আমি আমার পাঠকদের নিরাশ না করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি: হারুকি মুরাকামি

ভাষান্তর: মাহমুদ আলম সৈকত | শুক্রবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

কাফকা অন দ্য শোর ২০০২ সালে জাপানে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এর ইংরেজি অনুবাদ ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশের পর বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, এখন আপনার কী মনে হয়, মানে ভাবনার জায়গায়?

হারুকি মুরাকামি: যেহেতু আমার বেশিরভাগ উপন্যাস সমকালীন, দৈনিক সংবাদ বা খবরাখবরের বিষয়গুলির সাথে গভীরভাবে যুক্ত নয়, তাই আমি মনে করি না যে ইংরেজিতে প্রকাশের আগে দুই বা তিন বছরের ব্যবধানে তেমন কোনো সমস্যা আছে। একটি উপন্যাস অনুবাদ করতে সময় লাগে, তাই সঙ্গীত বা চলচ্চিত্রের চেয়েও সাহিত্য বেশি ধীরে বিদেশে বা ভিনভাষায় অনুবাদ করা হয়। আমি সবসময়ই এমন শক্তিশালী কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছি যা এধরণের সময়ের ব্যবধান অতিক্রম করতে পারবে। আমি আমার উপন্যাসগুলিতে যা লিখতে চাই তা হল মানুষের আবেগের মধ্যে পাওয়া সর্বজনীন দৃশ্যপট, একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া যা সময় এবং দূরত্বের বাইরে বিদ্যমান।

কাফকার প্রস্থান ঘটছে, আপনার আগের বইয়ে এমনটাই দেখা গেছে। গল্পের কথক হিসাবে পনের বছর বয়সী একজনকে হাজির করার, এবং নাম পুরুষের মাধ্যমে কথা বলার ধরন অবশ্যই আপনার উপন্যাসে নতুন সংযোজন। এই বইটি লেখার জন্য এরকম ভিন্ন পদ্ধতির চেষ্টাটি কি আপনার ইচ্ছাকৃত?

হারুকি মুরাকামি: এখন পর্যন্ত আমার বেশিরভাগ কথাসাহিত্য উত্তম পুরুষে বর্ণনা করা যা একজন নায়ক (এবং কথক) যার বয়স বিশ বা ত্রিশের কোঠায়। যাই হোক, কয়েক বছর আগে, আমি বিষয়গুলোকে একটু ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা শুরু করি। ভিন্ন কণ্ঠে, ভিন্ন দৃষ্টিকোণে লিখতে শুরু করেছি। আফটার দ্য কোয়্যাক ছোটগল্পের সংকলনটিও পুরোটাই নাম পুরুষে। লেখার এই শৈলীটাতে এমন কিছু আছে যা আমার জন্য উপযুক্ত। সম্ভবত ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপট, বয়স এবং ব্যক্তিত্বের সকল ধরণের মানুষ সম্পর্কে বিস্তৃত দৃষ্টিকোণ থেকে লেখার ইচ্ছা আমার ভেতর থেকে জেগে উঠেছে। সেই অর্থে, আমার মনে হয় যে আন্ডারগ্রাউন্ড এবং আফটার দ্য কোয়্যাক দুটোই আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল। যাই হোক, আমি যখনই একটি নতুন উপন্যাস লিখি তার আগে একটি থিম বা বিষয় বা প্রসঙ্গ নির্ধারণ করি এবং নতুনভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করি।

জাপানি সংস্কৃতির বাতাবরণে বড় হওয়া একজন মানুষ স্বীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে পাশ্চাত্য থেকে আসা সঙ্গীত এবং লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই প্রভাবকের বিষয়ে আপনি যা বলতে চান

হারুকি মুরাকামি: আমি মনে করি প্রশ্নটা এইরকম হলো যে একজন ইংরেজকে ধরা যাক এরিক ক্ল্যাপটনকে জিজ্ঞেস করার মতো, কেন সে ব্লুজের প্রতি এতটা নিমজ্জমান, কীসের এত টান? আপনি যদি ক্ল্যাপটনকে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেন, আমার ধারণা সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবে, ঠিক জানি না কীসের টান!

আপনার উপন্যাস নরওয়েজিয়ান উড নিয়ে জাপানিদের প্রতিক্রিয়া এতটাই অপ্রতিরোধ্য আর অবিমৃষ্যকারী ছিল যে কয়েক বছরের জন্য দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রচারবিমুখ মানুষ হিসাবে আপনি অনেক সামাজিকতা এড়িয়েও চলেন। আপনার গল্পের বা উপন্যাসের পাঠকদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবার জন্য আপনি ঠিক কীভাবে তৈরি হন?

হারুকি মুরাকামি: আমার গল্পউপন্যাসের পাঠকের জন্য আমি কেবল আকর্ষণীয় এবং মর্মস্পর্শীভাবে লেখার চেষ্টা করি। যে বইটা পড়ে একজন পাঠক আমার পরবর্তী বইটি কেনার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং আমি আমার পাঠকদের নিরাশ না করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। আমি পঁচিশ বছর ধরে কথাসাহিত্যের দুনিয়ায় লিখছি এবং লেখার বাইরে কথা বলার মতো তেমন কিছুই করিনি। সৌভাগ্যক্রমে আমার পাঠকের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আমি পাঠক খুঁজে বেড়াই না, বরং বই নিজেই পাঠকদের খুঁজে বেড়ায়। বিষয়টা আমার কাছে এইরকম মামুলিই।

সত্যি কথা বলতে, আমি মানুষের সামনে উপস্থিত হতে বিশেষ পছন্দ করি না। আর পাঁচদশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই। প্রতিদিন আমি মেট্রো রেলে যাতায়াত করি, বাসে চড়ি, কেনাকাটা করতে যাই, হাঁটতে বের হই। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা আমি ঘৃণা করি তা হল আমার কাছ থেকে এই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া।

প্রথম দিককার বেশকিছু বই, আপনার ননফিকশন রচনাগুলোর কথা বলছি, কখনও ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি। আমার মনে হয়, পশ্চিমে আমরা আপনার যে রচনাগুলো পড়তে পাই সেসবে স্বীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারাটা আপনি বেশ উপভোগ করেন। পাশ্চাত্যের জন্য কোন ধরনের ননফিকশনের বিষয় নিয়ে আপনি কাজ করতে চান এবং পাঠক কি সেসব পড়ার সুযোগ পাবে?

হারুকি মুরাকামি: জাপানিতে বেশকিছু প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ বিষয়ক গদ্যের বই প্রকাশ করেছি, কিন্তু আমার কথাসাহিত্যের বিপরীতে আমি মনে করি না যে এসবের অনুবাদ হওয়ার খুব একটা প্রয়োজন আছে। এই বইগুলির বেশিরভাগই হালকাচটুল বিনোদন, এমনকি আন্ডারগ্রাউন্ড এবং এর এলোমেলো ছড়ানোছিটানো বিষয়বস্তু ও সমস্ত ব্যতিক্রমসহ। এই বইগুলি দৈনন্দিন, রোজকার স্থানীয় বিষয়আশয়ের সাথে সর্ম্পকিত, প্রায়শই যেখানে এন্তার শব্দের খেলা আছে, ফলে আমার সন্দেহ হয় যে এমন অনেক বিষয় থেকে থাকবে যা ভিনভাষী পাঠকদের অনুসরণ করতে খানিকটা মুশকিল হবে৷ একটা কথা আমি বলতে পারি যে একজন লেখক হিসেবে আমার কাছ থেকে সবচেয়ে ভালো কিছু যদি কোনো পাঠক পেতে চান তাহলে সেটা আমার উপন্যাসে পাওয়া যাবে।

ওয়াটারস্টোনের গ্রন্থ বিপনীর স্বত্বাধিকারীগণ আপনার উপন্যাস দ্য উইন্ডআপ বার্ড ক্রনিকলকে সর্বকালের সেরা বিশটি বইয়ের একটি হিসাবে রায় দিয়েছে৷ আপনার লেখক জীবনের জন্য এই বইটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

হারুকি মুরাকামি: লেখালেখির জীবনে দ্য উইন্ডআপ বার্ড ক্রনিকল অবশ্যই আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসগুলির মধ্যে একটি। আমি নিশ্চিত যে একজন ঔপন্যাসিক হিসাবে আমার গুরুত্ব ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত যদি বইটি প্রকাশিত না হত। এই উপন্যাসটি শেষ করতে প্রচুর সময় এবং প্রচেষ্টা লেগেছে এবং আমার দৃঢ় ধারণা যে এই প্রক্রিয়াটি আমাকে একজন ঔপন্যাসিক হিসাবে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করেছে।

আপনার প্রথম দিককার কয়েকটি উপন্যাস এবং গল্প নিয়ে আশির দশকে কয়েকটি চলচ্চিত্র হয়েছিল। বেশ দীর্ঘ সময় পরে আপনি আরও কিছু অভিযোজনের অনুমতি দিয়েছেন যার মধ্যে মঞ্চ পরিবেশনা দ্য এলিফ্যান্ট ভ্যানিশ এবং চলচ্চিত্র টনি তাকিতানি। পরিচালকদ্বয়ের অভিযোজন নিয়ে আপনি কি খুশি এবং আমরা কি শীঘ্রই বড় পর্দায় মুরাকামির উপন্যাস চলচ্চিত্রাকারে দেখার আশা করতে পারি?

হারুকি মুরাকামি: আমি আমার গল্পউপন্যাসের চলচ্চিত্র এবং মঞ্চায়িত রূপ স্বচক্ষে না দেখার জন্য একটা কড়া নিয়ম ঠিক করেছি। আমি যখন একটা গল্প লিখি, তখন আমি আমার মনের ভেতর সেটার চলচ্চিত্রায়ন বা নাটকের মতো করেই দেখতে পাই, সেভাবেই তৈরি হয় এবং সেই কাজটি অন্য কারোর হাতে, অন্য একটি রূপে দেখতে আমার ভালো লাগে না। আমার প্রিয়জনরা বলে থাকেন, এই অভিযোজনগুলা খুব ভালোভাবে করা হয়েছে; উদাহরণস্বরূপ, মঞ্চের জন্য সাইমন ম্যাকবার্নির দ্য এলিফ্যান্ট ভ্যানিশএর অভিযোজন বেশ চমৎকার ছিল। কিন্তু আমি নিজের তৈরি ইমেজটাই মনের মধ্যে অক্ষুন্ন রাখতে পছন্দ করি।

আমার গল্পউপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র বা নাটক বানানোর বিষয়টি বারবারই আলোচনায় আসছে, বর্তমানে কিছু কিছু কাজ এগুচ্ছে এবং কয়েকটির ব্যাপারে আমরা আলোচনার প্রক্রিয়ায় আছি। তবুও, আমি মনে করি আমার উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মাণ করা অবশ্যই একটি কঠিন কাজ, এবং যা খুব সহজে বাস্তবায়িত হয়ে যাবে এমনটা দেখি না। সত্যি বলতে, আমি আমার কাজকে চলচ্চিত্রে পরিণত করার জন্য মোটেও উৎসাহী নই। তবে হ্যাঁ, উডি অ্যালেন যদি আফটার দ্য কোয়্যাক পরিচালনা করেন বা ডেভিড লিঞ্চ যদি দ্য উইন্ডআপ বার্ড ক্রনিকলএর একটি সংস্করণ তৈরি করেন, তাহলে আমি সেগুলি দেখতে চাই।

সমকালীন সংস্কৃতির কোন উপাদানসমূহ আজকাল আপনাকে আন্দোলিত করে? কি শুনছেন বা পড়ছেন?

হারুকি মুরাকামি: সমকালীন সংস্কৃতি আমাকে খুব বেশি আকর্ষণ করে বলে আমার মনে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি পুরানো অ্যানালগ রেকর্ডগুলিতে পুরানো গান শুনছি এবং অতীতে যে বইগুলি পড়েছি সেসবই পুনরায় পড়ছি। ইচ্ছাকৃতভাবে নতুন জিনিস এড়াতে চেষ্টা করছি বিষয়টি এমনও না; তবে এটা ঠিক যে আমি আমার জীবনে সবসময় নতুন জিনিসের প্রতি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। আমি সবসময় খুঁজতে খুঁজতে পুরানো কিছুতে পৌঁছে যাই, যদিও, আমার কাছে সবসময় রেড হট চিলি পেপারস, রায়ান অ্যাডামস (ব্রায়ান নয় কিন্তু) এবং আর..এমএর সর্বশেষ এলবামের সংগ্রহ থাকে। গাড়ির স্টেরিওতে তখনও থাকে, যখন ভ্রমণ করি তখন আমার সাথে এলমোর লিওনার্দের উপন্যাস থাকা চাই।

সবশেষে, আগামী কয়েক বছরে মুরাকামির কলম থেকে ইংরেজি পাঠকরা কী আশা করতে পারেন?

হারুকি মুরাকমি: জাপানে আফটার ডার্ক নামে একটি ছোট উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাসটি শুরু থেকে শেষ অবধি নাম পুরুষে লেখা, বর্তমানকালে, টোকিও শহরের কেন্দ্রভাগে এক রাতে এক ঊনিশ বছর বয়সী মেয়েকে অনুসরণ করেছে এর গল্প। আমার স্ত্রী আমাকে বলেছে যে ইতোমধ্যে আমি যা লিখেছি সেসবের মধ্যে এই উপন্যাসটি তার বিশেষ পছন্দের, কিন্তু আমি জানি না যে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া তার এই মতামতের সাথে কতটা সাজুয্য হবে। আগামী বসন্তে আমি দ্য স্ট্রেঞ্জ লাইব্রেরি শিরোনামে একটি শিশুদের বইও বের করব। দ্য শীপ ম্যান গল্পটা এই বইয়ের মধ্যে সংকলিত থাকবে। গল্পটি এক ছেলেকে ঘিরে যে লাইব্রেরিতে বই নিতে আসে এবং লাইব্রেরির বেসমেন্টে বসবাসকারী এক অদ্ভুতুড়ে বৃদ্ধের হাতে বন্দী হয়, ইলাস্ট্রেটেড বই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষাবিজ্ঞানী মনসুর মুসা
পরবর্তী নিবন্ধচুয়েটে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বিষয়ে অংশীজনদের সাথে সভা