দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

সিঁড়িভঙ্গ পণ

আমি কিন্তু অতো জোরে উঠতে পারবো না। তোমরা পারলে উঠে যেও । আমি উঠবো ধীরে ধীরে রেস্ট নিয়ে নিয়ে ।“ জানাল লাজু

যাক, মহাপ্রাচীরের ওঠার ব্যাপারে অভ্র বাদে বাকি সবাই নানান স্বরে আর সুরে তাদের ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করায়, জোর পেলাম মনে। কিন্তু চুপ থাকা অভ্র যদি মাঝপথে বেঁকে বসে, “আমি টায়ার্ড হয়ে গেছি” বলে, তাহলে ওকে তো একা নীচে বসিয়ে রেখে যেতে পারবো না উপরে। সেক্ষেত্রে থেকে যেতে হবে ওর সাথে লাজুকে বা আমাকে। এদিকে প্রায় চলে এসেছি পাহাড়ের নীচের প্রথম ধাপের সিঁড়ির গোড়ায়। নাহ এক্ষুনি নেয়া দরকার এ ব্যাপারে তার কনফিডেন্সের হদিস ।

কি অভ্র তুমি চুপ করে আছ কেন?”

পারবো আমি। এই ভাইয়াটা শুধু শুধু বলছে বলছে আমি পারবো না।“ বলার সাথে সাথে ভাইয়ার দিকে তেড়ে যেতেই, দ্রুত ওর জ্যাকেটের পিঠ খামচে ধরে থামালাম।

ভেরি গুড বাবা। এইতো চাই। ঠিক আছে চল উঠা যাক এবার, বলতেই দীপ্র দুদ্দাড় উপরে উঠে যেতে শুরু করতেই অভ্রও নিল তার পিছু। নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের একটা ছুতা পেয়ে গেছে ফের দুজনেই, অতএব শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এদিকে ভাইপোদের এই দৌড়ঝাপের ছবি তোলার জন্য হেলেনও ছুটতে শুরু করেছে ওদের পিছু পিছু। কিন্তু এভাবে উঠতে গেলে তো অচিরেই হাঁফিয়ে পড়বে ওরা! ধীরে সুস্থে লাজুসহ সিঁড়ি ভাঙ্গতে শুরু করে তাই গলা উঁচু করে বললাম

দেখো বাবারা, এতো হুড়োহুড়ি করে উঠতে গেলে দ্রুত টায়ার্ড হয়ে যাবে। অনেক গুলো সিঁড়ি কিন্তু উঠতে হবে। সব জায়গায় এক টেকনিক খাটে না, মনে রেখো। এখানে স্লো বাট স্টেডি উঠতে হবে। আবার এভাবে উঠতে গিয়ে পরে গিয়ে হাত পা ভাঙলে কি হবে বলো তো?

কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমার উপদেশ আর আশংকা বহনকারী এ বাক্যসমূহ এখনাকার হিম হাওয়ায় উড়ে উড়ে পাহাড়ের গাছগাছালির কোথায় যে হারিয়ে গেল কে জানে? দুপুত্র ততোক্ষণে পাহাড়ের গায়ের তৃতীয় ধাপের সিঁড়ির মাথায় উঠে দেখছি হাফাচ্ছে। হাফাতে হাফাতে দু ভাই দেখি বসেও পড়েছে ঐ সিঁড়ির মাথায়, পাহাড়ের কার্নিশে বিশ্রাম নেবার জন্য রাখা দুটো পাথরে। এদিকে ওদের পিছু পিছু যাওয়া হেলেন এরই মধ্যে পিছিয়ে পড়েছে বেশ ওদের থেকে। দ্বিতীয় ধাপের সিঁড়ি গুলোর আধাআধিও উঠতে পারেনি ও এখনো। আর আছি আমরা দুজনে প্রথম ধাপের সিঁড়ি গুলো মাঝামাঝি।

ধীরে সুস্থে দুজনে প্রথম ধাপের সিঁড়ি গুলোর শেষ করে, একটু বিশ্রাম নেবে কি না জিজ্ঞেস করতেই লাজু জানাল যে, নাহ তার দরকার নেই এখন। পরের ধাপের সিঁড়ি গুলো উঠেই নেবে বিশ্রাম। বোঝা গেল মহাপ্রাচীরে উঠার নেশায় সম্ভবত ও পায়ের সমস্যাটাকে আর গা করছে না মোটেই। ভালই হল এতে। মনোবল ঠিক থাকলে শরীর মহাশয়ের আপাত অসহনীয় অনেক কিছুই হয়ে যায় সহনীয়।

কিন্তু না, অচিরেই টের পাওয়া গেল নিজের সহ অন্য সবার শারীরিক ফিটনেসের যাকে বলে ছেড়াবেড়া অবস্থার সংবাদ। পাহাড়ের নানান ঢালে যতোই হেলানোভাবে বানানো হয়ে থাকুক না কেন সিঁড়িগুলো, আর যতোই বিশ্রাম নিয়ে থেমে থেমে উঠি না কেন, আন্দাজ করি এক তৃতীয়াংশেরও কম সিঁড়ি ভেঙে উঠার পর সবারই অবস্থা বেশ কাহিল হয়ে গেল। পুত্রদের লাফ ঝাপ আর দৌড়াদৌড়ীর দৌরাত্ম গেলে এক্কেবারে মিইয়ে। বেশ কিছুক্ষণ তাই সবাই একাট্টা হয়ে পাহাড়ের ঢালে বিশ্রাম নিতে নিতে, সবারই সাথের ব্যাগে থাকা ছোট্ট পানির বোতল থেকে এক ঢোক করে পান খেয়ে তৃষ্ণা মিটলাম। উপরের দিকে পাহাড়ের নানান ঢালে বানানো সিঁড়িগুলো দেখতে দেখতে প্রমাদ গুনলাম মনে মনে। ভাবছি, এই না কেউ বলে বসে, দিলামভঙ্গ রণে আমি। এরকম একটা হাঙ্গামার জন্য তো প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও।

চল চল মনু পিকাসো উঠি আমরা উপরে “হেলেনের এই কথায় এসময় দুপুত্র পুনরায় পরের ধাপের সিঁড়ি গুলোর দিকে এগুতেই লাজুও যখন একই তাড়া দিল, আশ্বস্ত হলাম।

এবার আর কেউ খুব আগুপিছু করে না। উঠছি বরং একইসাথে, এক দুই সিঁড়ি আগু পিছু করে। টের পাচ্ছি যতোই উপরে উঠছি, বাড়ছে বাতাসের তোড়ও। তবে সকলে উর্ধগমনে ব্যস্ত থাকায়, হিম পাচ্ছে না পাত্তা তেমন কারো কাছে ।

এরকম হিমেও চারিদকে সবুজের কমতি যে নাই, তাতে বেশ অবাকই হচ্ছি মনে মনে। যদিও ক্ষণে ক্ষণে নানান জায়গায় বরফ জমে থাকতে দেখছি , আর তা দেখলেই শুরু হচ্ছে ছবি তোলাতুলি, কিন্তু এ নিয়ে এখানকার গাছগুলোর কোন বিকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। উদ্ভিদবিদ তো না, তাই বুঝতেও পারছি না, কোনজাতের কোনটা কোন। খুব মোটা দাগে বুঝতে পারছি এর চিরহরিৎ গোত্রের গাছ সব । বড়ই মনোরম এই পরিবেশের মধ্য দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে মনে হল , এ এলাকাটি ভ্রামনিকদের তুমুল আগ্রহের কারণে ব্যবসায়ীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও, এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রাকৃতিক ভাবটি এখনো বজায় আছে অনেকটাই । তাতে এখানকার কর্তৃপক্ষকে বাহবা দিতেই হয় ।

এখানে যা কিছু অপ্রাকৃতিক তা হলো ,শুধু এই সিঁড়ি গুলো । আর পাহাড়ের প্রতিটি ঢালে বিশ্রাম নেবার জন্য যে স্থাপনা গুলো বানানো হয়েছে বা রেলিং দেয়া হয়েছে , সেটুকুকেই মনে হচ্ছে কাবাব মে হাড্ডির মতো। কিন্তু তা না হলেও তো চলতো না। উঠতাম কিভাবে অন্তত আমাদের মতো নবিশ আর আতিক্কা পাহাড়চড়া ভ্রমানিকরা, অতো উপরে?

শুনেছি আদিযুগে সীতা মিলেছিল নাকি ধনুর্ভনংগ পণে, আর আজ এমুহূর্তে প্রত্যক্ষ করলাম সিঁড়িভঙ্গ পণের ফলাফল। যে কোন দলের দায়িত্ব নিয়ে বন্ধুর কোন পথ চলতে গেলে, দলের অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের নিয়ে প্রকৃত মানবিক নেতা সর্বক্ষণ থাকেন উৎকণ্ঠিত। আর আমি তো এ দলের নেতা নই শুধু। এ দল তো তৈরি হয়েছে আমারই আত্মজ , স্ত্রী আর বোনের সমন্বয়ে। অতএব একদমই অপ্রস্তুত অবস্থায় এরকম একটা উর্ধগমনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে , সারাক্ষণই ভয়ে ভয়ে ছিলাম কখন না লাজুর আহত পা বিগড়ে বসে? কিম্বা কখনই বা ছোটপুত্র অভ্র দেয় রণে ভঙ্গ?

বড়ই আশার বিষয় তার কোনটাই হয়নি। ফলাফল তিনঘণ্টার উপর সময়, অভূতপূর্ব শারীরিক শক্তিক্ষয় আর সকলের একাগ্র সিঁড়িভঙ্গ পণের বিনিময়ে অবশেষে মহাপ্রাচীরের উপরে পা রাখতে পারলাম সকলেই । তাতে মহাপ্রাচিরের গায়ে পদচিহ্ন একে দেবার মুহূর্তটিকে সবাই যে যার মতো যেভাবে উদাযপন শুরু করলো, তার তুলনা চলে সম্ভবত হিলারি তেনজিং এর এভারেস্ট বিজয়ের উদযাপন মুহূর্তের সাথেই।

হবেই না কেন ঐরকম উদযাপন? ছোটবেলায় চট্টগ্রামে খালার বাসায় বেড়াতে গিয়ে হেলেনের এবং আমার, তারপর পরবর্তীতে আবার নিজে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে আমাদের দুজনেরই ভাড়ারে, পাহাড়ে চড়ার দূরতম হলেও কিছু অভিজ্ঞতা জমা ছিল। বাকীদের কারোই তো তা নাই। এছাড়া সমতল ঢাকা শহরে যতোই উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ী, অফিস বা স্কুল তৈরি হউক না কেন, সবগুলোতেই আজকাল অনিবার্যভাবে আছে বিনাকষ্টে উপরে ওঠার উর্ধগমন যন্ত্র বা লিফট। ফলে একতলা দু তলা উঠতেও আজকাল কেউ আর সিঁড়িভঙ্গ পণ করে না। এমন কি দেখা যায় কোন কোন স্থাপনার দোতলায় অবস্থিত জিমে ও উঠার সময়েও অনেকেই নিচ্ছে শরণ উর্ধগমন যন্ত্রের! সে অবস্থায় এরকম একটি ঘটনা এখানে ঘটিয়ে ফেলা তো উদযাপন করাই উচিৎ। প্রথমে চোখের আন্দাজে মনে হয়েছিল মহাপ্রাচিরের উঠতে হলে ভাঙ্গতে হবে তিন চারশ সিঁড়ি। যদিও গুনিনি, তারপরও মনে হচ্ছে এরই মধ্যে ভেঙ্গেছি সবে, না হলেও কমপক্ষে পাঁচ ছয় শো সিঁড়ি! অতএব এ তো অবশ্যই আমাদের পারিবারিক এভারেস্ট বিজয়!

নাহ, বেশীক্ষণ আর ঐ উদ্দাম হৈ চৈ উদযাপন করা গেল না। একে তো সবারই কাহিল অবস্থা, দ্বিতীয়ত মহাপ্রাচীরের উপরের উঠার পর মনে হচ্ছে বাতাসের তোড় বেড়েছে আরও বহু। এরকম খোলামেলা জায়গায় চারদিক থেকে আসা হিম বাতাসের তোড় থেকে আমাদেরকে রক্ষা করার জন্যই মনে হচ্ছে সেই চৌদ্দশ শতকের মিং রাজারা, ঐ সামনের ঐ ঘুমটি ঘরের মতো ঘরটি বানিয়ে রেখেছিলেন এই মহাপ্রাচিরের উপর। সবাইকে নিয়ে সেই ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলাম, এবার কার উদ্দেশ্য কি?

আমি পুরোটা হেঁটে দেখতে চাই ‘দীপ্রর কাছ থেকে এ দৃপ্ত ঘোষণা আসতেই, সাথে সাথেই তার মা বলল

মাথা খারাপ? আর তুমি পারবে নাকি? সবাই তো টায়ার্ড হয়ে গেছে। তোমাদের খাবারেরও সময় হয়েছে। আমি পারবো না অতো হাঁটতে আর। নীচে নামতেও তো আবারও হাঁটতে হবে।“

কতো দূর হাঁটা যাবে এখানে? আমিও বেশী পারবো ন হাঁটতে। আর যা বাতাস “ মন্তব্য হেলেনের ।

এইসব বাতচিতের ফাঁকে ফাঁকে এসে পৌঁছেছি সবাই সেই ঘুমটি ঘরে। এ ঘরে এসেই এর ভেতরের নানান পাথুরে তাকে যে যে যার মতো বসে পড়লাম হুড়মুড়িয়ে। এতে একদিকে যেমন বাতাসের হিম ঝাপটা এড়ানো গেল, তেমনি কিছুটা বিশ্রাম পেল সকলের পদযুগল। এ তল্লাটে এতোক্ষণ আর কোন লোকজনের দেখা না পেলেও, এখানে বসের পর , এ ঘুমটি ঘরে উল্টা দিকে মহাপ্রাচীরের দিকে বেরুবার চওড়া পথ আছে, সেদিকে নজর দিতেই সামনে সামান্য এঁকেবেকে যাওয়া মহাপ্রাচীরের বেশ কিছু পর্যটক দেখা গেল নানান দূরত্বে। হাঁটছে তারা সামনের দিকে কেউ, কেউ। কেউ কেউ ফিরে আসছে। আর কেউবা তুলছে ছবি।

লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের মানবিক হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের আত্ম-উন্নয়ন অথবা লাইব্রেরি বিষয়ক একটি প্রস্তাব