একটি গল্প ‘তৃষ্ণা’

উপল বড়ুয়া | শুক্রবার , ১৯ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ‘আগুনপাখি’ সৃষ্টির আগেই বাংলাসাহিত্যে স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছিলেন। ছোটগল্পে উনার হাত যে সিদ্ধহস্ত তা তো সর্বজনবিদিত। সাধারণ কোনো বিষয়তেও ভাষার উৎকর্ষে প্রাণ স্থাপন করতে পারতেন। কেবল গল্প বলার দিকে ঝোঁক ছিল না হাসান আজিজুল হকের। অনবদ্য ডিটেইলিংয়ের কারণেই তাঁর গল্পে বারবার ফিরে আসা যায়। বিষয়বস্তু যা হোক; চরিত্র সৃষ্টি ও গল্পের প্রয়োজনে তাদের মুখে আহার্য্যের মতো তুলে দিতে পারতেন ভাষাকে। অর্থাৎ, রাখালের মুখে একেবারে ‘রাখালিয়া ভাষা’।
কেবল এই কারণে হাসান আজিজুল হক যে অনবদ্য কথাকার বা বাংলা কথাসাহিত্যের ‘রাজপুত্র’ তা বলার মতো সাহস আমার নেই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, মাহমুদুল হকও তো আছেন মহীরূপ হয়ে। তাহলে কোথায় হাসান আজিজুল হক স্বতন্ত্র? সাহিত্যিকরা বাইরের দুই চোখ ছাড়াও অন্তরে আরেকটি চোখ নিয়ে ঘুরে-ফিরেন। কখনও সেই চোখ দিয়ে এত গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, সমুদ্রের তলদেশও তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হাসান আজিজুল হক দর্শনের ‘ছাত্র-শিক্ষক’ বলেই কিনা, তার কথাসাহিত্যে পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষের আচরণ, অন্তর্গত বিষয়াদির এক হদিশও থাকে। অর্থাৎ, চরিত্রের অস্থিমজ্জার রসও টের পাওয়া যায়।
কেবল বাংলাদেশের সাহিত্য নয়, সমগ্র বাংলাসাহিত্যে উল্লেখ করার মতো যে ছোটগল্প রয়েছে তার কয়েকটি বেরিয়েছে হাসান আজিজুল হকের কলম দিয়ে। জীবন ঘষে আগুন, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, নামহীন-গোত্রহীন, রাঢ়বঙ্গের গল্প্ত বাংলা ছোটগল্পসাহিত্যে এসব অমূল্য সম্পদ। আর কখনো যদি বলা হয়, বাংলাসাহিত্যের সেরা একশটি ছোটগল্পের তালিকা করতে। সেখানে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘তারামনবিবির মরদপোলা’, হুমায়ুন আহমেদের ‘চোখ’ রাখার পাশাপাশি নিশ্চিত রাখব হাসান আজিজুল হকের ‘তৃষ্ণা’ গল্পটি। ‘শকুন’ও রাখা যেতে পারে।
এই নয় যে, ‘তৃষ্ণা’র চেয়ে তাঁর ভালো গল্প নেই। অবশ্যই অনেক আছে। দেশত্যাগ, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক্ত অনেক উল্লেখযোগ্য গল্প রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত পছন্দের কথা বাদ দিলেও হাসান আজিজুল হকের ‘তৃষ্ণা’ গল্পটির বয়ান ও চরিত্র একেবারে ভিন্ন। এই গল্পে উনার স্বতস্ত্র স্বরে বলা সেই সমস্ত বিষয়- যেমন ভিটেমাটি ছেড়ে দেশত্যাগের হাহাকার নেই, যুদ্ধ-পরাধীনতার কষ্ট নেই। কেবল রয়েছে খেয়েদেয়ে এক ঢ্যাঙ্গা যুবকের আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে।

হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’ গল্পটি আমাকে মনে করিয়ে দেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘থুত্থুরে এক ডানাঅলা বুড়ো’ গল্পটির কথা। যে হঠাৎ আকাশ থেকে মাটিতে এসে পড়ে। লোকে তাকে দেখতে আসে। শুশ্রুষা পেয়ে একদিন তার ডানায় নতুন পালক গজায়। তারপর সে ফের আকাশদেশে ফেরার প্রস্তুতিও সারে। ‘শকুন’ গল্পে শকুনও হঠাৎ আকাশ থেকে ভূ-পতিত হয়। কিন্তু সে আর ফেরত যেতে পারে না। দুই গল্পের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। তারপরও এই গল্পের অবতারণা, গার্সিয়া মার্কেসের কারণে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ পাঠের পর এত ভালো লেগেছিল এক রাশিয়ান মহিলার, কোনো আলোচনা নয়, উনি হুবহু প্রতিটি শব্দ লিখে ফেলেছিলেন উপন্যাসটির। ‘তৃষ্ণা’ গল্পটির আলোচনা লিখতে বসে মনে হলো, ওই রাশান মহিলার মতো করা গেলে ভালো হতো।
তৃষ্ণা্ত আদতে বাশেদের (বাচেদ) গল্প। নীরস কঞ্চির মতো আঙুলগুলো দিয়ে যে দ্রুতবেগে ধানের শীষ কুড়ায়। মায়ের কথা অমান্য করে লম্বা হাত দুটো দিয়ে সাঁড়াশির মতো পুকুরে বোয়ালমাছের টুঁটি চেপে ধরে। ভয় পায় না কিছুতেই। দিনদিন সে লম্বা হতে থাকে। কৈশোরের আদুরে মুখ ও ফরশা দেহখানা ধীরে পাল্টে যায় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। রোদে পুড়ে বুকটা কালো হয়ে উঠে। তালগাছের মতো বেঢপ লম্বা হওয়ার পাশাপাশি মুখখানাও শ্রী হারায় বাশেদের। সেই সঙ্গে বুঝতে পারে, এই জগৎ সংসারে সে একা। মা ছাড়া তার কেউ নেই। লোকে তাকে দেখে ভয় পায়। ধান চুরি করতে গিয়ে সে মার খায়। গোলমেলে জন্ম পরিচয় নিয়ে সে বাপের অভিশাপ কুড়ায় আর এই জীবন ধারণের লজ্জার ভেতরেও স্বপ্ন দেখে খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকার। কিন্তু মৃত্যু তার হাঁটুর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে। তারপর বাশেদ শেষ খাবারটা খেতে বসে। যেন তার মৃত্যুর খাবারটায় উৎসবের মতো আগে আগে সেরে নেয় গ্রামবাসী। মৃত্যুর আগে আগে তার জেগে উঠে আদিম যৌন ইচ্ছে। সেই ইচ্ছের অধিকার যেন আগে থেকে সে হারিয়ে বসেছে।
আপাতদৃৃষ্টিতে অরাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত গুরুত্বহীন এক গল্পকে নিয়ে কেন আমার এত পক্ষপাতিত্ব্ত সেই প্রশ্ন আসতেই পারে। তা অমূলকও নয়। এই গল্প আলোচ্য হওয়ার মূল কারণ এটাই যে, এর স্বতঃস্ফূর্ততা ও বিষয়বস্তু। এক ঢ্যাঙ্গা যুবকের মৃত্যুও পাঠককে বিষণ্ন করে দেয়।
বাশেদ মৃত্যুকে ভয় পায়। কারণ তার লম্বাত্ব। সে যে নামাজ শিখতে পারেনি তার জন্য যতটুকু ভয়, তারচেয়ে বেশি মৃত্যুর পর তাকে যখন কবরে শোয়ানো হবে তখন ফেরেশতা যদি আসে তখন সে কীভাবে উঠে নামাজ পড়বে! মৃত্যু যতোই সন্নিকটে আসে এমন অনেক আশ্চর্য ও আধ্যাত্মিক চেতনায় ডুবে যায় সে। কিন্তু তার পেট, সে তো সবসময় ক্ষুধার কথা বলে।
অথচ, সাত ফুট শরীরে পেটটি নিয়ে সে বিষম আশ্চর্য এক প্রাণী গ্রামের। সবার ভয় ও অবজ্ঞামিশ্রিত চাহনি নিয়ে বেঁচে থাকা যুবক বাশেদ। ধান চুরি করতে গিয়ে একদিন সে সামাদ মণ্ডলের হাতে মরতে বসেছিল। অনেক কাকুতি-মিনতি করে ছাড়া পায়। এ-সময় সামাদ মণ্ডল রেগে বলে, ‘শালা হারামখোর। শালা তু এক বাঁচতে চাস? শুয়োরের বাচ্চা শুয়োর! শালা এতর!’
এই বক্তব্য যদি বাশেদ করতো সামাদ মণ্ডলকে তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকতো না। বেঁচে থাকার যে অধিকারটুকু নিয়ে বাশেদকে এমন কথা বলে সামাদ মণ্ডল তেমনি বাশেদ পুরো জগত সংসাররের সামনে একই প্রশ্ন রাখতে পারত। কিন্তু আমাদের সমাজ এমন, যে ভিক্টিম তার প্রশ্ন এত গভীরে চাপা পড়ে যায় তা আর আমাদের কানে এসে পৌঁছায় না। বাশেদ আমাদের সমাজে বেমানান, কারণ সে আশ্চর্য। কারণ সে সাধারণের মতো দেখতে নয়। কেননা সে এক কেজি ভাত খায় প্রতিবেলায়। মুখরোচক খবর হওয়ার জন্যই যেন এই দুনিয়ায় এমন এক ঢ্যাঙ্গার সাময়িক উপস্থিতি। অর্থাৎ, এই সমাজব্যবস্থা এত বেশি পারফেকশন ও পারফেকশনিস্ট খুঁজে সেখানে অটিজম, বাশেদকে বেমানান লাগবেই।
‘তৃষ্ণা’ একেবারে চরিত্র নির্ভর নিতান্ত সাধারণ এক গল্প। তার শেষটাও একেবারে সাধারণ। আমরা যারা মনে করি, ছোটগল্প মানে কেবল ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’ এই গল্প তেমন নয়। এই গল্পের শেষ আছে। ওরসে ছাগলের মাংস দিয়ে গলা পর্যন্ত খাওয়ার পর বাশেদ আর উঠতে পারে না। সকালে ঠিক ঢালুটার নীচে জমির কিনারায় উলঙ্গ ও বিবর্ণ মৃতদেহ পাওয়া যায় তার। ঢ্যাঙ্গা যুবকের এমন করুণ মৃত্যু তেমন উল্লেখযোগ্যও নয়। তবে কিছু সাধারণ মৃত্যুও কখনো কখনো উত্তরহীন প্রশ্ন রেখে যায়। তাহলে বাশেদের মায়ের কথাই সত্যি হলো। যে যৌনইচ্ছের ভেতর দিয়ে বাশেদের জন্ম সেই অপূর্ণ যৌনইচ্ছের ভেতর দিয়েই বাশেদের মৃত্যু। আমাদের প্রতি গ্রামে একজন করে যে বাশেদ আছে, তারা কীভাবে বেঁচে থাকে?
দুঃখের বিষয়, এসব বিচার-বিশ্লেষণ হাসান আজিজুল হকের ৮২ বছরের আয়ুরেখা পার করার পর লিখতে হচ্ছে। আমাদের সাহিত্যে তাই নিয়ম। তাতে অবশ্য আমি দোষ দেখি না। আগুনপাখির লেখক দেহখাঁচা ছেড়ে গেলেও রূপকথার পাখি ফিনিঙের মতো বারবার উনার সাহিত্য দিয়ে পাঠকদের কাছে বেঁচে থাকবেন। বেঁচে থাকবে এক অসহ্য তৃষ্ণা নিয়ে মারা যাওয়া বাশেদও।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতোমাকে
পরবর্তী নিবন্ধনিত্যপণ্যের বাজার ও গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে কঠোর তদারকি দরকার