আড়াল

সৈয়দ মনজুর মোরশেদ | শুক্রবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

রাবেয়া হড় হড় করে বমি করল।

সে দুপুরবেলা ভাত খাওয়ার পর, কখনও সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শাহি দরজা খুলে ঢেইলায় দাঁড়িয়ে ওয়াক ওয়াক বমি করে। নাকমুখচোখ মুখের পানি একাকার হয়ে যায়। প্রথম প্রথম ছুটে গেলেও এখন আমি যাই না। কেমন জানি শরম করে। কান লাল হয়ে যায়। যতবারই বমি করছে একটা লজ্জা পেয়ে বসে। সে খুব জোরেসোরে গলায় আওয়াজ তুলে বমি করে। প্রথম প্রথম আশেপাশের ভাইয়ের বৌরা ছুটে আসতে দেখেছি, এখন তেমন একটা আসে না। শুধু ভাইঝি পারুল কখনও কখনও পাশে এসে দাঁড়ায়। বদনাটা বাড়িয়ে দেয়। কখনও জগের পানি ঢেলে দেয়। রাবেয়া মুখে আজলা ভরে পানি ছিটকায়। মুখ ধুয়ে সোফায় এসে বসে। জিরোয়, ফ্যানটা জোরে ছেড়ে দিয়ে পারুল বলে, ‘ফুফু তয়েলাটা দিয়া মুখটা ইছা ফেল। যাই, নাস্তা নিয়া আসি।’ সে হন হন করে হেঁটে ভেতরের ঘরে চলে যায়। হঠাৎ মাথার উপর ফ্যানটা ভোঁ ভোঁ শব্দে ঘুরছে। রাবেয়া সোফায় পা ছড়িয়ে কুশন একটাকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে আছে। কেমন চুপচাপ। কোন রা নেই। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। এই রাবেয়াকে তো চিনি না। অথচ একদিন সে দুপুরবেলা পালিয়ে গেছিল। কিস্‌সু নেয়নি। শুধু একটা এক পেড়ে শাড়ি পড়ে কলে বেরিয়েছিল। সবাই বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু সে ফেরেনি। সে রুজদির সাথে পালিয়ে গেছিল। অদ্ভুুত ব্যাপার। ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারেনি। কোনদিন ভাবেনি এমন একটা কান্ড রাবেয়া ঘটাতে পারে। রুজদি আমাদের বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে এসেছিল। তার বাড়ি বুড়িচং। সে আমাদের বাড়িতে লাগোয়া দু’তিন ঘরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াত। তাকে নিয়ে এসেছিল নুরুদ্দিন চাচা। তিনি তখন ওয়ার্ড মেম্বার। সেই যে দুপুরবেলা বেরিয়ে যান রাতদুটো অব্দি পাড়া, কখনো চৌমুহনী, কখনো বোর্ড অফিস, থানা, বক্করের দোকান, লোহা শমশুর বাজারের আস্তানায়, কখনো নিশিকান্ত দাশ বোর্ডিংয়ে রাতদিন উঠুক বৈঠকখানা ফিনা, কখনো কখনো শহর থেকে ভাড়া করে মেয়ে মানুষ নিয়ে এসে থানার ওসি সাহেব সহ সারারাত্রি দেশি দু’তিন বোতল দু’চুয়ানি বারোয়ারি গেলাসে ঢেলে কোয়েল পাখির ঠ্যাং সাবাড় করত। আর সকাল বেলা উঠে মোটর সাইকেলে করে গ্রামের এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে বেড়াত। কখনো কখনো বেড়ি বাঁধের বাঁশের বৈঠকখানায় গিয়ে বসে থাকত, কখন কে পিএমএর কন্ট্রাকটররা কাপ্তাই, লংগদু, বিলাইছড়ি থেকে বাঁশের চালি ভাসিয়ে এনে মরিয়মনগর সাপের ঘাটা যেখান থেকে শিলক বুহ্যচর হাট, কোদালা চা বাগান অনায়াসে বালির চরের উপর দিয়ে হেঁটে দু’কদম পা ফেলে কোসা নৌকা করে ওপারে চা বাগানের কুলি কামিনিগো লগে দেশি খেতে বাইকে করে ওসি সাহেবকে নিয়ে যেত, তখন দেশে আবার গ্রাম সরকারের রমরমা শাসন শালিশ বিচার চলছে। একদিকে কফিল উদ্দিন উকিলের বড় ভায়রা ভাই আবার শেখ আব্দুল আউয়ালের ছোট মেয়ের জামাই, দীর্ঘদিন স’ মিলে চোরাই সেগুন কাঠ চেরাই করে ফরেস্ট অফিসে রেঞ্জার সাহেবের বৌকে চল্লিশ হাজার টাকা দামের সিঙ্গার ফ্রিজ কিনে দিয়ে রাতের আঁধারে পিচপিচ সেগুন কাঠ বার করে থানার ওসি, সেকেণ্ড দারোগা, রেঞ্জ অফিসের কেয়ারটেকার, এসিএনকে মডার্ন ফার্নিচারের দোকানে আব্দুল হাকিম মিস্ত্রিও ফুলতোলা কারুকাজ, আর আবদুস সোবহান মিস্ত্রির চারু কাজ ফার্নিচারের নতুন নতুন ডিজাইন, কখনো রাজস্থানি, কখনো শিলং কখনো কাশ্মিরের মহারাজার পরিবারের ময়ূর সিংহাসন ডিজাইনের অবিকল অর্ডারগুলো একে একে মিলিটারির কর্ণেল সাহেব ফজলুল রহমানের শালির বিয়েতে তোফা পাঠাল, এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের শ্রমিক জোটের নেতা আবুল কাশেমের বড় মেয়ের বিয়ের জন্য বড় সড় ফার্নিচারের অর্ডার পেয়েছে, আগাম সাপ্লাই দিয়ে সব কাঁচা চকচকে কড়কড়া ব্যাংকের পাঁচশতি নোট ভেসে আসছে। আমাদের চোখের সামনে বলা নাই কওয়া নাই একদিন চাচা দুপুরবেলা প্রাইভেট কারে করে একজন কালো দশাসই মহিলা মেজিস্ট্রেটকে বাড়ি নিয়ে এলেন, সেদিন অনেক খানাপিনা হল, অনেক ঠাট্টা মশকরা হল, চাচার দুইবার বিয়া করবার বয়স আছে, কথাও কানে এল। কয়েকদিন দেখেছি রাবেয়া মিনু কেমন মুখ নিচু করে চলাচল করছে। সেদিন থেকে দেখেছি চাচির লগে কাকা কেমন জানি খিটিমিটি, জুগুর ফুগুর, নুনের দানি, পানের ঢালা, কখনো কখনো চিলুমচি লাথি মারছে, কখনো রাত দুপুরে গালি গালাজ কিল থাপ্পড় মারছে, আচ্ছা চাচার কি শরম নাই? কোন মানসম্মান নাই, আমরা সব চাচাত ভাই বোন বড় হচি একটা বিরাট পরিবার কোনদিন আলাদা হতে শিখিনি, কখনো মিনু, রাবেয়াকে পর ভাবিনি। বাবা সবসময় ওদেরও জন্য আগে ঈদের জামা কিনেছে, চুলের ফিতা, ক্লিপ, নেল পালিশ আর আলতা ওরা পেয়েছে রুনু, বিলকিস, তবাচ্চুম, চুন্নি কখনো আপত্তি করেনি, আগে সেলুনে ওদেরও চুল কেটেছে। যখন নানার বাড়ি গেছি সঙ্গে ওরাও গেছে। এদিকে শান্তিনিকেতনে মজুমদারখিল রথযাত্রার দিন অথবা সূর্যখোলা মেলা হত সেখানে দল বেঁধে গিয়েছি, নাগর দোলায় চড়েছি, কাকের ঠ্যাং, বোগার ঠ্যাং চুড়ার মোলা আর জলপাইয়ের আচার কিনে দিয়েছে। যখন কোরবানের দিন গরু জবাই করত তখন খুব হাউস করে জরির মালা পরিয়েছি। কোন পালা নাই, পার্বণ নাই যেখানে একসাথে যাইনি, ওরস আর মহরমের মেলায় দীঘির পাড়ে দল বেঁধে গিয়েছি। কখনো পর পরখ করিনি।

যেদিন চাচি রাবেয়া আর মিনুকে ফেলে বাপের বাড়ি চলে গেলেন সেদিন সারা বাড়ি নিঝুম দুপুর খাঁ খাঁ করে চাদ্দিক বিরান শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল।

সেদিন মা সবাইকে আম দিয়ে দুধভাত খাইয়েছিল। বাবা সারাটা বিকেল ভাইবোনদের নিয়ে লুডু খেলেছিলেন।

চাচা বোর্ড মিটিং শেষ করে রাত দুপুরে গোঁ গোঁ শব্দে স্কুটার থামিয়ে ‘মিনুর মা, মিনুর মা’ বলে হাঁক ছেড়েছিল, তখন মা সদর দরজা খুলে বলেছিল, ‘মিনুর বাপ ঘরে আস।’

কি হইছে? কন দেহি ভাবি’

কিছু হয় ই্‌, ভাত দিতাছি’

মিনুর মা কই?’

তখন বাবা ঘর থেকে বের হয়ে কড়া গলায় শুধু বললেন, ‘রাত অনেক হয়েছে। খেয়েদেয়ে ঘুমায়ে পড়।’

সকাল হলে খোকা যেয়ে নিয়ে আসবে’

নুরুদ্দিন চাচা কিছু বললেন না। সোজা স্কুটার ঠেলে ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা দরাম করে বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়লেন।

নুরুদ্দিন ভাই নুরুদ্দিন ভাই ভাত দিয়েছি। খাইতে আসেন।’

না, খামু না’

খাইবেন না?’

না, খাইয়া আইছি’

জানি এখন নুরুদ্দিন চাচা কিসু খাবেন না। কথা বলবেন না। ঘরে একলা বসে থাকবেন। ডাকাডাকি করলেও কোন সাড়া দেবেন না। গুম হইয়া বইসা থাকবেন। অনেকদিন ধইরা দেখছি চাচির উপর রাগ কইরা দোতলা ঘরে খিল এঁটে বসে থাকেন। দরজা খুলেন না। কোনো সাড়াশব্দ নাই। দু’তিন দিন কারো লগে কোনো বাও নাই। কেউ না জানুক আমি জানি এই কয়দিন চাচা কই যায় কই খায় কিতা করে? সব জানি। সকালবেলা বাইক নিয়া বাইর হইব। আর ফিরবে রাত কইরা। আর দোতলায় কোঠা ঘরে বসে কালো রঙের বোতলের ছিপি খুলবে।

॥ ২ ॥

এদিকে বাবা সোফায় বসে আছেন। টিভিতে খবর দেখছেন। সামনে পরীক্ষা। অনার্স পরীক্ষা বারবার পিছাচ্ছে। ছাত্ররা ধর্মঘট ডেকেছে। শিক্ষকরা কর্র্ম বিরতিতে গেছে। গত পরশু দ্রুত হল ত্যাগ করতে বলল। অনেকটা দলবদ্ধ হামলার সম্মুখ থেকে পালিয়েএসেছি। দা, কুড়াল, চাপাতি,এলজি আর লাল স্কুটার নিয়ে ক্যাম্পাসে শহরের বাইরে থেকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে যারা একাত্তরে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবিদের পিছমোড়া করে ধরে বেঁধে নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করেছিল তারা এখন যত্রতত্র ঘাপটি মেরে আছে। সেদিন দেখি কি আলাওল হলের হল প্রভোস্ট জমিউদ্দিন জোয়াদ্দার অজপাড়াগাঁ শান্তিনিকেতন বম্মোত্তর গ্রামে নুরুদ্দিন চাচার সঙ্গে নুরুল ইসলাম চেয়ারম্যান সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। বশির ভাই তখন এদিকে ঢাকা শহর ছেড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে কাজ করছিলেন। একদিন তিনি শুনলেন সুধাংশু দের দোকানে আগুন দেবে। নিখিল রঞ্জন চৌধুরি আরো খবর আনলেন পুরো বাজারে নুরুদ্দিন চাচা আগুন দেবে তারপর বম্মোত্তরের অবিনাশ চৌধুরি বাড়ির কালি বাড়ি আগুন লাগিয়ে দেবে। লোকজন যখন আগুন নেভাতে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করবে তখন দশ বারো জনের দল শান্তিনিকেতন উত্তর মাথার জয়শ্রি জুয়েলার্স লুট করবে। মিল এলাকার পার্টির গোপন শাখা বারোঘোনিয়ায় হাসান ভাইয়ের বাসায় সভা ডাকল। দুপুরে একসাথে ডাল ভাত আর পলই মাছ বেগুন ভাজি খেলাম। কতদিন পর ফাতেমা, জান্নাত, জয়ন্ত, বিভু সিংহ, রঞ্জনা, কালাম ভাই একে একে সবাই জড়ো হলাম। কতদিন পর দেখা। এলাকায় ফিরে গিয়ে যা যা করণীয় তা গ্রুপে জানানো হবে। সন্ধের আগে আগে নিখিল সহ বেরিয়ে পড়লাম। শান্তিনিকেতন বোর্ড অফিস পেরিয়ে মধুর দোকানে এসে পৌঁছেছি তখন একটা মশাল বের হল, মিছিলে সোৎসাহে গলা ফাটিয়ে বলছে; ‘আর ন খাইয়ুম আটার রুটি, মেলুন পিড়া পোড়াইদে; গঙ্গা জলত ভাসাই দে। আটার রুটি ন খাইয়ুম; নৌকা মার্কায় ভোট ন দিয়ুম, জয় বাংলা ন কইয়ুম।’ হঠাৎ চারিদিক নিঝুম হয়ে গেল। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে তক্ষকের ডাক শুনলাম। তুলা গাছ তলায় এসে সর্বনাশা পেঁচার ডাক শুনে অজানা কুহুকে বুকটা ভয়ে ভরে গেল।

যখন পৌঁছলাম বাড়িতে দেখি দরজা ধরে রাবেয়া দাঁড়িয়ে আছে। মিনু, ফরিদা পাশে দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।

কিছু বলবার আগে রাবেয়া বলল; রঞ্জু ভাই জোৎস্নায় চল বেরিয়ে আসি। একেবারে ফিরে এসে খাব। চল, চল, চল।

মিনু, ফরিদা বল্‌ল, দাদা ভাই আমরাও যাব।

চল

তোরা এগো, ব্যাগটা রেখে আসি।

কখন পেছন পেছন রাবেয়া এসে দাঁড়াল টের পেলাম না।

আজ রাত দুপুরে চরে তপন অপেক্ষা করবে। ওকে এই চিঠিটি দিও।’ বলে উঠোনে নেমে পড়ল। চমকে উঠলাম। এ কে? একে তো আগে দেখিনি।

দাদা এসো, দেরি করছো কেন?

রাবেয়া চিৎকার করে বলল, বড্ড দেরি করে।

মিনু, রাবেয়া, ফরিদা কল কল করে কথা বলছে। এক ফোঁটা বুঝবার জো নেই এরাবেয়াকে অনেকদিন থেকে চিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযৌবনের জয়গীতি ওড়ায় পতাকা
পরবর্তী নিবন্ধমেট্রোপলিটন হকার্স সমিতির বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা