ইতিহাসের শিক্ষাকে মনে রাখা : নুরেমবার্গকে ভোলা যাবে না

এ.কে.এম. আবু বকর চৌধুরী | সোমবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ – ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫) ছিল জার্মানীর এক হিংস্র নরাধম এডলফ হিটলারের বিকৃত চিন্তারই ফসল, দম্ভভরে ঘোষণা করেছিল – “সমগ্র বিশ্ব জার্মানী ও হিটলার কর্তৃক শাসিত হবে। যদি সমগ্র বিশ্ব জয় করতে না পারি তবে অর্ধেক বিশ্বকে আমাদের সাথে সমাধিক তলে নিয়ে যাব। ১৯১৮ সালের পুনরাবৃত্তি হবে না। আমরা কোন অবস্থাতেই নত স্বীকার করব না” (দ্য ন্যুরেমবার্গ এপিলোগ / ২য় অধ্যায় / পৃষ্ঠা-২১)
এই হিংস্র ও অমানবিক দম্ভ বাস্তবে রূপ দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৫’র ৩০ এপ্রিল মাটির গভীরে সুরক্ষিত স্বীয় কক্ষে প্রেমিকা ইভা ব্রাউনসহ হিটলার আত্মহত্যা করেছিল। ইভা ব্রাউন ছিল তার রক্ষিতা ও প্রেমিকা যাকে আত্মহত্যার কিছুক্ষণ পূর্বে বিয়ে করে স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে নিজ রিভলবারের গুলিতে হত্যা করে। হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দীর্ঘ ছয় বছরে দেড় কোটিরও বেশী নিরীহ গণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল শুধু সমগ্র বিশ্বকে তার পদানত করে রাখার হীন মানসে, কিন্তু তা এক বদ্ধ উম্মাদের কল্পনাপ্রসূত ছিল বলে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
১৯৩৯’র ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের নির্দেশে জার্মান নাজী বাহিনী কর্তৃক পোল্যান্ড দখলের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা আর ১৯৪৫’র ২ সেপ্টেম্বর মিত্র বাহিনীর আমেরিকা-বৃটেন-রাশিয়া-ফ্রান্স-এর কাছে হিটলারের নেতৃত্বাধীন অক্ষ শক্তির জার্মান-ইটালী-জাপান-এর চরম পতন ঘটে। এই যুদ্ধের শেষ লগ্নে ১৯৪৫-র ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোমিশমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকা আনবিক বোমা বর্ষণ করে।
এই যুদ্ধে বিকৃত মস্তিস্কের কল্পনাকে রূপ দেয়ার জন্য হিটলারের কুখ্যাত নাজী বাহিনী ঘূর্ণিঝড়-এ ঘূর্ণিঝড় বি নামক দ্রুত কার্যকর বিষাক্ত গ্যাস, গ্যাস চেম্বার, হত্যার যন্ত্র ও বাস, মানুষের হাঁড় গুড়ো করার যন্ত্র গুড়োকৃত হাঁড়সমূহকে সারে পরিণত করার যন্ত্র, মানুষের চামড়াকে শিল্প উৎপাদন কাজে ব্যবহারের যন্ত্র প্রভৃতি উদ্ভাবন করেছিল। আর এসব যন্ত্র দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দেড় কোটিরও বেশী মানবসন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করে এডলফ হিটলার বিশ্ব ইতিহাসে এক নরঘাতক, নরাধম ও বিকৃত মস্তিষ্কের হতভাগ্য ও ঘৃণিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে চিহ্নিত।
হিটলারের দুঃস্বপ্ন শূন্যে বিলীন হয়ে খাওয়ায় ১৯৪৫-র ৩০ এপ্রিল আত্মহত্যা করে নিজের বিচার নিজে করে গেলেও তার এগারজন ঘনিষ্ঠ সর্বোচ্চ যুদ্ধাপরাধী সহযোগীকে আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইব্যুনালে তথা নুরেমবার্গ বিচারের রায় মোতাবেক ১৯৪৬-র ১৬ অক্টোবরে মধ্যরাতে ফাঁসি দিয়ে পৃথিবীর বুক হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।
১৯৪৫-র ৮ আগস্ট লন্ডনে মিত্রশক্তি আমেরিকা-বৃটেন-ফ্রান্স রাশিয়ার রাষ্ট্র / সরকার প্রধানদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরাজিত অক্ষশক্তি তথা জার্মান-ইটালী-জাপান ও তাদের সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য পরাজিত প্রত্যেক দেশে মিত্রশক্তির যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য পরাজিত প্রত্যেক দেশে মিত্রশক্তির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পৃথক পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। গঠিত সর্বমোট দুই হাজার ট্রাইব্যুনালের মধ্যে ৯৫০টি আমেরিকান, ৬৫০টি বৃটিশ, ৯২টি রাশিয়ান, ২৭৫টি অস্ট্রেলিয়ান, ৩৩ ফ্রান্স ও পূর্ব ইউরোপীয়ানরা পরিচালনা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত হিটলারের সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত দুই হাজার মিলিটারী ট্রাইব্যুনালের মধ্যে জার্মানীর ‘নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল’ ছিল ইতিহাসের স্মারক ট্রাইব্যুনাল, যেখানে হিটলারের ঘনিষ্ঠতম সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সহযোগীদর বিচারের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এর বিচারকাজ ১৯৪৫-র ২০ নভেম্বর শুরু হয়ে ১৯৪৬-র ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ এবং ১৯৪৬ এর ১ অক্টোবর রায় দেয়া হয়।
ন্যুরেমবার্গ শহরের ‘স্পান্দু’তে বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্যতম যুদ্ধাপরাধীদেরকে আটক রাখার জন্য নির্মিত হয় অত্যন্ত সুরক্ষিত বিশেষ কারাগার এবং এই কারাগার হতে বিচারালয়ের কাঠগড়া পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল এক বিশেষ সুরঙ্গপথ যেই পথ দিয়ে তাদেরকে কাঠগড়া পর্যন্ত আনা-নেয়া হত।
বৃটিশ সুপ্রীম কোর্টের প্রবীণ বিচারক লর্ড জিওফ্রে লরেন্সের নেতৃত্বে গঠিত ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে আমেরিকার বিচারপতি ফ্রান্সিস ব্রিেডল ও জন জে. পার্কার, রাশিয়ার মে. জেনারেল আই.টি. নিকিট চেংকু ও লে. কর্ণেল এ. এফ. ভলকোভ, ফ্রান্সের বিচারপতি ডানোদিউ দ্য ডারতেজ ও রবার্ট ফ্যালকো এবং বৃটেনের বিচারপতি লর্ড উইলিয়াম নরম্যান বিকেট বিচারক হিসাবে মানব ইতিহাসের প্রথম যুগান্তকারী বিচারের মহান দায়িত্ব পালন করেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ উদ্বোধনকালে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের সভাপতি বিচারপতি লর্ড জিওফে লরেন্স বলেন ‘যেই বিচার কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হতে যাচ্ছে তা বিশ্বের আইন শাস্ত্রের এক অদ্বিতীয় ঘটনা। সমগ্র বিশ্বের কোটি কোটি মানব সন্তানের কাছে এ বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম, দৃষ্টান্তমূলক ও অনুকরণীয়। সুতরাং আইন এবং ন্যায় বিচারের মহান নীতিমালা অনুযায়ী ভীতি বা অনুকম্পামুক্ত হয়ে আমাদের প্রত্যেককে প্রত্যেকের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হবে’ (দ্য ন্যুরেমবার্গ এপিলোপগ/চতুর্থ অধ্যায়/প:-২২)।
এতে মার্কিন পক্ষে প্রধান কৌশলী আমেরিকার তৎকালীন প্রধান আইনজীবী রবার্ট জ্যাকসন আদালতে তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন “আপনাদের (যুদ্ধাপরাধীদের) অপরাধের সংগৃহীত প্রমাণাদিত নিদারুণ বিরক্তিকর হবে এবং বলতে পারেন আমরা আপনাদের চোখের ঘুম কেড়ে নিতে সক্ষম হব। জার্মানির নির্দয় আচরণের ফলে লাঞ্ছিত, শোকাহত, সশস্ত্র মানুষের কান্না সারা বিশ্বের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়ে ছিল। আমাদের প্রমাণাদি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। অভিযুক্তরা শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্বের কথা অস্বীকার করবেন, বলবেন আমরা জ্ঞাত ছিলাম না। আগামী প্রজন্ম এসব মানুষরূপী হিংস্র হায়েনাদের ঘৃণাতরে স্মরণ করবে” (দ্য সেকেন্ড গ্রেট ওয়ার/জে. হ্যামরটন/পৃ: ১০৭)।
অভিযুক্তদের অন্যতম নাজী বাহিনীর গেষ্টাপো অফিসার রুডলফ হোয়েসের জবাববন্দী থেকে আর্য জাতির প্রতীকবলে দাবীদার হিটলার কত হিংস্র ছিল তা প্রমাণিত হয়। হোয়েস ছিল আস্কুয়েজ মৃত্যু শিবিরের প্রধান।
প্রজ্বলিত ফার্নেসের মধ্যে জীবন্ত ছেলে-মেয়েদের নিক্ষেপ করে হত্যা করার তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নির্বিঘ্নে সে বলেছিল – “যেসব শিশু কাজ করতে অক্ষম হয়ে পরত তাদেরকে ফার্নেসের মধ্যে পুড়ে ভষ্ম করা হত। ১৯৪০-র মে হতে ১৯৪৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার নেতৃত্বাধীন আস্কুরেজ ক্যামোর চুল্লীতে ২৫ লাখ মানবসন্তানকে পুড়ে হত্যা করা হয়। এছাড়াও রোগ অনাহার নির্যাতনের ফলে ২৫ লাখ মৃত্যুবরণ করে।
বিচারের জন্য ৪০৩টি অধিবেশন বসেছিল, যার বিবরণের সারাংশ টাইপ করতে ১৬ হাজার পৃষ্ঠার কাগজ লেগেছিল। আদালতে ১১৬ জন সাক্ষীকে জেরা করা হয়, ১২৩ জন সাক্ষী লিখিত বিবরণ দিয়েছিল। ৫০ লক্ষ সীট কাগজ ব্যবহৃত হয়েছিল যার ওজন ছিল ২০০ টন, ২৭ হাজার মিটার সাউন্ড ফিল্ম ও ৭ হাজার ফটো প্লেট ব্যবহৃত, কৌশলীগণ ২৬০৩টি ও আগামী পক্ষে ২৭০০টি দলিল উত্থাপিত, ৩ লক্ষ হলফনাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। আসামীগণের স্ব স্ব পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের অধিকার ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কয়েকশত সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারকে এই ঐতিহাসিক বিচারকাজ প্রত্যক্ষ ও সংবাদ সংগ্রহ করা ও প্রেরণের অনুমতি দিয়েছিল।
১৯৪৬-র ১ অক্টোবর বেলা ২.৫০ মিনিটে নুরেমবার্গ বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়। এক শান্ত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে মানবতার নাভীমূলে ছুরিকাঘাতকারী নাজী নেতাদের ফাঁসি ও বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুন্যালের সভাপতি বিচারপতি জিওফে লরেন্স। মাত্র ৫০ মিনিটের মধ্যে ১২ ফাঁসি, ৩০ যাবজ্জীবন, ২০ বছরের মেয়াদে ২০ জন, ১ জনের ১৫ বছর এবং হিটলার পরবর্তী জার্মানীর মাত্র ২০ দিনের রাষ্ট্রপ্রধান কার্ল ডোয়েনটিজকে ১০ বছরের কারাদন্ড এবং ৩ জনকে খালাশের রায় ঘোষণা করে বিচারের সভাপতি ঐতিহাসিক ন্যুরেমবার্গ বিচারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হিটলারের ডেপুটি রুডলফ হেস স্পান্দু কারাগারের একক বাসিন্দা হিসাবে দীর্ঘ ৪৩ বছর কাটিয়ে ১৯৮৯-র ১০ মে মারা যায় আর ২০ দিনের রাষ্ট্রপতি কার্ল ডোয়েনটিজকে ৮০ বছর বয়সে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।
১৯৪৬-র ১৬ অক্টোবার আর যেন কোন এক অশুভলগ্নে বিশ্ব মানবতার কাঠগড়ায় নির্যাতিত-নিপীড়িত-নিগৃহীত-সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণের শিকার হয়ে আদম সন্তানদের ক্রন্দনরোল না উঠে সেই মহান অঙ্গীকারে নুরেমবার্গের স্পান্দু কারাগারের ফাঁসিমঞ্চে ১৬ অক্টোবর রাত ০.৫৫ মিনিটে হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জে. ভন রিবেনট্রফের গলায় ফাঁস দিয়ে নুরেমবার্গ ঐতিহাসিক বিচারের রায় কার্যকর পর্বে শুভসূচনা করে মার্কিন সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট জন উড। মাত্র ৯০ মিনিটের মধ্যে ১১ জনের ফাঁসির কাজ সম্পন্ন হয়। রিবেনটফ ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিল – ‘পাপ মুক্ত হলাম”।
ঐতিহাসিক নুরেমবার্গ বিচারের রায় ঘোষণার পর মুহুর্তে আদালত কক্ষ জনশূন্য হয়ে গেলে এক ফরাসী আলোকচিত্র শিল্পী নিথর নিস্তব্ধ জনশূন্য আদালত কক্ষের যেই ছবি তুলেছিল তার অপর পিঠে লিখেন “ইতিহাসের শিক্ষাকে মনে রেখো : ন্যুরেমবার্গকে ভুল না ১৬-১০-১৯৪৬” (স্পেশাল আনডিক্লেয়ার্ড ওয়াার/ট্রায়াল-রা/পৃ: ১০৭)।
লেখক : জীবন সদস্য-বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২-৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুব হাসান
পরবর্তী নিবন্ধচালের বাজার নিম্নমুখী