ইসলামিক ফুড ব্যাঙ্ক অফ টলিডো

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ১ মে, ২০২৩ at ৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ

টার্গেট ছিলো দু’ঘন্টায় পাঁচশ’ উইকএন্ডার ফুডব্যাগ বানানোর। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় প্রোগ্রামডিরেক্টর ডাঃ রাজী রফিক স্পিকারে এনাউন্স করলেন, আমরা পাঁচশ’র বেশি ব্যাগ অলরেডি করে ফেলেছি। সকলে মুহুর্মুহু তালি আর উল্লাসধ্বনি তুললো। কিন্তু কাজ থামালো না কেউই। দুই ঘন্টার টার্গেটে কাজ করতে এসেছে, দুই ঘন্টাই করবে। নাম্বারের টার্গেট ক্রস করেছি তো কী হয়েছে? সপ্তাহে না লাগলেও, রেডি করা থাকলে পরের সপ্তাহেই তো লাগবে। দুপুর বারোটার দিকে আমরা হাত গুটালাম, বোর্ডে লেখা উঠলো এক হাজার ছয়টা ফুডব্যাগ তৈরি হয়েছে আজ। টার্গেটের দুইগুণ বেশী। এটা হচ্ছে ইসলামিক ফুডব্যাঙ্ক; আর আজ এখানে কাজ করছে প্রায় সত্তরআশি জন। আমরা ছয়সাতজন মুসলিম ছাড়া, আজকের সব ভলান্টিয়ারই ননমুসলিম, সাদাকালোবাদামী, ছেলেমেয়ে, বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্করা সকলেই এসেছে।

সপ্তাহের কাজ শেষে, শনিরবির ছুটিতে কোথায়ও ঝট করে ঘুরতে বেরুনোর জন্যে, হাল্কা যেই ব্যাগ থাকে, তাকেই বলে “উইকএন্ডার ব্যাগ”। কিন্তু ইসলামিক ফুডব্যাঙ্কে বানালাম “উইক এন্ডার ফুডব্যাগ”। বিত্তশালীরা শনিরবিতে হয়তো আমোদভ্রমণ করতে সক্ষম; কিন্তু মুদ্রার উল্টাপিঠে দরিদ্র পরিবারে অনেকেই, বিশেষ করে স্কুলের বাচ্চারা উইকএন্ডে অভুক্ত থাকতে পারে। হ্যা, এই অ্যামেরিকাতেই হাজার হাজার দরিদ্রমানুষ আছে, যাদের প্লেটে প্রতিদিনের খাওয়ার থাকে না। এদেশে দরিদ্র ছাত্রদেরকে স্কুলদিনগুলোতে স্কুলেই ফ্রি খাওয়া দেয়। কিন্তু উইকএন্ডে? তখন অনেক বাচ্চাই না খেয়ে থাকে। তাদের জন্যেই এই ফুডব্যাগ। এতে থাকে চারজনের পরিবারের ভরপেট খাওয়ার জন্যে, সহজে রান্নার মত পুষ্টিকর খাবার। এগুলোকে শহরের বিভিন্ন স্কুলে বিতরণ করা হয়, সেখানের গরিব ছাত্ররা সেগুলো বাসায় নিয়ে যায়।

ব্যাগিং করার সিস্টেমটাও সুন্দরভাবে অর্গানাইজ্‌ড্‌অনেকটা আধুনিক কারখানার এসেম্বলিলাইনের মতই। ওয়ার হাউজের মাঝে দুই লাইন ধরে সব বাক্সভর্তি খাবার কিনে সিরিয়াল অনুসারে রাখা হয়। দুই লাইনের সামনেই লাইন ধরে অনেকগুলো টেবিল পাতা থাকে, যেখানে বাক্স থেকে খুলে দশবিশটা আইটেম টেবিলগুলোতে এনে রাখা হয়। বিল্ডিংএর একপ্রান্তে থাকে খালি ব্যাগের বান্ডিল। ভলান্টিয়াররা সেখান থেকে একটা করে ব্যাগ তুলে নিয়ে প্রতি টেবিল থেকে হিসাবমত আইটেম ব্যাগে ভরে ভরে বিল্ডিংএর অন্যপ্রান্তে গিয়ে শেষ হলে একটা গিট্টু দিয়ে বড় কন্টেইনারে জমা করে। কিছু ভলান্টিয়ার ব্যাগ নিয়ে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ভরে ভরে যায়, অন্যরা টেবিলের উপরের আইটেম কমে আসলে, বাক্স থেকে বের করে আনে। এইভাবে খুব দ্রুতই শত শত ব্যাগ তৈরি হয়ে যায়।

আজ ছিলো মার্টিন লুথার কিং ডে; এবং ওনার স্মরণে স্কুলকলেজসহ অনেক অফিসআদালতই বন্ধ। যদিও ডঃ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের জন্ম জানুয়ারির পনের তারিখ; কিন্তু প্রতি বছর, জানুয়ারির তৃতীয় সোমবারেই অফিসিয়াল ছুটি পালন করা হয়। আজকে ভলান্টিয়ার করেছে বেশ কয়েকটা বড় বড় কর্পোরেশানের কর্মকর্তারা, সঙ্গে তাদের পরিবার। ছয়সাত বছর বয়স থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটিপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীও প্রচুর আছে। সকলেই উচ্চবিত্ত পরিবারের; কিন্তু আজকের দিনে স্বতঃস্ফূর্ত এখানে এসেছে নিজেদের হাতে দু:স্থদের জন্যে কাজ করবে বলে। ডঃ মার্টিন লুথার কিংকে আমরা সকলেই জানি বর্ণবৈষম্যবাদবিরোধী নেতা হিসাবে। কিন্তু, বর্ণবৈষম্যবাদের সঙ্গে সঙ্গে উনি আরো অনেক বৈষম্যবাদ নিয়েই জোর প্রতিবাদ চালিয়েছিলেনধনসম্পদের বৈষম্য, বাসস্থানের বৈষম্য, জ্ঞানার্জনের সুবিধার বৈষম্যএগুলো সবই একই সূতোয় গাঁথা। সেজন্য, মার্টিন লুথার কিং ডে উপলক্ষ্যে ফুডব্যাঙ্কের এই সার্বজনীন আয়োজন খুবই যথাযথ হয়েছিলো।

ফুডব্যাঙ্কের কনসেপ্ট অনেকদিন ধরেই চলছে, এবং অ্যামেরিকার প্রায় প্রতিটা শহরেগ্রামেই এরকম আছে। সমাজের সকলের ডোনেশান থেকেই এগুলো চলে; আর বড়বড় কোম্পানিগুলো বেশ বড় অঙ্কের ডোনেট করে; বা কোনো ফান্ডরেইজিং ইভেন্ট স্পন্সর করে। প্রধানত শুকনোখাবার, ক্যান্ড্‌ফুড/ফ্রুট, পাস্তা, গুঁড়াদুধ, সিরিয়াল, বিস্কুট, চকলেট এগুলোই থাকেযেগুলো সহজেই রান্না করা যায়, আবার তাড়াতাড়ি নষ্টও হবে না। টলিডোতেই বেশ কয়েকটা ফুডব্যাঙ্ক আছে; কিন্তু তারপরেও চাহিদা অনেক। বিশেষ করে কোভিডএর সময় থেকে চাহিদা আরো বেড়ে গেছে। আমরা মুসলিমরাও অ্যামেরিকান সমাজের সদস্য, এবং আমাদেরও নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে কিছু কর্তব্য আছে। আল্লাহর রহমতে অনেক বিত্তশালী মুসলিমও যেমন আছে, আবার অনেক দরিদ্রও আছে; বিশেষ করে সদ্য এদেশে আসা ইমিগ্র্যান্ট বা রিফিউজি। মুসলিমদের প্রতি যেমন আমাদের দায়িত্ব আছে; সেরকম একই দায়িত্ব আছে অমুসলিমদের প্রতিও। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সেই হাদিস আমরা সকলেই জানি– “একজন কখনই সত্যিকারের ঈমানদার হতে পারবে না, যখন সে ভরপেট খেয়ে ঘুমায় আর তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে।” ইসলামের মূল গোড়া, “ঈমান” নিয়েই বলেছেন তিনি। আর তিনি “মুসলিম প্রতিবেশী” বলেন নাই; বলেছেন “প্রতিবেশী”সে যেইই ধর্মেরই হোক না কেন।

বেশ অনেক বছর ধরেই, এখানের মসজিদগুলোতে মাসে একবার করে স্যুপকিচেন চালানো হয়, গরিবদের মাঝে গরম রান্না করা খাওয়ার বিতরণের জন্যে। কিন্তু সেটা অপ্রতুল; মাত্র একবেলা খেতে পারে। ২০০৮ থেকে ইসলামিক সেন্টার অফ গ্রেটার টলিডোর ফাউন্ডেশানের অর্থায়নে ইসলামিক ফুডব্যাঙ্ক চালু হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুই মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি খাদ্যদ্রব্য বিলানো হয়েছে; এবং প্রায় এক মিলিয়নেরও অধিক উইক এন্ডার ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। শত শত ভলান্টিয়ার তাদের সময় দিয়েছে আর দান করেছে দুই মিলিয়ন ডলার। কোভিডকালীন সময়ে সকল স্যুপকিচেন ও ফুডব্যাঙ্কের উপরে চাপ প্রচন্ড বেড়ে গিয়েছিলো। আল্লাহর রহমতে, তখনো ইসলামিক ফুডব্যাঙ্ক চালানো সম্ভব হয়েছে। আসলে সেসময়ে ডিমান্ড এত বেশী বেড়ে গিয়েছিলো যে, একটা পরিত্যক্ত ওয়ার হাউজ ভাড়া নিয়ে, সেটার ভিতরের জায়গাটাকে ফুডব্যাঙ্কের প্রয়োজনে লাগানো শুরু হয়। প্রথম প্রথম সেটা ফাঁকা গুদামঘরের মত ছিলো; এখন সেটাতেও আর জায়গা হয় না। মাশাআল্লাহ্‌, প্রচুর ডোনেশানও আসে, আবার প্রচুর ব্যাগিংও করতে হয়, জায়গাটা পুরো ভরে গেছে।

এখানেরই এক সাইডে ইউনিভার্সিটির ফুডপ্যান্ট্রির মত। আগে বলেছিলাম, গরিব ছাত্ররা স্কুলে খাওয়া পায়; ভালো কথা। কিন্তু তারা যখন ইউনিভার্সিটিতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গেই তো আর তাদের ও পরিবারের অভাব ঘুচে যায় না। তার উপরে পড়ালেখায় বেশী সময় দিতে হলে, কাজ করে আয় করাটাও কষ্টকর হয়ে যায়। সেজন্যে অ্যামেরিকার ইউনিভার্সিটিগুলোতে থাকে ফুডপ্যান্ট্রি। ভালো কথা, কিন্তু সেখানের অ্যামেরিকান খাওয়ার তো সকলের মুখে রুচে না; বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশের (বা মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য) ছেলেমেয়েরা বিপদে পড়ে। তাদের কথা চিন্তা করেই করা হয়েছে ইসলামিক ফুডপ্যান্ট্রি। তারা এখানে চালডাল, আটাময়দা, তেলনুনমসলা, হালাল মাংস ইত্যাদি পায়।

শুকনোখাবারের উইকএন্ডার ব্যাগের পাশাপাশি, মাসের দুই শনিবারে গরম রান্না করা খাওয়ারেরও ব্যাগ তৈরি করা হয়। সেগুলো শহরের চারপাঁচটা নির্দিষ্ট স্থানে (একটা মসজিদ, কয়েকটা চার্চ, একটা স্কুল) নিয়ে আমরা হাতে হাতে বিলি করে দেই। সেখানেও লাইন ধরে অনেকেই আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের খাবারের প্রতিক্ষায়। তাদের হাতে গরম রান্না করা খাওয়ার তুলে দিতে এক অন্যরকম অনুভূতি লাগে।

প্রতি বছরের মতই, এবারেও রমজান মাসে রমজান ফুডবক্স বানালাম। ইফতারি ও ঈদে মুসলিম (এবং ননমুসলিম) পরিবাররা যাতে একটু ভালো খেতে পারে, সেই চিন্তা করেই এই বক্স বানানো হয়। শুকনা খাবারের সঙ্গে আস্ত ফ্রোজেন চিকেন, ও অন্যান্য খাবার। শনিবারে প্রায় তিনশ’ বাক্স বানিয়ে রেডি করলাম। তারপরে রবিবারে মসজিদে আমরা সেগুলো নিয়ে দাঁড়ালাম। আগের থেকেই এনাউন্স করা হয়েছিলো। মুখে মুখেও অনেকের কাছে খবর পৌঁছেছিলো। যোহরের নামাজের পরে আমরা মসজিদের পার্কিংএ দাঁড়ালাম, আর তারা তাদের গাড়ি নিয়ে আমাদের কাছে আসার পরে, আমরাই তাদের গাড়িতে রমজানবক্স তুলে দিলাম। যেযার পরিবারের সংখ্যা বা কয়টা বক্স চায় বললে, আমরা ততগুলো বক্স তুলে দিলাম। তারপরেও অনেক বেচে গেলো। ভলান্টিয়াররা অনেকেই কিছু বাক্স নিলো, নিজেদের চেনাপরিচিত বা প্রতিবেশী গরিবদের দিবে বলে। তারপরে আরো পঁচিশতিরিশটা বাক্স নিকটবর্তী ছোট্ট শহর বোওলিং গ্রিনে পাঠানো হলো।

শুরুর থেকেই ইসলামিক ফুডব্যাঙ্ক প্রচুর প্রশংসা পেয়েছে। পেয়েছে সকলের সহায়তা। অ্যামেরিকাতে, দুঃস্থগরিব, গৃহহীন ও অভুক্তদের সাহায্য করার জন্যে বেশ কয়েকটা বড় বড় দাতব্য সংস্থা রয়েছেইউনাইটেড ওয়ে, ফিডিং অ্যামেরিকা ইত্যাদি। টলিডোর ইসলামিক ফুডব্যাঙ্ককেও এসমস্ত বড় সংস্থাগুলো অনেক সাহায্য করেছে। লোকাল নিইউজপেপার, টিভিতে অনেক অনেক কভারেজ পেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের একটা পত্রিকায় এই ফুডব্যাঙ্ক নিয়ে সুন্দর একটা নিবন্ধ বের হয়েছিলো, এখানে তার লিঙ্ক দিলাম।

https://www.thenationalnews.com/weekend/2022/09/09/the-halal-food-bank-keeping-amaricans-heads-above-water/

ফুডব্যাঙ্ক, স্যুপকিচেনে কাজ করলে অটোম্যাটিকালিই মনের মাঝে একটা পরিবর্তন আসে। যখন দেখি তাদের তুলনায় আমরা কত সুখে আছি, তখন নিজেদের পার্থিব লাক্সারি, মাত্রাতিরিক্ত বৈষয়িক লোভলালসা, শোঅফ, মিথ্যা দম্ভআড়ম্বর এগুলোর মূল্যহীনতা সহজেই বুঝা যায়। আমি একজন অ্যামেরিকানমুসলিমবাংলাদেশী। এইদেশে আমি ইসলাম ধর্মের মাঝ দিয়ে আমাকে ও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবো। ইসলামে ধনী হওয়ার বিপক্ষে কিছুই বলে নাই; বলেছে ধনসম্পদ দানে কঞ্জুসতা ও ধনের কারণে দাম্ভিকতা ও শোঅফের বিপক্ষে। আমাদের সকলেরই উচিত অল্পবিস্তর যা পারি, যা সামর্থ্যে কুলায় সেভাবেই দান করে অন্যের উপকার করা। শুধু টাকাপয়সা দিয়েই নয়, ভলান্টিয়ার করেও সময় দান করা যায়। আমরা কি সেটুকুও করতে পারি না? বা করতে চাইনা?

টলিডো, ওহাইও

refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধসমুদ্র-পার থেকে বরফের রাজ্যে