একজন লুদু চোরের জীবনকাহিনী

‘কারাগারের রোজনামচা’ হতে

সালমা বিনতে শফিক | সোমবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

লুদু ওরফে লুৎফুর রহমানের পরিচয় তিনি একজন চোর। তবে জন্মেইতো চোর হননি। তার চোর হয়ে ওঠার পেছনের প্রেক্ষাপট বড়ই শ্বাসরুদ্ধকর। সকল চোরের জীবনে চোর হয়ে ওঠার গল্পই হয়তো একইরকম, কিংবা কিঞ্চিৎ এদিক-ওদিক। তবে সমাজের নামিদামী মানুষদের বিশেষ করে অপরাধ দমন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আইনের পোশাক পরা অনেকেই চোরদের স্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং তাদের ব্যবহার করেন। কোথাও ঠেকে গেলে সরব হয় হাতের লাঠি, কথা কয়ে ওঠে আইনের সাজ। আমৃত্যু কারাগারে পচে মরে লুদুরা। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলে!
লুদু’র জীবনকাহিনী শুনে মনে হতে পারে একালের কথা। প্রকৃতপক্ষে লুদু ওরফে লুৎফুর রহমান চোরের গল্পটা জানতে হলে উল্টে দেখতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’। কারাগারের বদ্ধ কুঠুরিতে বসে সহধর্মিণীর পাঠানো রুলটানা খাতায় দিনপঞ্জি লিখে চলেন বঙ্গবন্ধু। তবে নিজের কথা নয়, কয়েদিদের গুনতির দিনের শুরু থেকে মধ্যরাত অবধি কারাগারের ভেতর ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেন তিনি পরম মমতায়। ‘থালা বাটি কম্বল জেলখানার সম্বল’ নাম দিয়ে পুরো প্রথম অধ্যায় জুড়ে সাধারণ কয়েদিদের দুর্ভোগের বৃত্তান্ত পাঠক মাত্রকেই আবেগতাড়িত করবে। ‘জেল দিয়ে লোকের চরিত্র ভাল হয়েছে বলে আমি জানিনা’- জীবনের দীর্ঘসময় কারাগারে কাটানো বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি হয়েছিল গেল শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই যখন তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন লুদুসহ আরও অনেক অপরাধীকে, যাদের কেউই অপরাধী হয়ে জন্ম নেয়নি। ৪৭ থেকে ৫৪ – আট পৃষ্ঠা জুড়ে একজন লুদু চোরের কাহিনী, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আইনের নামে কতনা বে-আইনি কর্ম চলছে আমাদের সমাজে!
লুদু’র জন্ম নিম্নবিত্ত পরিবারে হলেও খাওয়া পরার তেমন ভাবনা হতনা, যদিনা তার বাবা সাত সাতটিবার বিয়ে করে সংসারের জটিলতা না বাড়াতেন। তারপরও শেষরক্ষা হয়তো হত, যদিনা সেই বাবা মদ জুয়া বিশেষত ঘোড়দৌড়ের বাজিতে না জড়িয়ে পড়তেন। জীবনের ঘুঁটি বড়ই নির্মম; একবার চাল দিলে তা আর শোধরানো যায়না। লুদুর বাবা অবশ্য শোধরানোর কোন চেষ্টা করেছিলেন বলেও মনে হয়না। প্রথম স্ত্রীর ঘরের দ্বিতীয় পুত্র লুদু। বড় পুত্র রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও পিতৃগুণ কিছুমাত্রায় বিদ্যমান তার চরিত্রে। তবু ছোট ভাইটিকে দর্জির কাজে লাগিয়ে দেয় এক জায়গায়। বাবা ধরে নিয়ে রাজমিস্ত্রির সহকারী বানিয়ে দেন। হঠাৎ করে বাবাটা মরে গেলে বড় ভাই হয়ে যায় বড় কর্তা। লুদু’র পড়ার খেয়াল থাকলেও সুযোগ মেলেনা। তার ওপর নিত্য অশান্তি। ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নানা বাড়ি চলে যায় লুদু।
নানাবাড়ি ঢাকা শহরে। এখানে তেমন কিছু করার নেই লুদুদের; খায়দায়, ঘোরাঘুরি করে এদিক-সেদিক। এই শহরে উঠতি বয়সী ছেলেদের দেখে হিংসে হয় লুদু’র। কত স্বাধীন ওরা ! চা সিগারেট খায় দোকানে, আড্ডা মারে, জুয়া খেলে, টাকা ওড়ায়। ওদেরকেই যেন জীবনের নায়ক মানে লুদু। ওদেরই একজন গোপাল, কাজ শেখানোর প্রস্তাব দিয়ে দলে ভেড়ায় লুদুকে। মাত্র তের বছর বয়সে এমনি করে পকেট মারার হাতেখড়ি হয়ে যায় লুদুর। গোপালের কৃপায় টাকা আসতে থাকে হাতে। ভাল ভাল কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় সে। চা সিগারেটে অভ্যস্ত হয়। সাহস বাড়ে ধীরে ধীরে। গোপালের সাহায্য ছাড়া একাই উপার্জনের চেষ্টা করে। বেশ সুন্দরভাবেই চুরিতে সাফল্য আসতে থাকে। আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। চুরির টাকায় ছোট ভাইকে স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দেয় লুদু।
কিন্তু মাস কয়েক পর ধরা পড়ে গিয়ে বেশ উত্তমমধ্যমের পর সোজা হাজতে যেতে হয় লুদুকে। মাস তিনেক হাজতবাসের সময় অভিজ্ঞ ও দক্ষ অনেক চোরের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের কাছ থেকে চুরিবিদ্যা সম্পর্কে দরকারি জ্ঞান লাভ হয়। মায়ের অনুরোধে ভাই মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছিল লুদুকে। তবে কিছুদিন পর আবারও ধরা পড়ে। এবার ন’মাসের জেল। জেলজীবন মন্দ কি! খাওয়াপরার ভাবনা নেই। এই পথের দক্ষ কর্মীদের সংস্পর্শে এসে নিজেকে আরও ভালভাবে তৈরি করে লুদু। এবারের মতো ছাড়া পেলেও শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় অন্তত এক বছর পুলিশের কড়া নজরদারিতে থাকবে; প্রতি রাতে পুলিশ ওর ঘরে গিয়ে অবস্থান দেখে আসবে। সাবধানী লুদু রাতের কাজ এখন দিনেই সেরে নেওয়ার চেষ্টা করে। দারোগা সাহেবেরতো খেয়েদেয়ে কাজ নেই, প্রতি রাতে লুদুর গতিবিধির ওপর নজরদারী করতে যাবেন। তাই একদিন ওকে ডেকে পাঠান থানায়। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন তাঁকে কেমন করে খুশি করতে হয়। কিশোর লুদু অল্পদিনে অনেক জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে। হাতে কিছু টাকা এলে ঝটপট বড় একটা মাছ, কিছু আলু-পটল আর একটা চকচকে দশ টাকার নোট নিয়ে সোজা দারোগা সাহেবের বাড়ি। লুদুর প্রতিভায় মুগ্ধ দারোগা। লুফে নেন লুদুর আনা উপহার। আর ভাল করে বুঝিয়ে দেন থানায়, জেলে- কোথায় কাকে কত করে দিতে হবে। এরপর ওকে দিনেরাতে অবাধে চুরি করার ছাড়পত্র দিয়ে দেন দারোগাসাহেব।
তারপর একে একে জিআরপি পুলিশ, সিআইডি অফিস- সবই হাতে আসে লুদু’র। বীর বিক্রমে চুরিবিদ্যার যাবতীয় জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বেশ অর্থকড়ি বানায় লুদু। তবে সবগুলো থানাকেতো হাত করতে পারেনি। তাই আবারও ধরা পড়ে। এবারের কারাগার সফরে গলার ভেতর ‘খোকড়’ বা ভাণ্ডার তৈরি করার কৌশল রপ্ত করতে শেখে লুদু। বঙ্গবন্ধুর কলমে ‘খোকড়’ তৈরির বিস্তারিত বিবরণ পড়ে শিহরিত হতে হয়। মোহর, গিনি, কাঁচা টাকা লুকিয়ে রাখার জন্য পেশাদার চোর ডাকাতরা রীতিমত শল্যচিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে অস্ত্রপচার করিয়ে এই ‘খোকড়’ তৈরি করিয়ে নেয়। ধরা পড়ার পর প্রচণ্ড মারের মুখে ‘খোকড়’ থেকে বিশেষ কায়দায় কিছু বের করে এনে দিলে শাস্তির প্রকোপ তৎক্ষণাৎ কমে যায়। তার অর্থ দাঁড়ায় চিকিৎসক থেকে শুরু করে আইনের লোক- সকলেই অবগত ‘খোকড়’ সম্পর্কে। ঠিক যেন ‘ওপেন সিক্রেট’।
কখনও কারাগারের ভেতরে কখনও বাইরে- এভাবে দিন কেটে যায় লুদু’র। নিয়মিত অতিথি হিসেবে অনেক কদর তার। দাপটও কম নয়। বড় কর্তারা কারাগার পরিদর্শনে এলে সবার নামে অভিযোগ করে বেশ ত্রাস সৃষ্টি করে ফেলে সে। একবার ছাড়া পেলে কয়েকজন সঙ্গীসাথী নিয়ে ভিনদেশে যাত্রা করে। গন্তব্য আসাম রাজ্যের সিলেট জেলা। চামড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ নিয়ে নিজ পেশা চালিয়ে যায়। মনের মানুষ পেয়ে ঘরও বাঁধে। তবে সত্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় সেই ঘর আর টেকেনা। কারাগারই তার ঘর এখন।
‘কারাগারের রোজনামচা’য় লুদু’র জীবনচরিত অংকিত হয়েছে একজন অ-পেশাদার কথাশিল্পীর কলমে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন চোরের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে প্রতিটি বাক্যে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লুদুর যখন দেখা হয় (১৯৪৯) তখন তার পরিণত বয়স। জেলখানায় তাঁর টুকটাক কাজ করে দেয়। কাজের ফাঁকেই লেখকের আগ্রহে নিজের জীবনের গল্প অকপটে বলে যায় লুদু ওরফে লুৎফুর রহমান। একজন চোরের জীবনকাহিনী কেন দিনলিপির পাতায় লিখছেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “ এর জীবনের ঘটনা থেকে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজব্যবস্থার চিত্র। মনুষ্য চরিত্র সম্মন্ধে যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর-ডাকাত-পকেটমার হয়। আল্লাহ কোন মানুষকে চোর ডাকাত করে সৃষ্টি করে না। জন্মগ্রহণের সময় সকল মানুষের দেল একভাবেই গড়া থাকে। ”
‘কারাগারের রোজনামচা’য় সাত দশক আগের সমাজের যে চিত্র অংকিত হয়েছে তা থেকে আমাদের সমাজ আজ কতটুকু এগিয়েছে তার হিসেব নিকেশ করতে বসলে আমরা নিজেদেরকে বড় একটা অগ্রগামী বলে দাবী করতে পারব কি? ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন- কম গৌরবের কথা নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক স্মারক বিদ্যমান দেশজুড়ে। কিন্তু কিশোর অপরাধচক্র জালের মতো ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে। আমাদের কিশোরদের বাঁচাতে, সমাজটাকে বাঁচাতে পরিকল্পিত কোন ব্যবস্থা কোথাও নেই, যদিও দপ্তর, দলিলপত্র, সাজগোজ কোন কিছুর কমতি নেই। অপরাধীকে শোধরানোর কোন চেষ্টা নয়, উদ্যোগ নয়, কেবল আটকে রাখাই কি কারাগারের কাজ?
‘তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে, তুমি ধন্য ধন্য হে’- নজরুল বিদ্রুপাত্মক এই সংগীত রচনা করেছিলেন কারাগারে বসে, পরাধীন ভারতে ইংরেজ রাজত্বকালে। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় চিত্রিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনাধীন পরাধীন বাংলার কারাগারের ছবি। স্বাধীন বাংলাদেশের কারাগারের ছবি একটু তো ভিন্নতর, উন্নততর হওয়ার কথা। আজও কেন ছোট অপরাধী কারগারে কিছুদিন বন্দী জীবন কাটিয়ে আসার পর ধীরে ধীরে দুধর্ষ অপরাধীতে পরিণত হয়?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণমানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের বড় একটা অংশ কারাগারে কাটানো বঙ্গবন্ধু রাজবন্দী হয়েও অনেক ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও সম্মান দিয়ে কাছে টেনেছেন সাধারণ কয়েদীদের। তাদের জীবনের গল্পে ব্যথিত হয়েছেন তিনি। নিছক একাকী সময় কাটানোর জন্য লেখা হয়নি ‘কারাগারের রোজনামচা’। জাতির জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক নির্দেশনা আছে এই দিনলিপির পাতায়-পাতায়। আমরা কি সেইসব নির্দেশনা প্রাণে ধরে এগিয়ে যাব না?
আজকাল আলোকিত মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর চেতনার কথা বলে যান অনেকে উচ্চকণ্ঠে। তাঁদের অনেকেই আবার অপরাধ দমনের নামে অপরাধকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেন। সমাজের উঁচু তলার অনেক বাসিন্দা ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ্গন এসব নিয়ে বড় একটা ভাবেননা – যা কিনা নিরাপদ ও কল্যাণময় সমাজ গঠনের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। অপরাধী ও অপরাধকে জিইয়ে রাখার এই প্রবণতা, যুগযুগ ধরে চলে আসা সকল অপব্যবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি কথায় অনেক কথা বলা হয়ে যায়- “বঙ্গবন্ধুর সুচিন্তা থেকে আজকের বাঙালিরও শেখার আছে” (দৈনিক আজাদি, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। আমরা আদৌ কিছু শিখছি কি?- স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে এই হোক আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি মৃত্যুর সংবাদ
পরবর্তী নিবন্ধবাণিজ্য সম্প্রসারণে বাংলাদেশের সাথে ইন্দোনেশিয়া কাজ করতে পারে