একুশের বইমেলা ঢাকার অনুকরণ করে কার লাভ

আহমেদ মুনির | শুক্রবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

নব্বইয়ের দশকে অনেকটা অনানুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম হল চত্বরে একুশে বইমেলা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামে। ছোট পরিসরে ছোট মেলা হলেও এর প্রভাব মোটেও কম ছিল না। গণগ্রন্থাগারের সামনে কবি লেখকদের জমজমাট আড্ডায় মুখর থাকত মেলার প্রাঙ্গণ।

 

কবিতা, উপন্যাস আর ছোটগল্পের নতুন ধরনের দিশা পেতে তরুণেরা উন্মুখ ছিল। চট্টগ্রামের সাহিত্য অঙ্গনের প্রতিষ্ঠিতরা তখন তরুণদের এই আদেখলাপনা নিয়ে প্রায়ই বক্রোক্তি করতেন। একজন জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিককে একবার বলতে শুনেছি, এখনকার তরুণেরা তো মায়ের পেটেই কমলকুমার পড়ে আসে। এসব সত্ত্বেও সাহিত্যের সামগ্রিক পরিবেশ ছিল স্বাস্থ্যকর। সাহিত্য মূলত ছোট পত্রিকা ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছিল।

শামসুর রাহমান, হাসান আজিজুল হক কিংবা আল মাহমুদেরাও তখনো লিটল ম্যাগাজিনেই লিখতেন। চট্টগ্রাম বা রাজশাহীর কেউ নিজেদের কেন্দ্র বিচ্যুত ভাবতেন না।

যে সময়ের কথা বলছি চট্টগ্রামের সাহিত্যে তখন লিরিক, মধ্যাহ্ন, কথা, পুষ্পকরথ, নির্মাণ, নাব্যিক, ফলক, খড়িমাটি, ঘুড়ি, চর্যাপদের মতো পত্রিকা বের হচ্ছিল। সেখানে চট্টগ্রামের সাহিত্যের জমিন তার সত্যিকারের মাটি পাচ্ছিল ধীরে ধীরে। আর সেকারণে স্বতঃস্ফূর্ত বইমেলাকে এসব পত্রিকার কবি, লেখকেরা অনেকটাই রাঙিয়ে তুলেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে হে ফেস্টিভ্যাল বা ঢাকা লিট ফেস্টে লেখকআড্ডা আর পাঠকলেখক বিনিময়ের যে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো, সেটাই এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশে বই মেলায়ও আমরা এমন আনুষ্ঠানিক আলাপচারিতা দেখছি এখন। তবে পাঠক লেখকের এমন বিনময় অনানুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম বই মেলায় নব্বইয়ের দশকেই শুরু হয়েছিল।

তাই বলা যায়, ‘চিটাগাং টু দা ফোর’ এই উক্তির সার্থকতা ছিল এক সময়। গত কয়েক বছরে বই মেলার এমন আনুষ্ঠানিকতা নষ্ট হয়েছে। পরিসর বড় করার স্বার্থেই চট্টগ্রামের প্রকাশকদের তা করতে হয়েছে। সিটি করপোরেশনের আয়োজনে হলেও এই মেলা সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নিয়ন্ত্রণেই চলছে। ফলে আমলাদের পরামর্শ, তাদের বেঁধে দেওয়া ছকেই যে মেলা হবে তাতে সন্দেহ কী!

বছর মেলায় শতাধিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। ঢাকার মতো এখানেও বিদেশি বই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ঢাকার মেলায় ‘আদর্শ’ কাণ্ডের পর এখানেও প্রকাশকেরা আদর্শকে নিষিদ্ধ করেছেন। ব্যাপারখানা এই, ঢাকায় নিষেধ তো এখানেও নিষেধ।

অথবা ঢাকার বাংলা একাডেমি যেখানে নিষেধ করেছে, সেখানে আমরা কোন হনু। ফলত এই বই মেলাকে ঢাকার বাংলা একাডেমির বই মেলার শাখা বই মেলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাচ্ছে না।

ঢাকায় বৃষ্টি পড়লে চট্টগ্রামে ছাতা ধরতে হবে, এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে না এলে চট্টগ্রামের বই মেলার স্বতন্ত্র চেহারা দাঁড়াবে না। এই বই মেলাকে ঘিরে সহজেই অনেক পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারত। চট্টগ্রামের কবিতা, লোকগান, উপন্যাস, নাটক ছোটগল্প নিয়ে বিশেষ থিমভিত্তিক আয়োজন হতে পারত।

চট্টগ্রামের একেকজন সাহিত্যিককে নিয়ে একটা করে বিশেষ দিনও ঘোষণা করা যেত। এর বাইরেও দেশের সাহিত্যের যে বিস্তৃত জমিন পড়ে আছে, সেখানেও নজর দেওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে থিম ধরে প্রতি বছর সেই অঞ্চলের কবিসাহিত্যিকদের চট্টগ্রামে আমন্ত্রণ জানালে এখানকার পাঠকদেরও যেমন লাভ হতো , তেমনি এই বই মেলাও একটি ভিন্ন চেহারা পেত।

বই মেলা উপলক্ষে চট্টগ্রামে দেশের নানা জায়গা থেকে পাঠকেরা ভিড় করবেন এই স্বপ্ন দেখতে দোষ কী?

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন
পরবর্তী নিবন্ধপুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যু