আমাদের দাদামণি

জিললুর রহমান | শুক্রবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

কবি অরুণ দাশগুপ্ত ১০ জুলাই ২০২১ দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এই যাওয়া তাঁর স্বভাবযাত্রা, অতিক্রান্ত সময়ের যাওয়া। তবু মন বলে, আরও কিছু দিন থেকে গেলে কী এমন সমস্যা হতো? আমি কিছুদিন আগে কথাশিল্পী রবিন ঘোষ দাদার কাছে জেনেছি অরুণ দা মানে আমাদের সকলের প্রিয় দা’মণি বা দাদামণি বেশ কিছুদিন হলো ধলঘাটে পিতৃপুরুষের ভিটায় নিঃসঙ্গ সময় যাপন করছেন। বলা যায় তিনি শেষ সময়ের প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁর এই একা গ্রামজীবনে শেষ সময় পার করার সংবাদে আমি চমকে উঠেছিলাম। নিজেকেও বেশ কিছুটা অপরাধী ভেবেছি, সাম্প্রতিক সময় তাঁর বহুবার আহবানে সাড়া দিয়ে অন্তত একবার তাঁর বাসায় যাওয়া হয়নি। নিজে জড়িয়ে থেকেছি আপন জীবনযুদ্ধে। অথচ যখন যে স্থানেই আমাকে তিনি দেখতে পেয়েছেন, আমি প্রণতি জানাবার আগেই তাঁর স্নেহার্দ্র আহবান এবং আমার যাবতীয় খবর নিজেই আগ বাড়িয়ে জেনে নিয়েছেন। অথচ তাঁর শেষ দিকের এই ধলঘাটবাসের সংবাদ পেয়েছি মাত্র ক’সপ্তাহ আগে। এই মহান বটবৃক্ষতুল্য মহীরূহটিকে নিয়ে আজ সারা দেশ জুড়ে অনেকেই অনেক সারগর্ভ লেখা লিখবেন, জানি। আমি তেমন কিছু লিখতে অপারগ। আমি শুধু বারবার নিজেকেই মনে করিয়ে দিতে চাই-এই কবি অরুণ দাশগুপ্ত হলেন সেই একমাত্র সম্পাদক যাঁর সরাসরি প্রশ্রয় ও আশ্রয় না হলে হয়তো আমি লেখার জগত থেকে পেশার জগতে হারিয়ে যেতাম। আমাকে লেখক হওয়ার এবং কবি হওয়ার পথ করে দিয়েছেন দাদামণি নামে সর্বজন পরিচিত সকল সৃজনশীল মানুষের আশ্রয়ের ঠিকানা এই অরুণ দাশগুপ্ত।
শিক্ষা জীবনের এবং যৌবনের সূচনাকাল কোলকাতা শহরে কাটানো সে যুগে পরম সৌভাগ্য, যা কবি অরুণ দাশগুপ্তের ছিল। তবে, যার রক্তে বহমান ছিল প্রীতিলতার উত্তরাধিকার, ধলঘাটের সেই জমিদার নন্দন দেশের টানে মাটির প্রেমে ফিরে এলেন চট্টগ্রামে, যুক্ত হলেন শিক্ষকতা পেশায়। পরবর্তীতে আজীবন দৈনিক আজাদীর সাহিত্য সম্পাদক হয়ে কেবল কবিতা বা লেখা ছাপানোর কাজ করেনি, বরং চট্টগ্রাম শহরে বেড়ে ওঠা সাহিত্য সংস্কৃতি কর্মীদের শিক্ষিত মার্জিত রুচিবান এবং সত্যিকার সংস্কৃতিমুখী করে গড়ে তোলার দায়িত্বটি তুলে নিয়ে ছিলেন নিজ কাঁধে। নিজের সৃষ্টিশীলতার কথা ভুলে গিয়ে তরুণদের মানস গঠনে অনেক বেশি নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন।
১৯৯৫ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে ঢাকা যাত্রার পর থেকে দাদামণির বাসার আড্ডার অভাব হৃদয়ের গহীন গভীরে নিয়ত অনুভব করেছি। ফিরে এসে সংসারপর্ব ও পেশায় থিতু হবার সংগ্রামে ধীরে ধীরে কমতে কমতে একসময় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল সে আড্ডায়। পরে একদিন কে একজন জানালো দাদামণি আমার খবর জানতে চেয়েছেন। সে খবর পেয়ে বৌদ্ধমন্দির মোড়ে ছুটে যাই। দেখি, সে ঘর সে বাড়ে ভেঙে বহুতল ভবনের রূপ নিচ্ছে। অনেক খোঁজ করে ছুটে গিয়েছিলাম রহমতগঞ্জের যোগেশ ভবনে। সেখানেও তাঁর দেখা মেলেনি। পরে অবশ্য বেশ ঘন ঘন কয়েকবার দেখা ও আলাপ হয়েছিল। কিন্তু প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে বেশ জমিয়ে আড্ডাবাজি আমার কপালে আর ছিল না। সর্বশেষ দেখা মিলে ছিল একুশে বইমেলার মঞ্চে। আমার কবিতা শুনে উচ্ছ্বসিত স্বরে বাহ্‌ বাহ্‌ করে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন এবং পাশে বসে থাকা কবি আসাদ চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে শংসাবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন পরম মমতায়। তাঁর ভালবাসার এই ঋণ আজীবন বুকে আগলে রাখা ছাড়া আজ আর কোন গত্যন্তর নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগুণী সাহিত্য সম্পাদক
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাবাজারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়েছে অফিস, গুদাম