১২, মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৃত: আল্লামা সৈয়দ আহমদ সাঈদ কাযেমী (.)]

স্বশরীরে মিরাজের প্রমান: সাহাবায়ে কেরাম তাবেঈন এজাম ও জমহুর ওলামাদের অভিমত হলো মিরাজের দুলহা মুস্তফা করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজ সশরীরে জাগ্রতাবস্থায় হয়েছে। (রুহুল মায়ানী, খন্ড: , পৃ: , মিরকাত, খন্ড:১১, পৃ: ১৩৮)

মিরাজ রজনীতে দশটি স্তর পরিভ্রমণ: ইমাম ইবনে হাজর মক্কী প্রণীত “ফুতুহাতে আহমদিয়া” কিতাবে মিরাজের রজনীতে উর্দ্ধগমনের বিবরণী এভাবে উল্লেখ হয়েছে, ইসরা রজনীতে উর্দ্ধগমনের স্তর দশটি, তম্মধ্যে সাত আসমান পরিভ্রমন, অষ্টম স্তর সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম, নবম স্তর মুস্তাভি তথা উর্ধ্বজগতের চূড়ান্ত সীমা পর্যন্ত, দশম স্তর হলো আরশ পর্যন্ত। (ফুতুহাতে আহমদিয়া, পৃ: ৩০)

মিরাজ রজনীতে সত্তর হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম: ইমাম ইবনে হাজর মক্কী আরো উল্লেখ করেন, মিরাজ রজনীতে নূর নবীজি সপ্ত আসমান অতিক্রম করার পর সিদরাতুল মুনতাহায় উপবিষ্ট হন, অতঃপর সেখান থেকে মুস্তাভি তথা উর্ধ্বজগতের চূড়ান্ত সীমায় উপনীত হন, অতঃপর নূরের জগতে বিচরণ করেন, অতঃপর সত্তর হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম করেন। প্রত্যেকটি নূরের পর্দা পাঁচশত বৎসরের রাস্তা। অতঃপর নবীজির সম্মানে “রফরফ” নিয়োজিত করা হলো, এতে করে তিনি আরশ পর্যন্ত পৌঁছেন। (ইমাম ইবনে হাজর মক্কী, ফুতুহাতে আহমদিয়া)

মিরাজের সত্যতা বর্ণনায় হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা.)’র জবাব: মিরাজের ঘটনা সকাল বেলা শুনা মাত্রই যখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নবীজির মিরাজের সত্যয়ন করলো তখন কাফিররা আপত্তি করলো এর প্রমান কি? হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) জবাব দিলেন যেভাবে জিবরাইল আলাইহিস সালাম সকাল সন্ধ্যা বারবার আমাদের নবীজির দরবারে রিসালতে সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আগমন করেন আমাদের নূর নবীজিও অনুরূপ ভাবে আসমান তথা উর্ধ্বজগতে গমন করতে সক্ষম। (মুআরেজুন নবুওয়ত, খন্ড: , পৃ: ১০৩)

মিরাজের হিকমত: আমাদের নবীজি ইমামুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পূর্বে যত নবী রসূল পৃথিবীতে তাশরীফ এনেছিলেন সকলের কলেমা ছিল “আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, এই সাক্ষ্য হলো, শূনা সাক্ষ্য।

কোনো নবী আল্লাহকে দেখেননি সাক্ষ্য সমাপ্তি ও পূর্ণতা দেখার মাধ্যমে হয়ে থাকে। সুতরাং এমন শান ও মর্যাদার অধিকারী নবীর সাক্ষ্য প্রয়োজন ছিল, যিনি আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখে সাক্ষ্য দেবেন, যেন তাঁর সাক্ষ্য দেয়ার মধ্যে সাক্ষ্যের পূর্ণতা অর্জন হয়।

কিয়ামত পর্যন্ত যেন দ্বিতীয় কোন নবীর আগমনের প্রয়োজন না পড়ে এ কারনেই আল্লাহ তা’আলা নূর নবীজিকে মিরাজ দানে ধন্য করলেন, যেন নবীজি আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টি ও তাঁর নিদর্শনাদিও দেখেন এবং স্বয়ং আল্লাহকেও স্বচক্ষে দেখেন, এবং দেখেই যেন আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেন। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: , পৃ: ৩৯৭)

হযরত উম্মে হানীর ঘর থেকে মিরাজের সূচনা: হযরত ইবনে হাজর () বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উম্মে হানীর ঘরে বিশ্রাম করছিলেন এখান থেকেই মিরাজের সূচনা হয়েছিল। (সিরতে হালভী, পৃ: ৪০৫, তাফসীরে ইবনে কসীর, খন্ড: , পৃ: ২৫৪)

মিরাজের মাস, তারিখ, বার: হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীর বর্ণনামতে ২৭ রজব মিরাজ সংঘটিত হয়। (মাছাবাতা বিসসুন্নাহ, পৃ: ১৩৯)

নবীজির মিরাজ সোমবার রাতেই সংঘটিত হয়। সোমবার রজনীতে তিনি পৃথিবীতে শুভাগমন করেন, সোমবারেই ওফাত বরণ করেন, সোমবারেই নবুওয়তের ঘোষণা হয়, সোমবারেই মদীনা মনোওয়ারা প্রবেশ করেন। (মিরাতে হালভী, পৃ: ৪০৫)

মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আলোকে মহান রাসূলের অতুলনীয় শ্রেষ্ঠত্ব বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি);

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে নিহত ২১ হাজার ছাড়াল
পরবর্তী নিবন্ধএডভোকেট বদিউল আলম : একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব