একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা

প্রতিমা দাশ | বৃহস্পতিবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

তপ্ত দুপুর, বেলা তখন ১২ টা পাঁচ দশ হবে, জামাল খান প্রেসক্লাবের সামনে খেয়াল করলাম এক মধ্যবয়সী নারী চলতি পথে সবাইকে ডেকে ডেকে একটা সাদা কাপড়ে সাইন করাচ্ছে, আমিও ছেলেকে নিয়ে সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। তিনি আমাকেও ডাকলেন এবং বললেন এই সাদা কাপড়ে নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য লিখতে। আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় কলমটি নিয়ে লিখলাম। তারপর কৌতুহলবশত জানতে চাইলাম, আন্টি আপনার তো এই রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে একটা ছাতা কিংবা মাথায় টুপি দিতে পারতেন। উনি তখন উঁচু গলায় বললো : কিসের কষ্ট মা! একজন ছেলেকে দিয়ে যদি ধর্ষণের বিরুদ্ধে একটি মন্তব্য লেখাতে পারি তাহলে সে নারীদের টিজ করার আগে একটু হলেও ভাববে! তারপর উনি বিষণ্ন মুখে বললেন, জানি না দেশটার ভিতর কী চলছে। যেখানে ৯ মাসের বাচ্চা পর্যন্ত চাচার হাত হতে রেহাই পায় না? প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ধর্ষণের খবরে আমার বুকটা ভেঙে যায়। আমার কানে বাজে বীরঙ্গনাদের চিৎকার আচ্ছা বল, স্বাধীন দেশের মেয়েরা কেন ধর্ষিত হবে। এখন তো পাকিস্তানের হায়েনারা নেই? আমরা লাঠি পোষ্টার হাতে যেভাবে রাজপথ কাঁপিয়েছি। এখন তো এই যুগের মেয়েরা ভার্চুয়াল জগতের দুই একটা পোস্ট দিয়ে সারা! এইজন্যই কি যুদ্ধ করেছিলাম! আপনি মুক্তিযোদ্ধা! আরেকটি মেয়ে প্রশ্ন করলো। হ্যাঁ আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমার নাম লিলুফার জাহান বেবী।
চট্টগ্রাম এক নম্বর সেক্টরে নারী সৈনিক হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমার সপরিবার মুক্তিযোদ্ধা, আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পোশাক পরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিতাম, গোপন সংবাদ সংগ্রহ করতাম, আগরতলা থেকে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়ির আস্তানায় আসতো। বহুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি! বহু লাশের উপর দিয়ে আমি হেঁটে গেছি মাইলের পর মাইল! এখনো আমি যুদ্ধ করে যাচ্ছি, আমি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একনিষ্ঠ কর্মী। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এই সংগঠনের স্রষ্টা। আমরা সরাসরি কবি বেগম সুফিয়া কামালের সাথে এই সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিয়েছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির সদস্য ছিলাম, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছি। শাহবাগ আন্দোলনের সময় আমরা চট্টগ্রামে তিনশ নারী একসাথে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেছিলাম। দুঃখ একটাই কি জানো! এতো ত্যাগ এতো কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ভূমিতে আজও দেশীয় হায়েনাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যেতে হচ্ছে। যখন একজন ধর্ষিতার আত্মহত্যার কথা শুনি তখন আমার মুক্তিযুদ্ধ পরাজিত হয়। যখন কোনো সাম্প্রদায়েক নির্যাতনের কথা শুনি তখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরাজিত হয়। আমি ঘুমাতে পারি না! সত্যি পারি না। আমি আরও একটা কাজ সাহসের সাথে করি, আমার গ্রামের প্রতিটি মা বাবাকে বুঝিয়ে বলি তাদের সন্তানদের যেন কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পড়াতে না পাঠায়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মানেই কারাগার। বহু বাচ্চাদের আমি কারাগার থেকে মুক্ত করেছি। তার জন্য টিএনও’র কাছ থেকে ও পুরস্কার পেয়েছি। উনি তাঁর মোবাইলে সেই ছবি দেখালো, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসের সার্টিফিকেটটিও দেখালো। বিদায় নেয়ার সময়, আমি এবং আমার পুত্র তাঁর দুই পায়ে বিনম্র চিত্তে প্রণাম করলাম। বিজয়ের মাসে এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা অগ্নিকন্যার সাথে দেখা হাওয়াটা সত্যি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ছেলে ও খুব কাছ থেকে একজন নারী মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রামের কাহিনী শুনেছে, এটাও বিশাল পাওয়া। জয় বাংলা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জন্য নিরন্তর শুভকামনা
পরবর্তী নিবন্ধফেরদৌস উদ্দিন আহমদ চৌধুরী অকুতোভয় এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প