আমার ভেতরে কেউ কাঁদছে

আরিফুল হাসান | শুক্রবার , ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ at ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

বক্সকালভার্ট রোডের অফিসে সে প্রতিদিন কেনো আসে, আমি প্রতিদিন কেনো যাই জানি না। শুধু জানি, ইদানিং তাকে দেখতেই আমার মন টানে বেশি। এই অফিস, এই জীবিকা ইদানিং কেমন যেনো ফ্যাকাসে লাগে। তার কাছেও লাগে হয়তো। তাই তাড়াতাড়িই তাকে অফিসে দেখা দেখা যায়। আমি অবশ্য তার আগেই গিয়ে অপেক্ষা করি। হ্যাঁ, কখনো কখনো আমারও দেরি হয়ে যায়। যখন তার কথা ভাবি, তার জন্য রাত জাগি, পরদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়, কিংবা ঘুমালামই না সজাগ টকটকে চোখে চলে গেলাম অফিসে। এসব ভাবতে ভাবতে অবশ্য তার আগেই আমি অফিসে চলে আসি। সেও আসে অব্যবহিত পরেই। এসব আসাআসির মাঝে আমরা কোনো গুঢ় অর্থ খুঁজছি নিশ্চই, কিন্তু কী? তা কি পেতে পারি?

সে হয়তো পারে। সে আমাকে চোরাচোখে চায়, আমিও তার চোখে চোখ রাখি কখনো কখনো। সরু প্যাসেজটা বইয়ে ঠাসা, দু’জন লোক আসার সময় একজনকে ভদ্রস্ত দাঁড়াতে হয়। না হয় গায়ে গা লেগে যায়। প্যাসেজটার পরেই তার চেয়ার, তারপর ম্যানস্‌ ওয়াশ রুম। আমার কেমন যেনো যেতে আপত্তি লাগে। তারপরেও যাই। তার উদ্দেশ্য করে যাই না। তবে যাবার পথে তাকে না দেখলে মন খারাপ হয়। চোখের কোণে এদিকওদিক খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে পাই না, না পেলে আমার মন খারাপ হয়। আরেকটি বিষয়ে মন খারাপ হয়তার ডেস্কটির অবস্থানটির জন্য। তাকে মনে হয়, অন্ধকারের ভেতর একটি চাঁদ, যেনো মেঘে ঢেকে আছে।

আমি তার কাছ দিয়ে যাই, যেতে যেতে চোরা চোখে দেখি। সেও দেখে আমাকে। তবে দ’ুজনের চোখাচোখি হয় না। কেমন যেনো দূরবর্তী সম্পর্কে তার কাছ থেকে আমি দ্রুত দূরে চলে যাই এবং ফেরারওয়াশরুম থেকে, আমি আরও দ্রুত প্যাসেজটা অতিক্রম করে যাই। রাতে বাসায় এসে তাকে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে সে ঘুমের দেশে চলে যায়। আমি তখনও তাকে জাগাতে চেষ্টা করি। স্বপ্নের ভেতর সে জাগে না। তবু প্রতিদিন আগে এসে অফিসে গৌরব কামাই করার অধিকার তারই। সে আমার প্রিয়পাত্রকথা নেই, মুখোমুখি বসা হয়নি কখনো, কখনো ক্যাফেটেরিয়ার একই বেঞ্চে বসে একই সময়ে খাওয়া হয়নি আমাদের তবু জানি, পোয়েটিক্সের কমবেশি দুইশো কলিগের মাঝে সে সেরা। তার মনের কথা আমার মনের কানে কে যেনো কয়ে গেছে গোপনে। আমি সে কথা শুনি, শুনতে শুনতে অপেক্ষা করি, সে আসে না কেনো?

সেও কি আমার জন্য অপেক্ষা করে? করে হয়তো। না হলে আমি যেদিন দেরিতে যাই এবং গিয়েই তার জন্য ব্যাগ্র হই এবং সেদিন আর ভুলি না যে, পথশ্রমক্লান্তি এসব ধুয়ে ফেলতে হবে এবং পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র হয়ে বসতে হবে কাজে। আমাদের অফিসটা চার ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে রয়েছে আব্দুলরাজাক গুরনাহ টেবিল। এখানে রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট। আর দ্বিতীয়ধাপে রয়েছে সৈয়দ শামসুল হক কেবিন। এখানে ক্রিয়েটিভ এন্ড ডেভলপমেন্ট। এই দুইধাপে চার ভাগ। আমি কেবিনে বসি, তাই তার মুখ আমার সচরাচর দেখা হয় না। বিস্তৃত ফ্লোরের সরু প্যাসেজটা দিয়ে আমি চোখে মেখে রং, তার মুখের ছবিফিরে আসি। ফিরে এসে কেবিন ছেড়ে আবার বেরুতে মন চায়। হয়তো বের হই, কিন্তু পরক্ষণেই আবার ওয়াশরুমের দিকে যেতে পারি না। মেয়েটি ছ্যাবলা ভাববে, হয়তো ভাববে কম বয়েসে ডায়বেটিক বাঁধিয়ে বসেছে। তাই ঘুরে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যাই। এক গ্লাস জল খাই হয়তো গরমজলে মিশিয়ে। কিংবা নিচে গিয়ে চা খাই, সিগারেট খাই। সিগারেটের ধোঁয়ায় তাকে হারিয়ে হারিয়ে আবার এসে কাজে বসি।

কাজে মন বসে না। তারও কী বসে না? সেও কি আমার আশায় পথ চেয়ে থাকে? জানা নেই। তবু আমরা দ’ুজনেই কাজে মনযোগ দেই, সৃষ্টিশীলতা যেহেতু ভেতরে, দায়বদ্ধতাকে এড়াতে পারি না। ভুলে যাই একসময় তাকে। আবার মনে পড়ে হয়তো। দুপুরের খাবারের সময়, তাকে মনে পড়ে। আবার আবদুলরাজাক গুরনাহ টেবিল থেকে কেউ আসলে তার কথা মনে হয় পলকে। সহকর্মী দ’ুএকজন হয়তো খোঁচা দেয় হালকা করে, ক্রিয়েটিভ খোঁচা। কাজে বিঘ্ন ঘটে না। পলক ফেলার মতো মনে পড়েই আবার নিভে যায়। কখনো কখনো ক্যাফেটেরিয়ায় দেখা হয়, চা খাচ্ছে আলতো চুমুকে; অথবা ভাত খেতে খেতে চোখের কোণে দেখে নিচ্ছে মুহূর্ত। আমার চোখ পড়ার আগেই সরে যাচ্ছে সে চোখচোখের দৃষ্টি। তার টেবিলে লোকের অভাব নেই। তরুণেরা বা যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ ছাড়ায়নি তারাই ভিড় করে বেশি। তার পাশের টেবিলের রাশেদকে দেখা যায় কখনো কখনো। সে কোনো যেনো তাকায় না প্রেমের নজরে মেয়েটির প্রতি এটি আমি লক্ষ্য করেছি। তবে, প্যাসেজটা যেখানে এঙ্গেল হয়ে গেছে, একটু পশ্চিম দিকে তারপর সারি সারি ডেস্কগুলো আবার ঘুরে এসেছে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে, বাঁকের প্রথম টেবিলটা, ফাতরা ছেলেটার নাম আমি জানি না। ও ব্যাটা বেশি গ্যাজাতে চায় ওর সাথে। প্রায়ই প্যাসেজটা পেরুতে দেখা যায়, ওই ছেলেটা নিজের ডেস্ক ছেড়ে এসে মেয়ের ডেস্কের সামনে এসে ঝুঁকে কথা বলার চেষ্টা করছে। মেয়েটাও কথা বলছে নিরুপায় হয়ে। আমাকে দেখার সাথে সাথে, অদৃশ্য অভিযোগ যেনো দৃষ্টিতেএমন একটি চাউনি দিয়েই আবার কাজে মনযোগ দেয়। ফাতরা ছেলেটা তখনো সরে না। আমার ইচ্ছে হয় ঘুষি দিয়ে তার নাক ফাটিয়ে দিই।

.

আজ পড়ন্ত বিকেলে সিগারেট হাতে অফিসের বাইরে নিচে দাঁড়িয়ে আছি। বিকেলটা যেনো কাটছে না। অথবা ফুস করেই যেনো কেটে গেলো। দেখলাম দুয়েকজন নেমে যাচ্ছে অফিস থেকে। তাদের হাতে এটাচি। বুঝলাম, ছুটির সময় হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কোনো তাড়া নেই। আমার ছুটি দশটায়। আমাদের সৈয়দ হক কেবিনের একটি সুবিধা আছে। দশ ঘন্টা অথবা আট ঘন্টা কাটাতে হবে রাত এগারোটার মধ্যে, তাহলেই হবে। আজ আমি দেরিতে এসেছি। যাবো রাত দশটায়। তাই অন্যরা বের হলেও আমি তাদের চেয়ে চেয়ে দেখেছি। দেখেছি, না খুঁজেছি কাউকে? খুঁজছিলাম। একসাথে দ’ুজন মেয়ে নেমে গেলোসে ওদের কেউ না। আরেকটি মেয়ে আমার ঠিক পাশ দিয়ে গেলো, সে নয়। আরেকটি মেয়ে আবছায়ার মতো রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গলিটার ভেতর হারিয়ে গিয়েছে দ্রুত, পলকেই। আমার মনে হল এই সেই মেয়ে। আমার অভিমান হলো খুব। চোরাচোখে তো চেয়েছে নিশ্চয়, দেখেছে ও আমাকে। তবু একটি বার আমাকে দেখার সুযোগ দিলো না কেনো। এত দ্রুত বিজলির মতো পালানোর কী দরকার। আমার মন বলছে না, না, মেয়ে সে হতে পারে না। আমার চোখে চোখ মুছে যাবার আগেই, আমি তাকে দেখার আগেই সে এমন চট করে চলে যেতে পারে না। মনের দুঃখে আরও একটি সিগারেট জ্বালালাম। তারপর আরেকটি। তারপর আরেকটি। আমার আর অফিসে যেতে ইচ্ছে হলো না। তবু গেলাম। দূর থেকেই আবদুলরাজাক গুরনাহ টেবিলের নৈঃশব্দ্য আমাকে ফিরিয়ে রেখেছে সেদিকে দৃষ্টিপাত থেকে। আমি নিম্নচোখে কেবিনে প্রবেশ করলাম।

কাজে মন বসাতে পারছি না। একটি রবীন্দ্র সংগীত শুনলাম তিন মিনিটের, তবু না। আমি উঠে গেলাম। ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে আসলে ভালো লাগবে হয়তো। কিন্তু প্যাসেজটাতে পা রেখেই আমার চোখ বিস্ময়ে হকচকিয়ে গেলো। একি স্বপ্ন দেখছি আমি, নাকি সত্য? সে বসে আছে, একা। পুরো ফ্লোরে আর কেউ নেই। এই প্রথম সে আমার চোখে চোখ রেখে তাকালো। দেখলাম তার চোখে জল টলমল করছে। টের পেলাম, যেনো আমার ভেতরে কেউ কাঁদছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে প্রশাসনিক নজরদারি বাড়াতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসিইউএফএলের ৩ কর্মকর্তা বদলি