বামের দুর্বলতা ও ডানের ব্যর্থতা : একটি নির্মোহ সমীক্ষা

কানাই দাশ | রবিবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

মোটাদাগে বলতে গেলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এসেছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে ডান শক্তিকে পরাস্ত করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ডান পন্থীরা তার বদলা নেয়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে ডান পন্থীরাই সেই পাকিস্তান আমলের মতো এদেশের ক্ষমতার বলয়ে নানা রূপে, নানা মোড়কে অধিষ্ঠিত।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের বাম রাজনীতির প্রকারভেদ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। হালকা রসিকতা করে বলেছেন, কড়া, গরম, নরম, মিঠে নানা রকমের বাম সরকারের বিরোধিতায় লেগেছে। ১০ জানুয়ারি সঠিকভাবে অবশ্য বলেছেন অতি বাম ও অতি ডান এক হয়েছে। রাজনীতি বিজ্ঞানে বহুপূর্বে লেনিনের উচ্চারিত এই বহুল পরিচিত বাক্যবন্ধ তিনি কি ভেবে বলেছেন জানি না তবে এই বিপজ্জনক মিলনের পেছনে শাসক দলের ভূমিকা স্ববিরোধী ও প্রশ্নসাপেক্ষ। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৮৬ সালের নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও নেতৃত্বের সর্বাত্মক বিরোধিতাকারী, বাম রাজনীতির কথিত বিশুদ্ধবাদিতার দাবীদার, এক সময়ের কড়া বামনেতা রাশেদ খান মেনন, তাঁরই সাবেক অনুসারী অতি বাম দিলীপ বড়ুয়া যেখানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে আছেন তাঁদের কোন বাম বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনে করেন তা উল্লেখ করলে মানুষ আরো স্পষ্ট করে বামদের নিয়ে তাঁর মনোভাব বুঝতে পারত নিশ্চয়ই। অপরদিকে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ এমনকি ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জল গণমুখী ভূমিকা ও অবস্থানকে ন্যাপসিপিবি নামে যে দুটো ঐতিহ্যবাহী বাম দল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রশ্নে, বাম রাজনীতির গভীর বিভ্রান্তির কুহেলিকার মধ্যেও সমর্থন করেছে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে মুক্তিযুদ্ধে, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে, তাদের বর্তমান আওয়ামী নেতৃত্ব ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোন ধরনের বাম বলেন তা জানার কৌতুহল মানুষের থাকা স্বাভাবিক। ঐ বামশক্তি বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের কিছু বিমূর্তধারণা ও মূল্যবোধ ছাড়া অন্য কোন বিষয়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক নীতি দর্শনের ক্ষেত্রে, ধর্মান্ধদের রাজনীতির প্রশ্নে, সামাজ্রবাদের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নীতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য দেখে না এবং এ জন্য এই দুই শক্তির বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি বাম গণতান্ত্রিক বিকল্পশক্তি গড়ে তোলার কঠিন ও সময় সাপেক্ষ লড়াইয়ে এই শক্তি ব্যাপৃত আছে, যাদের কারণে সরকার বিরোধী সব বাম ডানে সর্বদলীয় ঐক্য করা যাচ্ছে না বলে বিএনপি’র ও অভিযোগ তাদের সম্পর্র্কে তিনি সরাসরি কিছু না বললেও আওয়ামী নেতৃত্বের মুখে নানা সময়ে এদের বিরুদ্ধে বক্তব্য শোনা গেছে যেমন বিএনপি নেতারাও এদের কথিত ঐক্য বিরোধী বলতে দ্বিধা করেন না।

বঙ্গবন্ধু তো একদিনে বঙ্গবন্ধু হননি। তিনি চিরদিন মানুষের পক্ষে ছিলেন। মানুষের প্রয়োজনে বার বার নিজেকে অতিক্রম করেছেন মননে প্রজ্ঞায়, অভিজ্ঞতায়। ৫০ এর দশকের পুরো সময় তিনি আওয়ামী লীগের ডান ঝোঁকের বিরুদ্ধে দলের ভিতরে নানাভাবে লড়েছেন। ’৬৪ সালে এসে তার রাজনীতি ধীরে ধীরে মধ্য বামের দিকে বাঁক নিতে শুরু করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মানবেনা জেনেও তাজউদ্দিনকে সাথে নিয়ে ’৬৬ সাল থেকে ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী অনুচর আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে এবং সামগ্রিকভাবে তাঁর ও তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে সোহরাওয়ার্দীর ডান অবস্থান থেকে ক্রমে মধ্য বাম অবস্থানে নিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরপরই জাতীয় সরকার গঠনের দাবী না মেনে তিনি সংসদীয় রাজনীতির নিয়মতান্ত্রিক পথে হেঁটেছেন কিন্তু পরিস্থিতির অবণতি হলে ’৭৫ এ তা বাতিল করে নিজ সিদ্ধান্তে আরো জনকল্যাণমুখী কর্মসূচির ভিত্তিতে এক দলীয় ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি যে এ কালপর্বে ডানপন্থার বিরুদ্ধে, মানুষের পক্ষে, প্রগতির পক্ষে ছিলেন তার প্রমাণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ছিল এমনকি তাঁকে হত্যার চক্রান্তে জড়িত ছিল। মানুষের কল্যাণকামী চিন্তাকে স্থির লক্ষ্য করে তিনি আমৃত্যু নিজেকে ক্রমে বিবর্তিত করেছিলেন চিন্তায় কর্মে মননে। ক্ষমতার সমীকরণে আপোষের রাজনীতিতে তিনি কখনো বিশ্বাসী ছিলেন না। আজকের বিএনপিজামাত ও ধর্মান্ধ অপশক্তির চাইতে অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও মার্কিন সৌদি অক্ষ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তিনি। এদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এঁদের চক্রান্তের যুপকাষ্টে জীবন দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এই সময়ে ন্যাপসিপিবি বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের একান্ত সহযোগী শক্তি ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এখন মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির ভাবাদর্শিক চেতনা ও অর্থনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে অপছন্দের ও অগ্রহণযোগ্য দুঃসময়ের সেই বাম শক্তি। কাজেই প্রকৃত বাম নিয়ে সরকারী দলে বিভ্রান্তি সহজবোধ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথার রেশ ধরে বাম শক্তির বিভক্তি, বিকৃতি নিয়ে সামান্য আলোচনা নিশ্চয়ই এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে নাঅপ্রাসঙ্গিক হবে না বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ ডানপন্থীদের অপকর্ম, ব্যর্থতা ও তাদের ভিতর বিচিত্র বিভক্তি নিয়ে আলোচনা করা।

১৯৬৬ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মাত্র দু’জন সদস্য নিজেদের চিনাপন্থী বলে সাংগঠনিক নিয়মনীতি না মেনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে মূল পার্টি ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া অংশটি ১৯৭১ সালের আগেই নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। এদের কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়, কেউ বিরোধিতা করে। ’৭৫ এর পরে নিছক আওয়ামী বিরোধিতা থেকে এদের একটি বিরাট অংশ জেনারেল জিয়ার নবগঠিত দল আজকের বিএনপি’র প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসা ছাত্রলীগের তরুণ ও র‌্যাডিকেল ভাবনার একটি বিরাট অংশ নিজেদের বাম দাবী করে ডানের স্লোগান ধারণ করে ‘জাসদ’ নামে দল গঠন করে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে সে সময়। ’৭৫ এর পরে হঠকারী রাজনীতির পরিণতিতে এই দল খন্ড বিখন্ড হয়ে পড়ে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপজাত বাম নামধারী উগ্র রাজনীতির প্রতিভু ইনু সাহেবরা আছেন সরকারী জোট ১৪ দলে আবার রবমান্নারা আওয়ামী লীগ হয়ে এখন বিএনপি’র সাথে জোটবদ্ধ। এদের অন্য একটি অংশ বাসদ নামে বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটভুক্ত। অন্যদিকে ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে পরীক্ষিত ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ থাকা মস্কোপন্থী কথিত মূল বাম শক্তি বা সিপিবি ১৯৯৩ সালে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের মুখে ভেঙ্গে যায়। তখন বামপন্থাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে বিরাট একটি অংশ শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগে ও গণফোরামে চলে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯০ সালের পরে ক্ষমতার সমীকরণে সরাসরি ডান দিকে চলে গেলে আজকের সিপিবি বিকল্প বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭২ এর মূল সংবিধান কার্যকরের দাবী তথা ভিশন’৭১ এর স্লোগান তুলে সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছে দেশে একটি দৃশ্যমান বাম বিকল্প শক্তি গড়ার অত্যাবশ্যকীয় লক্ষ্যে।

বাম ডান নির্বিশেষে রাষ্ট্র ক্ষমতা হল রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য। সেই প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে ডানশক্তি পরাজিত হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতায় ও গণ মানুষের প্রত্যাশার বিপরীতে ডান শক্তি আবার ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান নিতে শুরু করে। তবুও নানা বিবেচনায় ’৭২ থেকে ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কাল পর্বকে বাদ দিলেও ’৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করেছে সামরিক ও বেসামরিক লেবাসে ডানপন্থীরা। ডানপন্থীরা যে নানাভাবে বিভক্ত এবং নিজেদের মধ্যে নৃশংস অনৈতিক দ্বন্ধে লিপ্ত সেই সত্য জনমনে নানাকারণে অনুপস্থিত। আগেই বলেছি উগ্র ডানপন্থীরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে মোস্তাকের নেতৃত্বে। উগ্র, মধ্যম, চরম, ধর্মান্ধ এরূপ নানা মতে ও দলে বিভক্ত এদেশের ডান শক্তি। নানা সময়ে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্র্মভিত্তিক দল হলো এদেশের ডান শক্তির প্রতিনিধি। রাজনৈতিক পথ নিয়ে পার্থক্য থাকলেও এরা সবাই নিউ লিবারেল অর্থনীতি তথা লুঠেরা রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। প্রমাণ হলো জিয়া, এরশাদের সুচিত অর্থনীতি এখন আরো প্রবল হয়ে দেশ শাসন করছে। ডানদের দীর্ঘ শাসনে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত এদেশ আজ পাকিস্তানি ভাবাদর্শে শাসিত হচ্ছে। বলা যায় বাংলাদেশ বর্তমানে ডানদের সৃষ্ট প্রায় অনতিক্রান্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যাভিসারী রাজনীতি, উন্নত সামাজিক সংস্কৃতি ও অর্থনীতিই পারে এদেশকে রক্ষা করতে। ডানদের ব্যর্থতা ও বামদের দুর্বলতার প্রেক্ষাপটে কে এগিয়ে নেবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে? নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দৃঢ় রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বাম বিকল্প শক্তিই পারে এই দুঃসহ অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করতে। আজ এই বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। ইতিহাস আজ প্রকৃত বামদের উপর এই কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করেছে।

লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের আত্ম-উন্নয়ন অথবা লাইব্রেরি বিষয়ক একটি প্রস্তাব
পরবর্তী নিবন্ধসিনেমার সেই মর্মান্তিক দৃশ্য নিয়ে মুখ খুললেন নির্মাতা