প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ আল্লাহর ঘরে যান পবিত্র ওমরাহ্ পালন করতে–বিশেষ করে রমজানের শেষ ১৫ দিনে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। হজ্ব এজেন্সিগুলোর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কর্মীদের চোখে ঘুম নেই। ওমরাহ্ ভিসার জন্য এক মহাপ্রতিযোগিতা চলমান থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু মুনাফালোভী হজ্ব কাফেলা অতিরিক্ত প্যাকেজ দাবি করে বসেন। ফলশ্রুতিতে, অনেক আল্লাহর বান্দা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওমরাহ্ পালন করতে পারেন না। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসেন। বিশেষত রমজানের শেষ ১৫ দিনে মক্কা–মদিনার ঘর ভাড়া থাকে অত্যন্ত চড়া। একই রুমে গাদাগাদি করে ৬/৭ জন থাকতে হয়। বিমান ভাড়া বেড়ে যায় স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। অনেক মুনাফালোভী হজ্ব কাফেলা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ওমরাহ্ হাজীদেরকে বিভিন্ন প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে আল্লাহর ঘরে নিয়ে যান। আর হারাম শরীফ থেকে অন্তত ২/৩ কিলোমিটার দূরে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়– যা নিতান্তই অমানবিক। ফলে তাদেরকে ঘন্টাখানেকের মতন হেঁটে হেঁটে হারাম শরীফের দিকে আসতে হয় আর বিপত্তি ঘটে এখানেই–যথাসময়ে জামাতে নামাজ ধরতে পারেন না। হারাম শরীফের ভেতরে ঢুকা যায় না। সৌদি পুলিশরা অনেক দূরে ব্যারিকেড দিয়ে দেন। নিরীহ ওমরাহ্ হাজীগণ এতে নিদারুণ কষ্টের মুখোমুখি হন। তবে সাধুবাদ জানাই তাদেরকে–কিছু দুনিয়াবিমূখ হজ্ব কাফেলা রয়েছে, যারা কমিটমেন্ট রক্ষা করেন, ওমরাহ্ হাজীদেরকে কষ্ট দেয় না। মক্কা–মদিনার ঐতিহ্যমন্ডিত স্থানসমূহ পরিদর্শনের সুযোগ করে দেন। রিয়াজুল জান্নাতে দু’রাকাত নামাজ পড়ার দূর্লভ সুযোগ করে দেন। আর কিছু কিছু কাফেলা হাজীদেরকে অবর্ণনীয় কষ্টের মুখোমুখি ফেলে দেন। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সাথে বলতে চাই–অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখেই হজ্ব কাফেলা নির্বাচন করবেন আপনারা–বেদআত এবং শির্কমুক্ত কাফেলার সন্ধান করবেন। কিছু কিছু নিদর্শন, যেখানে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)এর স্মৃতি জড়িত রয়েছে সে স্থানগুলো পর্যবেক্ষণ বা দেখার সুযোগ যারা করে দেন এবং নিদেনপক্ষে খাওয়া–দাওয়ার বিষয়টিও যারা মাথায় রাখেন সেই ধরনের কাফেলা নির্বাচন করলে আর কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে না। অনেকেই সরাসরি মদিনা গমন করেন–সেখানে ৩/৪ দিন অবস্থান করেন। ইহ্রাম বেঁধে ওমরাহ্ এর উদ্দেশ্যে মক্কায় যাত্রা শুরু করেন এবং ওমরাহ্র নিয়ত করতে হয় মদিনা থেকে অনতিদূরে যুলহুলাইফা নামক মিকাত মসজিদে আর এটি কষ্টসাধ্য ঠিকানা–যেখানে অনেক পুরানো হাজীও দিক্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েন। হাজার হাজার গাড়ীর ভিড়ে কাফেলার গাড়ী খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন সমীক্ষা। এবারে আমাদের কাফেলার একজন সু–পরিচিত মানবাধিকার কর্মী হঠাৎ করে হারিয়ে গেলেন আমরা সবাই এতে উদ্বিগ্ন্ন হয়ে পড়লাম। ঘন্টাখানেকের মতন উনাকে আমরা সবাই খুঁজে–পাওয়া গেল না। পরে আমরা মক্কা পৌঁছানোর আগেই অন্য বাহনে চড়ে উনি মক্কায় চলে গেলেন। আর কাফেলা সদস্যদের এ বিষয়টি অত্যন্ত গভীরভাবে চিন্তা করা বাঞ্চনীয়। মূল কথাটায় আসি, সৌদি–আরবে ইতেকাফ এর জন্য রেজিস্ট্রেশন খুব একটা প্রদান করা হয় না। অনেক কষ্ট সয়ে নির্ধারিত এ্যাপস এর মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করা যেন সোনার হরিণ পাওয়া। ইতেকাফ এর নিবন্ধন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। স্থানীয় সৌদিরা কিংবা সুপারিশপ্রাপ্ত ভিনদেশী নাগরিকরা বিষ্ময়করভাবে এ্যাপস এর মাধ্যমে নিবন্ধন সেরে ফেলেন। নিবন্ধন করে ইতেকাফ এর সুযোগ পাওয়া ওমরাহ্ হাজীগণ কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন। যেমন–যখন তখন হারাম শরীফ থেকে বের হওয়া এবং ঢুকা। নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশরা তাদেরকে অনায়াসে ছেড়ে দেয়। বিপত্তি ঘটে অনিবন্ধনকৃত ওমরাহ্ হাজীদের ক্ষেত্রে। তাদের কষ্টের কোন শেষ নেই। ২০ রমজানে আছরের নামাজ শেষে তড়িঘড়ি করে বাক্স–পেটরা নিয়ে হারাম শরীফের দিকে ঢুকতে হয় এবং যে কোন সুবিধাজনক জায়গায় বসে যেতে হয়। গত বছর পুলিশের কড়াকড়ি ছিল একটু বেশি। এবার সেটি তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। গত বছর অন্তত ৪ বার আমাদেরকে পুলিশ সরিয়ে দিয়েছিল, বার বার স্থান পরিবর্তন করতে করতে যেন হতাশ হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে যাই এবং ইতেকাফ কনটিনিউ করি। মহান আরশের মালিকের বিশেষ রহমতে এবার নতুন হারাম শরীফে আবদুল্লাহ এক্সটেনশন বিল্ডিং এর দ্বিতীয় তলার একটি খালি জায়গায় বসে পড়ি–পাশাপাশি অনেক বাংলাদেশীরাও বসেছেন। পাশে ছিল কিছু পাকিস্তানি, উজবেকিস্তান ও অন্যান্য দেশের নাগরিক। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সীমিত থাকার কারণে প্রথম দিন থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। শ্বাস–প্রশ্বাস এর সংক্রমণে প্রচন্ড কষ্ট হয়েছে এবার। নির্ঘুম থাকার কারণে শরীরটা অলস হয়ে পড়েছিল। সারারাত ঘুমানোর কোন সুযোগ নেই। মাগরিবের পর পর তারাবি, তারাবির পর পর কেয়ামুল লাইল, এরপরেই তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ। এখানে দু’হারাম শরীফেই ১০ রাকাত নামাজ পড়া হয়, যেটি করোনাকাল থেকে শুরু হয়েছে। দেখা গেছে, ইতেকাফকারীরা ফজরের নামাজের পর থেকে সকাল ১১ টা পর্যন্ত নাক ঢেকে ঘুমান–যেটা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। আর ওদিকে সকাল ৮ টার মধ্যেই শৌচাগারে যেতে হয়– না হলে ৮ টার পর পর ভীড় বেড়ে যায়। অনেকে দুপুরে ঘুমায়, তারাবীর পর ঘুমায়, কেয়ামুল লাইলের পরও ঘুমায়। অনেক ইতেকাফকারীকে দেখা গেছে, বিভিন্ন আড্ডাবাজি, কিংবা ফেইসবুক, কিংবা গল্পগুজবে মেতে উঠে–যেটা আমার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। অনেকে আবার নির্ধারিত সালাত ছাড়া আল্লাহর কোরআন তেলওয়াতের ধারে কাছেও থাকেনি। আলহামদুলিল্লাহ্– পুরো কোরআন শরীফ অর্থসহ পড়ার সুযোগটা মহান রাব্বুল আ’লামিন করে দিয়েছেন এবার–যেটা অন্যান্য বছর সম্ভব হয়ে উঠেনি। যারা ইতেকাফ করতে ইচ্ছুক–রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে গেলে সেটাই সবচেয়ে ভাল আর না হলে অনিবন্ধনকৃতভাবে গিয়ে ভোগান্তির পর ভোগান্তির স্বীকার হয়ে ইতেকাফ চালিয়ে যেতে হবে। এবার দু’হারাম শরীফের প্রধান শায়খ আবদুর রহমান আল্ সুদাইস তার দারাজ কন্ঠে কোরআনের আয়াত পাঠ করেছিলেন–সেটি তারাবীহ কিংবা কেয়ামুল লাইল কিংবা মুনাজাত সবটুকুতেই তাঁর পরিচিত কন্ঠ ছিল লক্ষণীয়। কোরআনের আয়াত তেলওয়াতের সাথে সাথে আবেগপ্রবণ হয়ে ক্রন্দন করা যেন স্বাভাবিক তাঁর জন্য। নির্মম সত্য কথা যেটা মনের গভীরে ভাসছে যেটা– সেটা হল: তাঁর কাঁদার কারণে অনেক মুসল্লির কান্না আসেনি। কারণ: যেই রাসূল (সাঃ) আবাদ করেছিলেন এই মরু প্রান্তর, তাঁর পবিত্র রক্তের ছোঁয়ায় বিকশিত হয়েছিল মরুর আকাশ–বাতাস, প্রতিটি কদমে যাঁর রক্ত–ঘাম যেন এখনো উঁকি দিচ্ছে, সেই রাসূল (সাঃ) এর দেশে আজ আল্লাহর বিধানসমূহ পদে পদে লংঘিত হচ্ছে।
লাখ লাখ মুসল্লির ওমরাহ্ পালনের জন্য মক্কা গমন কোন বিষয় নয়। আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে কি আমরা মেনে নিয়েছি হারাম শরীফের বাইরে? লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (হে আল্লাহ, আমি হাজির–আমি হাজির), লাব্বাইক লা শারীকা লাকা লাব্বাইক (হে মাবুদ তোমার কোন শরীক নেই), ইন্নাল হামদা (সমস্ত প্রশংসা তোমার), ওয়ান্নিয়্মাতা (সমস্ত নেয়ামত তোমার), লাকা ওয়াল মূলক (সমস্ত সাম্রাজ্য তোমার), লা শারিকা লাক্ (তোমার কোন শরীক নেই)- যে শ্লোগানটি আল্লাহর কাবা ঘরের দিকে যেতে যেতে বলছি– ওমরাহ্ পালন শেষে, মাথা মুন্ডন শেষে হারাম শরীফের চত্বর থেকে বেরিয়ে সেই শ্লোগানটিকে অস্বীকার করছি। কিভাবে? বিশেষত বাংলাদেশীরাই বলি, জনগণই ক্ষমতার উৎস। অথচ সমস্ত ক্ষমতার মালিক মহান রাব্বুল আ’লামিন, ‘আসমান জমিনের সমুদয় শক্তি একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য’– সূরা বাকারা– ১৬৫। এবার বলুন–এই ওমরাহ্ আমাদের জন্য কি কোন কল্যাণ বয়ে আনবে? আমি ঘোষণা দিয়েছি এক, নিজের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করছি অন্য এক। আর এই দ্বি–চারিতার জন্যেই জাহান্নামের আগুনে আঁধার প্রকোষ্ঠে যুগ যুগ ধরে জ্বলতে হবে বনি আদমদের, ওমরাহ্ পালনকারীদের। সবাইকে বুঝার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল