প্রিয় আপা,
জানুয়ারি মাস এসে গেছে ২০২১। জানুয়ারি মাস আসলেই আমরা ঘটা করে আপনার জন্মদিন পালন করতাম। ১৬ জানুয়ারি। অনেকবার আপনি স-উদ্যোগে আমাকে মেন্যু ও খরচ দিতেন। তারপরও কত আনন্দ। আহা! নাহ! এখন আর আনন্দ নেই। চারিদিকে করোনার আহাজাবির। তদুপরি যাঁদেরকে ঘিরে আনন্দ ছিলো সেই আপনি শ্রদ্ধেয় রুনু সিদ্দিকী খালাম্মা, শামসুন নাহার পরান আপা, সাবেরা হোসেন খালাম্মা, ফজিলতুল কদর খালাম্মা। সবাই আপনারা একই তরীর যাত্রী। অন্য লোকের বাসিন্দা আজ।
অন্তরের কন্দরে যেনো বেজে উঠলো জগন্ময়মিত্রের সেই সুর-
তুমি আজ কত দূরে…।
আপা, আপনি কি আসলেই এখন আমা হতে দূরে? আমার তো তা মনে হয় না। মন বলে-
‘নয়ন সমুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই।’
প্রকৃতই তাই। আপনি বেগম ‘ফাহমিদা আমিন’ শুধু আমার নয়; আমাদের চট্টগ্রামবাসীর যাঁরা সাহিত্য শিক্ষা সংস্কৃতি ও সমাজসেবামূলক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছে, তাদের সবার অন্তরে আপনার ঠাঁই অবধারিত হয়েই আছে চিরদিনের জন্য। শুধু কি এরা! আপনার স্বজন-আত্মীয় সবার কাছেই ছিলেন প্রিয়ভাজন। ৮ জন দেবর ও ৩ জন ননদের প্রিয় বড় ভাবি। অসংখ্য গুণগ্রাহী সেই সাথে। প্রতি ঈদে নিয়মিত আপনার শেরশাহ কলোনীর বাড়িতে বসতো ঈদ মিলনমেলা, এঁদেরকে নিয়েই।
আপা, আপনার সাথে আমার পথ চলা ৯০’এর দশকের শুরু থেকেই। যা আপনার আমৃত্যু অব্যাহত ছিলো। একটানা ২৭ বৎসর। ভাবা যায়! এতটা বৎসর আপনাকে কতভাবে, কত রূপেই না দেখেছি। চিনেছিও বটে। বোনদের মাঝে আমিই বড়। মাথার উপর সেই বড় বোনের সাধ মিটিয়েছি আপনাকে পেয়ে। আপনার অকৃত্রিম আদর-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, নির্দেশ, আদেশ-উপদেশ, ভালো-মন্দের পার্থক্য নিয়ে জীবনকে চিনিয়েছেন প্রায় হাতে ধরেই। আপনি ছিলেন- চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের প্রায় আজীবনের প্রতিষ্ঠাত্রী সভানেত্রী। চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবের প্রাক্তন সভানেত্রী ও দীর্ঘদিনের উপদেষ্টা। বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়েছেন। আপনার সাথে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সম্মেলনে, সিলেটের সম্মেলনে হোটেলে একত্রে অবস্থান। ঐসব দুর্লভ ও মধুর স্মৃতি! যা আমৃত্যু আমার হৃদয় মাঝারে আজও নক্ষত্রের মতই বিরাজ করছে।
অবাক হয়ে ভাবতাম, কোথায় শেরশাহ কলোনী। রিকশায় করে বিভিন্ন সভা, সমিতির মিটিং-এ, সেমিনারে একেবারে সঠিক সময় উপস্থিত থাকতেন। সময়ানুবর্তিতা কাকে বলে আপনার কাছ থেকে শেখা ও দেখা। রত্নগর্ভা মা। ছ’টি পুত্র সন্তানের জননী। এরা সবাই এক একজন হীরের টুকরা। কর্নেল এরশাদ তো পিলখানা ট্র্যাজেডিতে চিরতরে হারিয়ে গেলো। অন্যরা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে স্ব স্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে। এঁরা ‘আমিন পরিবার’ নামের ঔজ্জ্বল্যকে আরো মহিমান্বিত করেছে তাঁদের কর্ম দিয়ে। খুলনার মেয়ে, মিরেসসরাইয়ের বধূ, চট্টগ্রামের স্বনাম ধন্য রম্য সাহিত্যিক, সমাজসেবী ও সংগঠক। সব ক্ষেত্রেই আপনি সার্থক ও সফল। অষ্টম শ্রেণি পড়াকালীন বিয়ে, ছ’টি সন্তানের জননী। সংসারধর্ম পালন করে, সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েছেন। আপনাকে যতই দেখতাম ততই মুগ্ধ হতাম। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই যে গানের কলি ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’। আপনি তো গাইতেন না। চমৎকার রাঁধতেন, উল বুনতেন, আর ততোধিক সুন্দর, আকর্ষণীয় ও রসালোভাবে বক্তব্য রাখতেন। আপনি যখন মাইকের সামনে দাঁড়াতেন, দর্শক শ্রোতারা নড়েচড়ে বসতো। আপনাকে শোনার জন্য সেই অসাধারণ বক্তব্য, চমৎকার রসালো যুক্তিভরা উপস্থাপনা…। আপনার অসাধারণ সব রম্যরচনা শুধু দেশেই নয় বিদেশে অগণিত পাঠকপ্রিয় ছিলো। এর বাইরে গল্প, গান, কবিতা, শিশুতোষ, সাহিত্য, ছড়া, স্মৃতিকথাসহ আপনার অসংখ্য লেখা। তেমনি অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা, স্বর্ণপদকে আপনি সম্মানিত হয়েছেন, বহু সংগঠক থেকে। দেশ ও দশের জন্য আপনার ও দুলাভাই ড. এম আর আমিনের অবদান অনস্বীকার্য। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতি (চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ) চক্ষু হাসপাতাল, মহিলা সমিতি এতিমখানা, লেডিস ক্লাব, এতিম খানা, কোথায় নেই আপনার অবদান। আপনাদের অবর্তমানে আপনার সুপুত্রেরা এখনও আমাদের সাথেই আছে অকৃত্রিম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে।
শিক্ষাক্ষেত্রে শেরশাহ কলোনীর ডা. মাজহারুল হক উচ্চ বিদ্যালয় (আপনার শ্বশুরের নামে) যাতে অসংখ্য ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করছে বিগত দুই দশক ধরে।
রিয়াজ উদ্দিন বাজারে অবস্থিত ‘আল আমিন মসজিদ’ও আপনাদেরই সৌজন্যে বিরাজমান। এছাড়া মিরসরাইতে আমিন ভাইয়ের মা-এর নামে খাইরুন্নেছা চ্যারিটেবল ডিস্পেনসারি আজো নিয়মিত অসহায় দ:ুস্থদের সেবায় নিয়োজিত। আপা, এসবই আপনাদের একান্তভাবেই অনবদ্য অর্জন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা সর্বক্ষেত্রে যা একান্তভাবেই অনুসরণীয় ও বরণীয়। চট্টগ্রাম জেলা মহিলা পরিদপ্তরে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। পরে সংসারের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু সমাজসেবা, সাহিত্যচর্চা এসবের সাথেই ছিলেন আজীবন। মনে পড়ে জনাব এল.কে. সিদ্দিকী (প্রয়াত) আজাদীতে আপনাকে লিখেছিলেন ‘সাদা কোটপরা মহিলাটি’ (সম্ভবত এই শিরোনামে)
আপনার সেই শূন্যস্থান আজও অপূরণীয়, আপা।
আপা, আপনি এখন অন্যলোকের বাসিন্দা। এই পৃথিবীর কিছুতেই হয়তো কিছু এসে যায় না। তবুও আমাদের হৃদয়ে লাগে বৈকি। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন এবারে কেন্দ্র থেকে বেগম রোকেয়া পদকের চট্টগ্রামের দু’জন সম্মানিত হয়েছেন। একজন স্বনামধন্য সাহিত্যে শ্রদ্ধেয় ও (আপনার বান্ধবী) সর্বজন প্রিয় মুশতারী শফী। অন্যজন স্বনামধন্য ড. শিরিণ আকতার (উপাচার্য্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)। আজ মনে পড়ছে, সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে আপনার ও অন্য কয়েকজনের নামের প্রস্তাব রাজধানীতে পৌঁছেছে কয়েকবার। কিন্তু অজানা কারণে তা অধরাই থেকে গেছে। আপনি ঢাকায় অবস্থান করলে হয়তো বা অন্যরকম হতো।
তবে চট্টলবাসী তার ও আগে আপনাকে ‘চট্টগ্রামের রোকেয়া’ এই বিশেষণে ভূষিত করেছিলো। আপনি ছিলেন আমাদের ‘রোকেয়া’ আজ মনে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলে ও সবার অন্তরের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এই স্বীকৃতির কি কোনো তুলনা হয়? এই ভালোবাসা ও সম্মানের মূল্যমান আমার অজানা। সে হিসাব কষতে আমার কলমও অপারগ। একেই বলে বুঝি হৃদয়ের মাঝে ঠাঁই নেয়া।
আগামী ১৬ জানুয়ারি আপনার জন্মদিন। ২০১৭ তে গেলেন আমেরিকায় ছেলের সাথে। ফোনে কথা হলো। একটি দুস্থ মেয়ের জন্য সেলাই মেশিনের টাকা পাঠালেন। (আমার অনুরোধ)। এরপর ১২ জানুয়ারিতে ওখানেই চিরবিদায় এবং সমাহিত হলেন। শেষ দেখাটা দেখতেও আমরা পেলাম না। দুর্ভাগ্য মনে হয় আমার নিজের কাছেই।
আবার জানুয়ারি এসেছে ২০২১। করোনা ছোবলে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত। আপনাকে দেখি না। তি..ন..বৎসর। কিন্তু আপনি আছেন, থাকবেন অমর ও অক্ষয় হয়ে হৃদয়ের মাঝে। যেখানেই আছেন শান্তিতে থাকুন। করুণাময়ের করুণা আপনাকে ঘিরে থাকুক এই কামনায় শেষ করছি আপা।
ইতি-
আপনার স্নেহধন্য জিনাত