উন্মুক্ত সমুদ্রে মেরিকালচার প্রযুক্তি উদ্ভাবন

গবেষণা চবির, অর্থায়নে বিএফআরআই, একইসাথে হবে কোরাল দাতিনা খরুল বাটা শামুক-ঝিনুক ও সী-উইডের চাষ

কক্সবাজার প্রতিনিধি | সোমবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২১ at ৯:০২ পূর্বাহ্ণ

প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর ভিত্তি করে উন্মুক্ত সমুদ্রে ভাসমান খাঁচায় চাষ হচ্ছে সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছ কোরাল, দাতিনা ও খরুল বাটা। একইসাথে চাষ হচ্ছে শামুক-ঝিনুক, কাঁকড়া ও সী-উইডের। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) অর্থায়নে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলে গবেষণা চালিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো ‘ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি ট্রফিক একুয়াকালচার’ (আইএমটিএ) নামের এই সমন্বিত মৎস্যচাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এ লাভজনক পদ্ধতিতে মৎস্যচাষের মাধ্যমে দেশের ব্লু ইকোনমিতে নতুন দুয়ার খুলতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
‘উন্মুক্ত লোনা পানিতে সমন্বিত মেরিকালচারের মাধ্যমে উপকূলীয় মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সুনীল অর্থনীতি প্রসারে এর গুরুত্ব’ শীর্ষক সেমিনার ও প্রদর্শনীমূলক অনুষ্ঠান গতকাল শনিবার মহেশখালীর আদিনাথে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক। তিনি বলেন, এ ধরনের গবেষণা প্রকল্প গণমুখী করে প্রান্তিক পর্যায়ে চাষিদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে সরকারের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাাশি রাষ্ট্রীয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথ আরো সুগম হবে।
এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ ইনামুল হক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. শফিকুল ইসলাম।
গবেষকদলের প্রধান ড. মোহাম্মদ শাহ্‌ নেওয়াজ চৌধুরী বলেন, এই প্রযুক্তি মহেশখালী দ্বীপের আশেপাশে প্রায় ৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে সমপ্রসারণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে একই সাথে খাদ্য শৃঙ্খলের বিভিন্ন স্তরের উৎপাদক ও খাদকের নিয়ন্ত্রিত উপায়ে চাষ করা হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। আবার এর পরিবেশ-প্রতিবেশগত উপকারিতাও রয়েছে। এই পদ্ধতিতে একই স্থাপনা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচে একাধিক জাত চাষ করা যায়; যার ফলে প্রান্তিক চাষি যেমন একদিকে লাভবান হয়, অন্যদিকে বিভিন্ন স্তরের খাদক, উৎপাদক ও বিয়োজকের সমন্বয়ে গড়ে উঠে অনন্য জলজ পরিবেশ। সেই সাথে এই পদ্ধতি অল্প জায়গায় বেশি উৎপাদনমুখী হওয়ায় সামুদ্রিক চাষাবাদের স্থান সংকট সংক্রান্ত সমস্যারও একটি কার্যকর সমাধানরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে।
চবি সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, উন্মুক্ত সামুদ্রিক পরিবেশে এই চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি গবেষকদল গঠন করা হয়। ড. মোহাম্মদ শাহ্‌ নেওয়াজ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গবেষকদলটি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অর্থায়নে ২০১৮ সাল থেকে কঙবাজারের মহেশখালী চ্যানেলে গবেষণা চালিয়ে আসছে।
তিনি জানান, উন্মুক্ত লোনা পানিতে সামুদ্রিক মাছ, ঝিনুক, কাঁকড়া, সী-উইড চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়নের মাধ্যমে উপকূলীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি সুনীল অর্থনীতির প্রসারের লক্ষ্যে গৃহীত এই গবেষণা প্রকল্পের প্রথম বছর মহেশখালী চ্যানেলে উন্মুক্ত লোনা পানিতে মেরিকালচারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় এবং দ্বিতীয় বছর চ্যানেলটির একাধিক স্থানে মাঠ পর্যায়ে ভাসমান স্থাপনা স্থাপন করে কম খরচের সর্বাধিক কার্যকরী ও সফল ঝিনুক চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। প্রকল্পের তৃতীয় বছর বাংলাদেশে সর্বপ্রথম লোনা পানিতে সমন্বিত চাষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহেশখালী চ্যানেলে বিশেষ গবেষণা সুবিধা সম্বলিত একটি প্রদর্শনীমূলক ভাসমান আদর্শ খামার স্থাপন করা হয়, যাতে একই সাথে সামুদ্রিক মাছ, ঝিনুক, কাঁকড়া ও সী-উইড চাষ করা হচ্ছে।
গবেষকদলের প্রধান ড. শাহ্‌ নেওয়াজ চৌধুরী বলেন, চলমান প্রকল্পটিতে উন্মুক্ত লোনা পানিতে ভাসমান খাঁচায় তিন প্রজাতির মাছ (কোরাল, খরুল বাটা, দাতিনা), দুই প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির সী-উইড ও ৩ প্রজাতির ঝিনুক সম্বলিত একটি প্রদর্শনীমূলক খামার তৈরি করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের মাছ, কাঁকড়া, ঝিনুক ও সী-উইড বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় বলে বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশও অন্যান্য চাষ পদ্ধতি থেকে বেশি। প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতার কারণে প্রকল্পের চাষকৃত মাছের আশানুরূপ বৃদ্ধিও নিশ্চিত হয়েছে।
কঙবাজারস্থ বিএফআরআই সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, সুনীল অর্থনীতি প্রসারে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদনের সিংহভাগ আসে প্রাকৃতিকভাবে আহরিত মৎস্য সম্পদ থেকে। অতিরিক্ত ও অপরিকল্পিত মৎস্য সম্পদ আহরণের ফলে বেশিরভাগ প্রজাতি হারিয়েছে তার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতা। মাছের সাথে সাথে মলাস্ক (ঝিনুক, ওয়েস্টার ইত্যাদি), কাঁকড়া-চিংড়িসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল প্রতি বছর আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। উপকূলীয় মৎস্য সম্পদের এই প্রার্চুয্য হ্রাস এবং গণবিলুপ্তি রোধের পাশাপাশি সুনীল অর্থনীতিতে এই সম্পদকে কাজে লাগানোর সর্বাধিক কার্যকর উপায় হলো সামুদ্রিক চাষাবাদ।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, সুনীল অর্থনীতি প্রসারে গবেষণার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটকে প্রায় ১শ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বিএফআরআই। এরই আওতায় কঙবাজারে মেরিকালচার নিয়ে গবেষণা চলছে। তিনি জানান, বর্তমান সরকার গবেষণা খাতে যে বরাদ্দ দিচ্ছে, তা আগের তুলনায় অন্তত ২০ গুণ। বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক সময় ব্যয় করাও যায় না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম গণহত্যার নির্দেশদাতারা গণদুশমন: মোশাররফ
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬