আশার প্রদীপ হাতে

এমিলি মজুমদার | শনিবার , ১৭ এপ্রিল, ২০২১ at ৪:০৮ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারির কারণে গত বছর বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণকারীদের সমস্ত প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও মেলা করা যায়নি। এতে করে তাদের বড়রকমের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একটা বছর পার হয়ে আবার এসেছে ফিরে নববর্ষ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে হচ্ছিল ঈশ্বর বুঝি আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। নববর্ষ আর ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা দোকান সাজিয়ে বসেছিল, খদ্দেররাও মহামারির বিশ্বচিত্র ভুলে গিয়ে, ‘আমাদের হবে না’ ভেবে নিয়েই বুঝি মেতে উঠেছিলাম কেনাকাটায় নিজেদের সাজিয়ে তুলতে। অন্যদিকে বেশ কিছুদিন ধরে পর্যটন কেন্দ্রগুলো হয়ে উঠেছিল লোকে লোকারণ্য, দীর্ঘ সময় গৃহবন্দী থেকে হাপিয়ে উঠেছিলাম আমরা। তাই সংক্রমণ যখন একটু সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল, আমরা হয়ে উঠেছি সাহসী। বের হয়ে ছুটোছুটি করেছি বিভিন্ন জায়গায় প্রাণভরে শ্বাস নেবার জন্য। স্কুল-কলেজও খোলার তোড়জোড় চলছিল, বাচ্চারাও অধীর আগ্রহে দিন গুণছিল। আর ঠিক তখনই আসে প্রচণ্ড আরেক ধাক্কা। শনাক্তের হার, মৃতের হার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। দীর্ঘায়িত হচ্ছে শব মিছিল। এই ধাক্কা সামলাতে সামলাতে আমাদের যে আরোও কতজনকে হারাতে হবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লিস্টে যোগ হতে পারে আপনার কিংবা আমার নামও। যে পরিবার তাদের আপনজন হারিয়েছে, যে পরিবারকে এই করোনা ‘ছোবল খেতে হয়েছে, তারাই জানে এর দংশন যন্ত্রণা। আমরা যদি এখনও সচেতন না হই তাহলে সামনে বিভীষিকা, কেউ বাঁচাতে পারবে না। এখনই হাসপাতাগুলোতে কোন সিট নেই। জনগণের সচেতনতা ছাড়া এই করোনা’ সংক্রমণ থেকে মুক্তি নেই। সময়ই বলে দিবে সামনে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে, করোনা যে শুধুমাত্র জীবন কেড়ে নিচ্ছে তা নয়, জীবিকার ওপরও ফেলেছে ঘন কালো ছায়া। মহামারির কারণে নতুন কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থা আজ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মধ্যবিত্ত সমাজ কঠিন সময় পার করছে। হতাশা গ্রাস করছে বাচ্চা বুড়ো সবাইকে। সবচাইতে খারাপ অবস্থা বোধকরি আমাদের স্কুল কলেজে অধ্যয়নরত সন্তানদের, স্কুল কলেজ বন্ধুবান্ধব ছেড়ে সারাদিন গৃহে মুঠো বঙ হাতে, এই কি জীবন? আর কতদিন এমনভাবে কাটাতে হবে কে জানে! অনিশ্চয়তা গ্রাস করছে সবাইকে।
অথচ বৈশাখী উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। গানে গানে পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে বরণ করে নেয়া হয় নতুনকে। যতদিন যাচ্ছিল আমাদের উৎসবগুলো আরো রঙিন, আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠছিল।
এই বৈশাখেই ধনী-গরিব, বড়-ছোট সবাই যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেকে সাজিয়ে তুলি বৈশাখী উৎসবের রঙে রাঙানো নতুন পোশাকে। এই উৎসবকে ঘিরে ব্যস্ত সময় কাটে তাঁতী, কামার, কুমার, পোশাক শিল্পীদের। ব্যস্ত থাকেন সাংস্কৃতিক অঙ্গন, চারুকলা শিল্পীরা বর্ষবিদায় আর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজনে। ছোট-বড় হোটেল, রেস্তোরাঁয় বিশেষ বৈশাখী খাবারের আয়োজন থাকে। রাস্তাগুলো সেজে ওঠে রঙ-বেরঙের আলপনায়। শহর বন্দর গ্রামে ছোটবড় অনেক মেলা বসে। সারাবছর মেলাকে ঘিরে স্বপ্ন সাজায় মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই। এই মেলা থেকে অর্জিত অর্থের ওপরই নির্ভর করে এদের ভালো থাকা না থাকা। মাটির তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন নজরকাড়া তৈজসপত্র, শৌখিন গৃহসজ্জার দ্রব্যাদি, দা-বটি-হাতা-খুন্তি, ঝাড়ু, হস্তশিল্প, নজরকাড়া অলংকার, কাচের চুড়ি, কাঠের আসবাবপত্র, বিভিন্ন খাবারের দোকান ইত্যাদি আরোও অনেক কিছুর সমাহারে সমৃদ্ধ থাকে এই মেলাগুলো। টমটমি, ডুগডুগি, আর বাঁশি ইত্যাদির শব্দে ফিরে যাই ছোটবেলায়। এই সময়টাতে বাঙালি হয়ে উঠি মনে প্রাণে বাঙালি।
যাই হোক, আমরা সবাই প্রার্থনা করি ১৪২৮ যেন আমাদের সবার জন্য শুভবারতা নিয়ে আসে, সাথে সাথে আমাদের ঘুমিয়ে পড়া বিবেকেও জাগ্রত করে। আমাদের সবার চৈতন্যোদয় হোক। জানি সবাই ঘরে বসে থাকলে করোনা সংক্রমণ কমে যাবে, কিন্তু ক্ষুধার সংক্রমণ গ্রাস করবে। বসে থাকলে চলবে কি করে? ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে তো বাইরে যেতেই হবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া আমাদের দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই এই করোনা থেকে মুক্তি পাবার। এই কথাটা যত তাড়াতাড়ি আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া যাবে আর আমাদের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়ে এই ব্যবস্থায় আমরা একশ ভাগ অভ্যস্ত হয়ে উঠবো, ততই মঙ্গল। স্বাস্থ্যবিধি যে শুধুমাত্র করোনা সংক্রমণ ঠেকাবে তা কিন্তু নয়, কষ্ট করে আমরা যদি একবার এতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারি, অনেক রোগ সংক্রমণের হাত থেকে আমরা রেহাই পাবো। মাস্ক আমাদের পলিউশন /বায়ুবাহিত রোগ থেকে মুক্তি দেবে, আর বারবার হাত ধোয়া খুব ভালো একটা অভ্যাস, যা আমাদের অনেক রোগের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে। ভিড় কমবে প্যাথলজি ল্যাবগুলোতে তথা ডাক্তারের চেম্বার আর হাসপাতালগুলোতে। আশার প্রদীপ হাতে শুভ কামনা নিয়ে স্বাগত জানাই ১৪২৮। শুভ-নববর্ষ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুজিবনগর সরকার ও বঙ্গবন্ধুর ৪ বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা
পরবর্তী নিবন্ধরমজানে ডায়াবেটিক রোগীর ব্যবস্থাপনা