একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু আর তার চুলচেরা বিশ্লেষণ

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শনিবার , ২ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

রাফসান ইরফান- টগবগে এক তরুণ যুবক, মেধাবীও বটে। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল-রাফসান একদিন বড় হয়ে মা-বাবার জমে থাকা স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু মহান আরশের মালিক চান অন্যটা আর সেই মালিকের কাছেই ফিরে গেল রাফসান হয়তো বা কপর্দকশূন্য হয়ে। বন্ধুসহ কক্সবাজার গিয়েছিল বেড়াতে। সাথে ছিল সেই রাজনৈতিক ছোট ভাই চিশতি পিয়াম। কক্সবাজার পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই রাফসানের মৃত্যু হয়। শরীরে ছিল না কোনো আঘাতের চিহ্ন। তারা বে ওয়ান্ডারস নামক একটি হোটেলে উঠেছিল। রাফসান কোতোয়ালী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রত্যাশী ছিলেন বলে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা। কিন্তু সে আশা নিঃশেষ হয়ে গেল রাফসানের। যদিও ময়না তদন্ত রিপোর্ট এখনো হাতে আসেনি, তবুও পুলিশের প্রাথমিক ধারণাকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যে ছেলের স্বপ্ন থাকার কথা ছিল দেশের একজন উচ্চ শিক্ষিত নাগরিক হওয়া। হয়তো সেই নাগরিক প্রশাসনিক কোন শীর্ষ কর্মকর্তা হতে পারে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হতে পারে, খ্যাতনামা চিকিৎসক-প্রকৌশলী-স্থপতি হতে পারে। কিন্তু রাফসানের হাতে জাগতিক বইয়ের পরিবর্তে মদ কেন? রাফসানের পিতা-মাতা তাহলে কি মদ পান করতে শিখিয়েছে? নৈতিকতাবোধসম্পন্ন কোন পিতামাতা তাকে কোনদিন মদ পান করতে শিখাতে পারেন না। কিন্তু বর্তমান ছাত্র যুব সমাজের নৈতিক চরিত্রের মানদণ্ড এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, হেন কোন কাজ নেই তারা করতে পারে না। এক্ষেত্রে আমি বলবো, সংশ্লিষ্ট অভিভাবকরাই বহুলাংশে দায়ী। শিশু-কিশোর বয়স থেকে যদি সন্তানদের নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হত, যদি আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান নামাজ পড়ার ব্যাপারে তাগাদা দেওয়া হতো, পৃথিবীর একমাত্র সত্য দ্বীন ইসলাম এর শিক্ষা যদি সঠিক সময়ে দেওয়া হত-তাহলে রাফসানদের হাতে মদের পরিবর্তে থাকতো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত আসমানের নিচে এবং জমিনের উপর একমাত্র সত্য কিতাব আল-কুরআন। আর এই কুরআনই পরকালের কঠিন দিনে নাযাতের উছিলা হবে। রাফসানের স্বপ্ন ছিল সে বড় রাজনৈতিক নেতা হবে। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল না ইসলামের একজন বড় দাঈ হওয়ার। কারণ ইসলামের দাঈ হওয়ার পিছনে পিতা-মাতার ভূমিকা থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেই পিতামাতাই যদি কুরআন এর শিক্ষার ব্যাপারে সন্তানদের উৎসাহ না দেয় তাহলে সেই সন্তান তো বিপথগামী হতে বাধ্য। রাজনৈতিক নেতা হলে হয়তো দুনিয়ার জীবনে বাহবা পাওয়া যাবে, অনেক বন্ধু-বান্ধবের সমাবেশ ঘটবে, এমনকি জনপ্রতিনিধি হওয়ার পথকে সুগম করে দিবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে, পরকালীন জীবনে এসব রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের এক কানাকড়িরও কোন মূল্য নেই সেই প্রজ্ঞাময় মহাশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার কাছে। যদি আজ আল্‌-কুরআনের একটি আয়াত পড়ে রাফসানের জীবনটা পাল্টে যেত, তাহলে কবর জীবনের হিসাব-নিকেশ অনেক সহজ হয়ে যেত। রাফসানের শেষ-টা ছিল অত্যন্ত করুণ, হৃদয়গ্রাহী। স্বাভাবিক কোন মৃত্যু ঘটেনি। অস্বাভাবিক মৃত্যুর এই ঘৃণ্যতম বোঝা বয়ে যেতে হবে সারা জিন্দেগীভর তার পিতা-মাতাদের। কঠিন সত্য মৃত্যুকে অবজ্ঞা করার কোন অবকাশ নেই। এই মৃত্যুকে প্রত্যেক মানবজাতিকে আলিঙ্গন করতে হবে। কিন্তু হায় মৃৃত্যুর আগে পরকালীন বিনিয়োগের কোন চেষ্টাই করি না-যেমনটি রাফসান করেনি, পিয়ামও করেনি। সেই বিনিয়োগ করার পথটা বাতলে দেননি তার স্নেহধন্য পিতামাতারা। আজ বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে কুরআন চর্চার ঘাটতি রয়েছে। নামাজের তাগিদ দেওয়ার ঘাটতি রয়েছে। সৎ ও পরিপূর্ণ নিষ্ঠাবান মানুষ হওয়ার ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু ঘাটতি নেই উচ্ছৃংখল জীবনকে বেছে নেওয়ার সুযোগের। এই তরুণ-যুবক যে ভয়ানক পথে পা বাড়াচ্ছে, তাদের মস্তিষ্ক যেভাবে ধোলাই করা হচ্ছে, বাড়ি দখল, ছিনতাই-খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং রপ্ত করার কৌশল শেখানো হচ্ছে- তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে এক মহাবিপর্যয় হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এ জনপদের মাটিতে। কিন্তু আফসোস, এই নির্মম সত্য কথাগুলো বলার কোন প্ল্যাটফর্ম নেই আজ।
নিদেনপক্ষে পিতা মাতারা যদি সৎ ও কুরআনপ্রেমি হয়, সর্বোপরি আল্লাহভীরু হয়- তবেই তো সন্তানেরা সেই সত্য পথের দিকে পা মাড়াতে বাধ্য। আপনাকে অনুসরণ করবে আপনার ছেলে-মেয়ে, আপনি কুরআন বিরোধী এবং রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থাকলে আপনার সন্তানেরও শেষ ঠিকানা হবে রাফসানের মতন, পিয়ামের মতন। আজ দেশের সমস্ত পিতা-মাতাকে কঠিন শিক্ষা নিতে হবে রাফসানের এই অস্বাভাবিক মৃত্যু থেকে। নিজের সন্তানদের জাহান্নামের কঠোর আযাবের দিকে ধাবিত করবেন না দয়া করে। শেষমেশ সেই ঐতিহাসিক আল্লাহর কালাম দিয়েই শেষ করি, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা নিজেদের ও নিজেদের পরিবার পরিজনদের (জাহান্নামের সেই কঠিন) আগুন থেকে বাঁচাও, তার জ্বালানি হবে মানুষ আর পাথর, (সে) জাহান্নামের (প্রহরা যাদের) ওপর (অর্পিত), সেসব ফেরেশতারা হচ্ছে নির্মম ও কঠোর, তারা আল্লাহর কোনো আদেশই অমান্য করবে না, তারা তাই করবে যা তাদের করার জন্যে আদেশ করা হবে’- আত্‌-তাহ্‌রীম- ৬।

লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসা কখনো প্রাক্তন হয় না
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে