ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে

| শুক্রবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৯:১২ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ। অনেক পদ্ধতি, কৌশল ও প্রচেষ্টা অবলম্বনের পরও তা আজও হাতের নাগালের বাইরে। সামপ্রতিককালে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতের ১২১৩ শতাংশই ঋণ খেলাপি হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে লাখো কোটিতে পৌঁছেছে অনেক আগেই। আর এই লাগামহীন খেলাপি ঋণের জন্যই অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে একধরনের বন্ধ্যত্ব।

 

গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে দেশের শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপির তালিকা দেওয়া হয়েছে । ব্যাংকে তাদের ঋণ স্থিতির পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আর মোট খেলাপি ঋণ হচ্ছে ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। সরকারি দলের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নে সংসদে এ তথ্য উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,শহীদুজ্জামানের প্রশ্ন ছিল, বর্তমানে দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা কত? এ ঋণ খেলাপির মধ্যে শীর্ষ ২০ জনের নাম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানাসহ তালিকা কী? জবাবে অর্থমন্ত্রী ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) ডেটাবেইজে সংরক্ষিত (নভেম্বর ২০২২ মাসভিত্তিক) দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপির তথ্য তুলে ধরেন। এই তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ খেলাপির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বছর কয়েক ধরে সময়ে সময়ে বড় ঋণ পরিশোধে ছাড়সহ নানা সুবিধা দিচ্ছে সরকার। তবে খেলাপি ঋণের রাশ টানতে তা জোরালো ভূমিকা রাখছে না। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা।

এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে মনে করেন অর্থনীতির গবেষকরা।

পত্রিকান্তরে তালিকা বিশ্লেষণের একটা চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি বিএনপির নেতাদের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে শীর্ষ খেলাপির তালিকায়। ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টিই চট্টগ্রামের। আর শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকার বেশির ভাগই বিদ্যুৎ, জাহাজ নির্মাণ, পাদুকাশিল্প, ভোগ্যপণ্য ও ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠান।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খেলাপির তালিকায় প্রকৃত চিত্র আসছে না। কারণ, প্রভাবশালী গ্রাহকেরা নিজেদের ঋণ বছরের পর বছর শোধ না করেও নিয়মিত দেখাচ্ছেন। ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ প্রতিবছর পুনঃ তফসিল ও নবায়ন করে নিয়মিত রাখছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃ তফসিল, পুনর্গঠন সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। এ ছাড়া করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালের পুরোটাই ঋণ শোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ ছিল।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ঋণখেলাপি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশেষ করে ঋণখেলাপিদের শাস্তি দেয়ার কথা এলেই একটা বিভাজন সরকারের তরফ থেকে করা হয়, সেটি হলো ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। কিন্তু কে যে ইচ্ছাকৃত আর কে নয়, তার কোনো সুরাহা হয়নি।

তাঁরা বলেন, এখন খেলাপি ঋণ আদায়ে কিছু বিষয় সুবিবেচনায় আনা প্রয়োজন। ঋণ বিতরণ ও আদায়ে সমতা বিধান করা। ঋণ বিতরণ যদি স্বচ্ছতার সঙ্গে উৎপাদনশীল খাতে হয় তাহলে আদায়ের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে ব্যাংকার গ্রাহকের নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, যারা অসাধুতাকে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত করে তারা উভয়ই সমান দায়ী। এ ব্যাপারে প্রথমে ব্যাংকারদের সতর্ক হতে হবে এবং পরে গ্রাহককেও এ পথ অনুসরণ করতে হবে।

অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ পত্রিকান্তরে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বড় গ্রাহকদের প্রকৃত চিত্র দেখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। দেখতে হবে আসলে ঋণের টাকা আদায় হচ্ছে কি না। গোড়ায় ঠিক না থাকলে ভালো নীতি নিয়েও কাজ হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ক্ষমতা আছে, তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।

ঋণখেলাপিদের সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালকদের যোগসূত্র আছে। এ জন্য প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাহলেই ব্যাংক খাতের যে অব্যবস্থাপনা চলছে, তা দূর হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে