স্মরণে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুব হাসান

ফজল হোসেন | সোমবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

সাংস্কৃতিক জগতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাহবুব হাসান, শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। মাহবুব ভাই মূলত নাটক নিয়ে কাজ করলেও তাঁকে শুধু নাট্যব্যক্তিত্ব বললে ভুল হবে, তিনি ছিলেন বিশাল মাপের একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সংষ্কৃতির এমন কোনো শাখা ছিল না, যেখানে মাহবুব ভাই এর বিচরণ ছিল না। আমার বড় ভাই শহীদ প্রকৌশলী নুর হোসেনের সুবাদে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সাংষ্কৃতিক আয়োজন কিংবা চট্টগ্রামের আর এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ডা. কামাল এ খানের বাসায় সংগীতানুষ্ঠান বা উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে আমার যাওয়ার সুযোগ হতো। সেসব অনুষ্ঠানেই তাঁর সাথে পরিচয়। তখন আমি স্কুলে পড়ি, তাঁর সাথে কথা বলার সাহস পেতাম না। দূর থেকে তাঁর কর্মকাণ্ড অবলোকন করতাম। এছাড়া ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে দেখা হতো। স্বনামধন্য নাট্যব্যক্তিত্ব তথা সাংস্কৃতিক অংগনে সদাবিচরণকারী জনাব মাহবুব হাসান ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই রাজশাহী জেলার গোদাগারীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ মহসিন এবং মাতা লুৎফুননেসা খাতুন। তাঁর দাদা মুন্সী মেহেরউল্লাহ, আদি বাড়ি ছাতিয়ানতলা মেহেরউল্লাহনগর, চূড়ামনকাটি, যশোর জেলায়। তাঁর অভিনয় জীবনের শুরু ১৯৪৫ সালে বগুড়ায় ‘সিরাজের স্বপ্ন’ নাটকে মানিকচাঁদ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। তবে ছাত্রজীবনে অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি অভিনয় শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিরকুমার সভা’ নাটকে ‘বিপিন’-এর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রামের মঞ্চনাটকে আবির্ভূত হন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের হরিখোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বপ্রথম প্রগতিশীল সাহিত্য সম্মেলন। সেখানে তিনি অংশ নেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে তিনি নাট্য প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে প্রয়াস পান, যার নজির হিসাবে ১৯৫২ সালে কুমিল্লায়, ১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে, ১৯৫৬ সালে কাগমারী সম্মেলনে তাঁর অংশগ্রহণ। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে সর্বপ্রথম প্রচারিত জীবন্তিকা ‘বাপরে-বাপ’-এ তিনি অংশ নেন। মাহবুব হাসান জড়িত ছিলেন বেতারের শিল্পী নির্বাচন থেকে বেতার অনুষ্ঠানের সামগ্রিক পরিকল্পনার সাথে।
১৯৬৩ সালের পহেলা মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম বেতারের যাত্রা শুরু হলো কালুরঘাট (বহদ্দারহাট) প্রেরণ কেন্দ্র থেকে। আমি ছিলাম অন্যতম নিয়মিত শ্রোতা। চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত প্রথম নাটক অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদ রচিত এবং ডা. কামাল এ খান প্রযোজিত ‘সাগর থেকে এলাম’। নাটকের নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাহবুব হাসান এবং নায়িকা ইসমত জাকিয়া শেলী। একই বছর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রযোজিত একটি সিন্ধু লোককাহিনী অবলম্বনে নাটক ‘মারভী’র নায়ক চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন। প্রথিতযশা এই গুণী শিল্পী বেতার নাটকের পাশাপাশি মঞ্চেও ছিলেন সমভাবে বিরাজমান। মাঝে মধ্যে তিনি যাত্রাতেও অভিনয় করেছেন। ১৯৬৪ সালের ১৭ জানুয়ারী আমি চট্টগ্রাম বেতারে অনিয়মিত অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে যোগ দিলে তখন থেকে মাহবুব ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়। ১৯৬৪ সালের ২৭ অক্টোবর নবনির্মিত আগ্রাবাদ বেতার ভবন থেকে প্রচার কার্যক্রম শুরু হলে অনুষ্ঠানের পরিধিও বাড়তে থাকে, সেইসাথে বেতার আধিকারিক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের সাথে বাড়তে থাকে মাহবুব ভাইয়ের ব্যস্ততা, সবাই সব ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ নিত। তিনি অনুষ্ঠান নিয়ে যেমন নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তেমনি ছিলেন প্রকৌশল শাখার কাজে দক্ষ। তিনি বুথ অপারেশন থেকে শুরু করে রেকর্ডিং, ডাবিং, এডিটিং ইত্যাদি সব কাজ এত সুনিপুণভাবে করতেন যা হয়তো বা অনেক প্রকৌশলীর পক্ষেও সম্ভব হতো না। তাঁর কাছ থেকে এ ধরনের কিছু কিছু কাজ আগ্রহী অনেকেরই শেখার সুযোগ হয়েছিল। ৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে দেশের জরুরি অবস্থায় কিভাবে অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে হয় এসবও শিখেছিলাম তাঁর কাছে।
১৯৬৫ সালে তৎকালীন নিয়াজ স্টেডিয়ামে (বর্তমান এম এ আজিজ স্টেডিয়াম) মঞ্চস্থ যাত্রানুষ্ঠান ‘গাজী কালু চম্পাবতী’-তে তাঁর অভিনয় ছিল অনবদ্য। ১৯৬৬ ও ১৯৭৪ সালে বেতার ভবন প্রাঙ্গনে পল্লীগীতি উৎসব, ১৯৬৭ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘ছাত্র সপ্তাহ’, ১৯৭৫ সালে বেতার ভবন প্রাঙ্গণে আয়োজিত নাট্যোৎসবসহ আমৃত্যু চট্টগ্রাম বেতার আয়োজিত যে কোনো ধরনের বড় কিংবা ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজনে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করতেন। মঞ্চ তৈরি থেকে অনুষ্ঠান প্রচার, পরিকল্পনা ইত্যাদিতে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্যসাধারণ। সময়মতো সবাই খেতে বা বিশ্রাম নিতে চলে গেলেও মাহবুব ভাইকে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করতে দেখিনি। ১৯৬৭ সালের ৫ ও ৬ মার্চ নিয়াজ স্টেডিয়ামে আয়োজিত পল্লীগীতি উৎসবে ‘শাহ জামাল বদিউজ্জামান’ যাত্রানুষ্ঠানে তিনি নাম ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ঐ নাটকে তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত চিত্রনায়িকা আজমেরী জামান রেশমা এবং সম্রাট আকবরের ভূমিকায় ছিলেন খান আতাউর রহমান। বেতারের এসব কাজ ছাড়াও তিনি আরও অনেক গুণে গুণান্বিত ছিলেন, তাঁর এতসব গুণ দেখে আমি নিজেই অবাক হতাম। মাহবুব ভাইকে ফিল্ম-এর স্টিল ক্যামেরা ম্যান হিসেবেও কাজ করতে দেখেছি। জি আর জি প্রোডাকশন্স-এর ‘মেঘ ভাঙা রোদ’, ‘যে নদী মরুপথে’ সহ আরও অসংখ্য ছবির ফটোগ্রাফি তিনি করেছেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতাও ছিল অপরিসীম। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে বেতার-টিভি শিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে শিল্পীদের কল্যাণে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি সংস্থার প্রচার সম্পাদক হিসেবে তাঁর সান্নিধ্যে কাজ করে ধন্য হয়েছি। সব কাজে তাঁর নিষ্ঠা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। খাতুনগঞ্জে মল্লিক এন্ড কোম্পানিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় সেখানকার কাজে যাতে ফাঁকি দেয়া না হয়, সেজন্যে তিনি আমাকে সে অফিসে নিয়ে তাঁর সামনে বসিয়ে সংস্থার কাজ করাতেন এবং তিন তাঁর অফিসের কাজ করতেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মানুষটি ১৯৭২ সালে বেতারের নিজস্ব শিল্পী-নাট্য প্রযোজক হিসেবে ঢাকা বেতারের নাটক বিভাগে যোগ দেন এবং ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম বেতারে বদলী হয়ে আসেন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী সংস্থা গঠিত হলে সেখানেও তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর তিনি ঢাকা এবং খুলনা কেন্দ্রে অত্যন্ত সুনামের সাথে তাঁর শৈল্পিক নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে বেতার থেকে অবসর নিলেও সাংস্কৃতিক জগৎ তাঁকে ছাড়েনি। চট্টগ্রামের শিল্পকলা একাডেমি, ডি সি হিল, থিয়েটার ইনস্টিটিউট, এক কথায় সংষ্কৃতির সর্বক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ এবং অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের নাট্যজগত বা সাংস্কৃতিক জগতের পুরোধা মাহবুব হাসানকে এই জগতের অভিধান বললে ভুল হবে না। দৈনিক আজাদী’র ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ বইটিতে তাঁর লেখায় তিনি সে স্বাক্ষর রেখেছেন। ২০১৭ সালে আমার সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘চট্টগ্রাম বেতারের স্মৃতিময় দিনগুলো’ বইতে তাঁর মূল্যবান লেখা ছাপাতে না পারলেও তাঁর সংরক্ষিত বিশাল ছবির ভাণ্ডার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও অনুষ্ঠানের ছবি ছাপিয়ে আমার বইটি অন্তত পাঠকের কাছে সমৃদ্ধ হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। মাহবুব হাসানের সাংস্কৃতিক জগতের বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে এত অল্প পরিসরে লেখা আমার মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। সাংস্কৃতিক জগতের এই বিশাল মহীরুহ ২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে ইন্তেকাল করেন।
মুন্সী মেহেরউল্লার নাতি এবং পাকিস্তান আমলের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মহসিনের একমাত্র ছেলে মাহবুব হাসানের প্রতি পরিবারের আশা ছিল তিনিও তাঁর বাবার মতোই একজন উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু বিধি বাম, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের হাতছানি তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি, অথচ এত গুণে গুণান্বিত নির্লোভ, প্রচারবিমুখ, নিরহংকারী এই শিল্পী আমৃত্যু বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনকে ছেড়ে যেতে পারেননি। অর্ধশত বছরের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গণে যাঁর এত অবদান রয়েছে জীবিতাবস্থায় যোগ্য হয়েও তাঁর ভাগ্যে কোনো জাতীয় পুরস্কার জোটেনি। জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমানের সুযোগ্য কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের শিল্পীসমাজের পক্ষ থেকে আকুল আবেদন ও দাবী জানাচ্ছি গুণী শিল্পী মাহবুব হাসানকে অন্তত মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করেন।
লেখক : সাবেক মুখ্য উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার ঢাকা-চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশরতের ছড়া
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাসের শিক্ষাকে মনে রাখা : নুরেমবার্গকে ভোলা যাবে না