আমরা ও ইউসুফ আলী দাদু

প্রণব বড়ুয়া অর্ণব | শনিবার , ৭ মে, ২০২২ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

কিছু মানুষের জন্ম হয় পরের জন্য, পরের খুশীতে খুশী হয়। আবার দুঃখেও কষ্ট পায়। লেখাপড়া না জানলেও লেখাপড়ার প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম ছিল, কেউ পাশ করলে কিংবা ভালো রেজাল্ট করলে তাঁর আনন্দ আর দেখে কে। তিনি আর কেউ নন, ইউসুফ আলী। গ্রামের ছোট বড় সকলের ‘বন্ধু’। আমাদের দাদু। মা মামারা ডাকতেন কাকা। আমাদের যখন থেকে বুঝবার বয়স তখন থেকে জানি দাদু। থাকতেন মামা বাড়িতে। মামার বাড়ির দাদুকে দেখিনি, তবে এ দাদুর আদর স্নেহ ও শাসনে দেখেছি।

মামার বাড়ি গেলে কিংবা আমাদের বাড়িতে আসলে পড়ার খোঁজ নিতেন। আমাদের গ্রামের সকলে তাঁকে চিনতেন, জানতেন। উপকারে আসতেন। আমার জন্মেরও আগে থেকে মামার বাড়িতে বসবাস। মামা বাড়ির সুখে দুঃখে সবসময়ের সাথী ছিলেন, শুধু মামা বাড়ি না পুরো গ্রামের মানুষের প্রিয়ভাজন ছিলেন। বৌদ্ধ পরিবারে বছরের পর বছর থাকলেও এ পরিবারেরও তাদের আত্মীয় স্বজনের নিকটজনই ছিলেন তিনি। ধর্মকর্ম সব ঠিক সময়ে ঠিকভাবে করতেন, নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন। কিন্তু থাকতেন বড়ুয়া বাড়িতে, এটি নিয়ে কেউ কেউ টিটকারি করতেন বলে নামাজ পড়তেন অনেক দূরে মসজিদে গিয়ে। জুমাবারের নামাজ পড়তে প্রায় দুই কিলোমিটারের অধিক পথ হাঁটতেন তারপর নামাজ আদায় করতেন। রমজান মাসে একটা রোজা ভাঙতে দেখিনি, সেহেরি খেতে না পারলেও পানি খেয়ে রোজা রেখেছেন। ইফতারে সময় ছোলা পেয়াজু, খেজুর, মুড়ি, ও ফলমূল থাকতো, আমরাও সেই ইফতারের সারথি হতাম। তিনি আমার নামটা ঠিকভাবে ডাকতে পারতেন না, ডাকতেন ‘পমইদ্দা’।

মামা বাড়ির কাজ ছাড়াও তিনি অন্যের ঘরের চালার (ছনের) কাজ করতেন (অর্থাৎ ঘরজার কাজ করতেন)। মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে গ্রামে কে কে পাস করেছে তার হিসাব তাঁর কাছে থাকতো এবং খুশী হতেন। তাদেরকে উৎসাহিত করতেন। আজকের দিনের মত রেজাল্টে প্রকাশের পদ্ধতি এত ডিজিটাল ছিলো না, তিনি আমাদের গ্রাম থেকে তিন/চার কিলোমিটার দূরে স্কুলে গিয়ে রেজাল্টের খবর নিয়ে আসতেন বাবাদাদাদের সাথে গিয়ে। যাদের সন্তান পাস করেছে তাদের যত আনন্দ না তাঁর আনন্দ তত বেশি। আমাদের পরিবারের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তিনি উঠোনে দাঁড়িয়ে আজানের ধ্বনি দেন। আমার বড়দাদার সন্তান রমিতের জন্মের পরপর তিনি আজান দেন এবং নামাজ আদায় করেন।

অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন ইউসুফ আলী দাদু। মামা বাড়ির দুঃসময়ে তাঁকে তাদের বাড়িতে চলে যেতে বলা হলেও তিনি যাননি, আগলে রেখে ছিলেন মামার বাড়ি। তিনি সকলকে আগলে রেখে ছিলেন, ষাট বছরের অধিক সময়কাল ছিলেন, যখন অসুস্থ হলেন তখনও তিনি ছিলেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে রাজি ছিলেন না। ঠিক মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তিনি বাড়ি গেলেন, পাশের গ্রামেই ছিলো দাদুর বাড়ি। সেখানে গেলেও তাঁর মন পড়ে ছিল এ বাড়িতে, মামা বাড়ির দাদারা, মামারা নিয়মিত যেতেন, খোঁজ নিতেন, চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতেন। তারপর একদিন দাদু পরপারে পাড়ি জমালেন, সেদিনও সবাই জানাযায় হাজির হয়েছিলেন। দাদুর কূলখানিতে গরু কেনার টাকা দেয়া হল। দাদু মুসলিম আমরা বড়ুয়া, সেটা কোনো বিষয় ছিলো না। তাঁর আন্তরিকতা, মানুষ হিসেবে মানুষের মমত্ববোধ, আজো তাঁর ঋণের কথা মনে পড়ে। যেখানে থাকো দাদু ভালো থেকো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবি গুরু
পরবর্তী নিবন্ধএকটি স্বপ্নের মৃত্যুবার্ষিকী