আমাদের আত্ম-উন্নয়ন অথবা লাইব্রেরি বিষয়ক একটি প্রস্তাব

আশরাফ চৌধুরী | রবিবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে লাইব্রেরি ও একজন করে লাইব্রেরিয়ান চাই। এক্ষেত্রে ইউপি কমপ্লেক্স বা কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের উপর আরেকটি ফ্লোর হলেই চলে। লেখার শুরুতে বিষয়টি স্পষ্ট করার কারণ হলোপ্রস্তাবটিকে অগ্রহণযোগ্য মনে করা পাঠকরা যাতে লেখাটি পড়বেন কি পড়বেন না সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সৈয়দ মুজতবা আলী ওমর খৈয়ামের কবিতার ভাবানুবাদে লিখেছিলেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্তযৌবনাযদি তেমন বই হয়।’ মানুষ যেমন অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না, একইভাবে জ্ঞান ছাড়া মানুষও জীবন্মৃত। একটা সমাজে মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য যেমন হাসপাতাল অত্যাবশ্যক, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য লাইব্রেরিও প্রয়োজন। যে কোন সভ্য সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার একেকটা লাইব্রেরি। পৃথিবীকে সভ্যতার সোপানে তুলে দেওয়া আলোকিত মানুষেদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল অবদান তাদের বইপত্র। রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়ারের সাথে আমরা আর দেখা করতে পারবো না কিন্তু তাদের সাথে সাক্ষাৎ করার উৎকৃষ্ট উপায় তাদের বই পড়া। জ্ঞানের আধার হলো বই। আর বইয়ের ভুবন হলো লাইব্রেরি। লরা বুশ একবার বলেছিলেন, ‘আমার ওয়ালেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা পেয়েছি, সেটা হলো আমার লাইব্রেরি কার্ড’। এ বিষয়ে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য কথাটি বলেছিলেন সুইস দার্শনিক, কবি ও সমালোচক হেনরি ফ্রেডেরিক অ্যামিয়েল। তিনি বলেছিলেন,‘উন্নত ভবিষ্যৎ ও সফলতার জন্য তোমার যা যা দরকার তা ইতোমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে। আর এই লেখাগুলো কি, জানো? এটা জানার জন্য অবশ্য তোমাকে লাইব্রেরিতে যেতে হবে।’

রাষ্ট্র পদক্ষেপ না নিলে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। আমাদের মত দেশে সামাজিক আন্দোলন তেমন ফলদায়ক হয় না। কারণ ব্যক্তি বা কোন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ রাষ্ট্রের সবার জন্য সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনতে পারে না। আমাদের শহরগুলোতে পাঠক তৈরিতে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রসহ নানামুখী সরকারিবেসরকারি তৎপরতা দৃশ্যমান। কিন্তু গ্রামের কী অবস্থা? আমাদের মননে মগজে গেঁথে আছে, ‘গ্রামতো গ্রামই। অতএব, সবাই এই প্রস্তাবে হুমড়ি খেয়ে পড়বে এমনটা হয়তো হবার নয়। কিন্তু গ্রামকে বাদ রাখলে আমাদের আদৌ কিছু থাকে কি? তাই এবিষয়ে কিছু আলাপ হতেই পারে।

আজ থেকে ১৫ বা ২০ বছর আগে আমাদের শহরগুলোর অবস্থা দেখুন আর এখনকার অবস্থা তুলনা করুন। অনেক পরিবর্তন আপনার চোখে পড়বে। সময় অনেককিছু বদলে দেয়। একসময় আমরাও বদলে যাবো। তাই প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে লাইব্রেরি চাওয়া মোটেই বিলাসিতা নয়।

বস্তুগত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের মানসিক ও মানবিক উন্নয়ন বড্ড জরুরি হয়ে পড়েছে। আর কে না জানেলাইব্রেরির চেয়ে বড় কোন মনের হাসপাতাল পৃথিবীতে আজো গড়ে উঠেনি। আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে একটি লাইব্রেরি একটা পুলিশ স্টেশনের চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। আমরা যখন কারাগার বানাচ্ছি, উন্নত ও সভ্য পৃথিবী তখন কারাগার বন্ধ করে দিচ্ছে। এছাড়া আগে আমাদের শিক্ষার হার তুলনামূলক অনেক কম থাকাতে লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা আমরা তেমন অনুভব করিনি। কিন্তু এখন মাঝ বয়সী হতে অবসরপ্রাপ্ত বিপুল জনগোষ্ঠী শিক্ষিত। পৃথিবীর সভ্য জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলনে আমরা বাংলাদেশিরা এখন কড়া নাড়ছি। আমাদের নানা ক্ষেত্রে এখন বাঁক নেওয়ার সময় এসেছে।

ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়াশোনা এখন অনিবার্য বাস্তবতা। সেটা একাডেমিক বা পেশাগত পড়ালেখার চিরাচরিত পদ্ধতিই পাল্টে দিয়েছে। এখানে পড়া মানে শুধু পড়া নয়, একই সাথে দেখা ও শোনাও। তাই, ঐতিহ্যবাহী শিক্ষণশিখনেও এসেছে নয়া বৈচিত্র। গাদাগাদা রেফারেন্স বই না কিনে অনলাইনপিডিএফ ফর্মেটের বই পড়েই এসব চাহিদা মেটানো যায়। তবে এটা অনেকটা দূর শিক্ষণের বিকল্প বলা যায়। যে কেউ তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ, পেশাগত উৎকর্ষ অর্জন বা উচ্চশিক্ষার তাগিদে পড়াশুনার জন্য ইন্টারনেটের উপর নির্ভর করতেই পারেন। কিন্তু, পড়ার জন্য পড়া বা আনন্দের জন্য পড়ার বিষয় আসলে, ছাপা বইয়ের কোন বিকল্প নেই। এর কারণ ইন্টারনেট হলো অতলান্তিক মহাসমুদ্র। এখানে কেবল মাত্র আনন্দের জন্য বা মনের খোরাক মেটাতে যে নিবিড় পড়াশোনার দরকার সেটার কতটুকু সুযোগ থাকে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এখানে রকমারি বিনোদনের পসরা সাজিয়ে বসেছে ইন্টারনেট। এটা যেন সময় কাটানোর বিকল্পের হাট। কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে আপনি লেগে থাকবেন সে সুযোগ আপনাকে ইন্টারনেট দেবে না। নানাধরনের নোটিফিকেশন ও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আপনাকে সে বেপথু করবেই। তাই দেখা যায় প্রায়স আমরা ইন্টারনেটে ধান বানতে শিবের গীতকরি। অর্থাৎ, নিরবচ্ছিন্নভাবে লক্ষ্যাভিমুখী পড়ার কাজ ফেলে রেখে অন্য পড়ায় সময় কাটাই। যেমন, ফেইসবুক কিন্তু টেক্সটবুক নয় অথচ এটাও কিন্তু বুক। তাই, সুস্থির পড়াশোনা মানে নীরবে নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা। সেটা যদি লাইব্রেরিতে বসে না হয়, আর কোথায় হবে? আর লাইব্রেরির বই সমারোহ বা পরিবেশ কোনদিন বাড়িতে পাওয়া যাবে না। তাই লাইব্রেরির বিকল্প লাইব্রেরি।

অনেকের প্রশ্নওসব লাইব্রেরিতে কে পড়তে যাবে? সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আপনাকেআমাকেই। নরওয়েজিয়ান লেখকশিক্ষক জন বিং বলেছেন, “আদৌ লাইব্রেরির প্রয়োজন আছে কিনা, যেখানে সর্বত্র সবধরনের তথ্যের ছড়াছড়ি এমন প্রশ্ন তোলা অনেকটাএতএত রাস্তা থাকার পরেও আবার রোডম্যাপের কি প্রয়োজন, এমন প্রশ্ন করার শামিল।

উন্নত জাতিরাষ্ট্র হতে সরকার তো পদক্ষেপ নেবেই। আপনার বা আমার করণীয় কী হতে পারে? আমরা নিশ্চয় নিজেদের সে প্রশ্ন করবো। ইন্টারনেট ভিত্তিক পর্নোগ্রাফি বা ক্ষতিকর অনলাইন গেইমে আমাদের ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে পড়ার জন্য আমরা অভিভাবকরা কতটুকু দায়ী, নিজেকে সেই প্রশ্ন কি আমরা কখনো করেছি? আমরা নিজেরা কি সন্তানদের কাছে আদর্শ বাবামা হতে পেরেছি? জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কিভাবে স্বার্থপর হতে হবে আমরা কি আমাদের সন্তানদের যত্ন করে তা শেখাচ্ছি না? যুক্তিশীল কথা ও আচরণ দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততার ফল। হঠাৎ করে আমরা আমূলপরিবর্তন আশা করতে পারি না। আমাদের সিভিক সেন্স নিয়ে যে প্রশ্ন অব্যাহতভাবে উঠতে থাকে তার পেছনের কারণ হলোআমরা ঐতিহ্যকে ধারণ করা ও সভ্য আচরণ করার বিষয়গুলো পরিশীলিতভাবে অথবা ব্যবহারিক পদ্ধতিতে শিখি না। এটা অনেকটা দীর্ঘ অনুশীলনের ব্যাপারও। আর এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য লাইব্রেরিই হতে পারে সামাজিক উৎকর্ষ অর্জনের প্যারামিটার। আমাদের উপলব্ধির সীমানা প্রসারিত করতে বইয়ের কোন বিকল্প নেই।

লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধবামের দুর্বলতা ও ডানের ব্যর্থতা : একটি নির্মোহ সমীক্ষা