আবেগ নয় -চাই মনুষ্যত্বের সাধনা

মোস্তফা কামাল পাশা | রবিবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

দেশব্যাপী করোনা টিকা দেয়া হচ্ছে। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অগ্রাধিকার তালিকা এবং সম্মুখযোদ্ধারা সুশৃঙ্খলভাবে উৎসবের আবহে টিকা নিচ্ছেন। বিনা খরচে অতিমারির টিকা পেয়ে সবাই সরকারের উপর খুশি। এত দ্রুত বাংলাদেশে সরকারি খরচে করোনা টিকার ব্যবস্থা করায় জননেত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। অবশ্য অভ্যাসবসে বিএনপি তথা বিরোধী দল উল্টো-পাল্টা গাইছে।
টিকা প্রয়োগ শুরু হলেও করোনা এখনো ফনা গুটোয়নি। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমলেও হামলা চালু আছে। এরমাঝেও শুকনো মৌসুম টার্গেট করে চলছে অন্যরকম উদযাপন! কর্মজীবীসহ রোগী, শিশুর রাতের ঘুমে থাবা বসিয়েছে বেহেশত/স্বর্গ ফেরিঅলা, বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানের আতস বাজি এবং গান বাজনার হামলা। মৌসুম জুড়েই হুজুর, মাজার, খানকা, দরবার, মঠ, মন্দির, আশ্রমে ভক্ত, অনুরক্তের টানা জমায়েত যেমন চলছে, তেমনি আছে গানবাজনা ও অসংখ্য বিয়ে পার্টি। রাতভর ধর্মীয়, সামাজিক অনুষ্ঠান, হৈ হট্টগোলের বিরুদ্ধে কিছু বলাও যায়না! সাথে যোগ হয়েছে ভালবাসা দিবস। হৈ হল্লা রোগী বা শিশুদের সহ্য করতেই হয়! মাথা ব্যথা বা পেটের বিষ বেদনা ভুলেও হল্লার তেতো গিলতে হয়। আজব কাণ্ড! যুক্তি নয়, ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানকারী নিজের সুবিধা ও আবেগের গ্যাসবেলুনে চলে! গ্যাসবেলুনকে ভাবে, আল্লাহ পাক তথা স্রষ্টার নাযেল হওয়া বোরাক বা বায়ুরথ! এখানে শিক্ষা-উচ্চ শিক্ষা সব তরফই গ্যাস বেলুনের যাত্রী! যার যে নামই হোক, আমরা কেউ ইসলাম কেউবা সনাতন, কেউবা সাইবার স্রোত বাহিত সামাজিকতার আধুনিক ভূত। ভূতের অদৃশ্য চাবুকের তালে নাচি-কুঁদি, হাসি-কাঁদি! আবার ধর্মের গোপন রশি আঁকড়ে অরে ল যত অন্যায় করা সম্ভব সব করবো! ঘুষ, সুদ, গুম, গায়েব, ভেজাল, মিথ্যা, ভন্ডামি, দেশদ্রোহ, ইতরামি, ফাজলামি সবকিছুই ঠিক! শুধু সামনে রাখ, পবিত্র ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ! রাজনীতিতে জয় বাংলাওয়ালাদের বাড়তি সুবিধা হচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু!
কোন বেহেস্ত বা স্বর্গ পাগল বুঝতেই চাননা, আসলে আমরা জন্মসুত্রে ধর্মলাভ করেছি-কর্মসূত্রে নয়। বাবা-মা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি বা খৃষ্টান বলেই আমিও তাই। জন্মসূত্রে যিনি যে ধর্মের জাতকের ঘরে এসেছেন, স্বাভাবিক নিয়মেই সে ধর্মে বিশ্বাসী হবেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য আমরা মানিইনা। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ঘরে যে সব শিশু জন্ম নিচ্ছে, সবাইকে একই সৃষ্টিকর্তা সৃজন করেছেন। মাতৃজঠরে বীজ গুঁজে দিচ্ছেন। কেন তিনি এমন করছেন, সবাইকে কেন মুসলিম অথবা একক ধর্মের ছাতার নিচে আনছেন না! তাহলে তো সব ল্যাটা চুকেবুকে যেত। ধর্ম নিয়ে এত্তো ফ্যাসাদ-বিভক্তি-ব্যাবসা, হানাহানি-খুনোখুনিই খাকতোইনা! মায়ের পেটের ভ্রূণতো কোন পাপ করেনি। নিস্পাপ ভ্রূণটাকে স্রষ্টা হিন্দু-খৃষ্টান-বৌদ্ধ বা ইহুদি মায়ের পেটে কেন ‘পুশ’ করে দিচ্ছেন? কোন দোষে! স্বঘোষিত বড় বড় পীর, আলেম, ওলামা, কেবলা বাবা, ঋষী, পুরোহিত বা যাজক ফাদার কী এই সহজ-সরল প্রশ্নের জবাবটি খুজে পেয়েছেন? যদি পান, দয়া করে ব্যাখ্যাটা ধর্মীয় মাহফিল বা পূজা পার্বনে ঘোষণা দিন। তারপর পাপী বা দোষীকে সাজা দিন। ধর্মীয় বৈচিত্র মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক পছন্দ করেন বলেই পৃথিবীতে এতো ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। সব ধর্মের সারবত্তা কিন্তু এক, মানবতা তথা সৃষ্টির কল্যাণ। ইবাদত বন্দেগী, পা্রর্থনা আল্লাহ পাক বা ভগবানের কল্যাণে নয়, নিজের কল্যাণেই করছি। তাই খাঁটি এবং প্রকৃত ধার্মিক কখনো অন্য ধর্মাবলম্বীকে ঘৃণা করতে পারেননা। পারেননা অসংখ্য মাইক, বাজনার হল্লায় রাতভর রোগি বা শিশুর ঘুম কেড়ে নিতে। শুক্রবারকে যারা জুমাবার বানাতে কোমর বেঁধে নেমেছেন, তারা কেমন ধর্মভীরু বা ধর্মপ্রাণ? এরশাদ খৎনা করিয়ে রাষ্ট্রকে জবরদস্তি ইসলাম কবুল করান! রাষ্ট্র কী মানুষ না প্রাণি! স্রেফ নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং ধারণা। গাছ-বাঁশ যেমন ইসলাম বোঝেনা,তেমনি বুঝেনা রাষ্ট্রও! কিন্ত আবেগের ফেনার ভয়ে রাষ্ট্রকে মার্কামারা ভন্ডের ষ্টিকারটি বইতেই হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি মুসলিম হয়, গাভীর দেবী হতে দোষ কী? গাভীরতো অন্তত প্রাণ আছে? তো মোদিকে কোন মুখে গালাগাল করি!
আপনারা পবিত্র ধর্ম নিয়ে উগ্রতার চাষ ও ব্যবসা ফেঁদে ধর্মান্ধ সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে বিভক্তি- বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দিচ্ছেন। বদলাতে হলেতো, সপ্তাহের সব বার এবং সব বাংলা ও খৃষ্টীয় পঞ্জির মাসের নামই বদলাতে হয়। এগুলো ভিন ধর্ম তথা মোল্লার ভাষায় কাফের-নাছারার নাম! শুক্রবার জুমাবার হলে হজ্বের দিন হজ্ববার, দু’ ঈদের ‘ফিতরবার’ বা ‘আজহাবার’ রাখতে হয়! ইসলামে এ’সব দিনের ছাওয়াব জুমার চেয়ে বেশি!
বাজে বিতর্ক যেমন ক্ষতিকর তেমনি রাতভর শব্দদুষণে মানুষকে কষ্ট দেয়া আরো বেশি ক্ষতিকর। অতিমারির কামড়ে অসংখ্য মানুষ কষ্টে, কর্মহীনও প্রচুর। বাড়তি জৌলুষের নামে অসহায় বেকার, কর্মজীবী, রোগী, শিশু, বৃদ্ধের কষ্টের বোঝা বাড়ানোর মত অধর্ম আর হয়না। ধর্মীয় হোক, সামাজিক বা উৎসব, উদযাপনের নামে হোক, রাতভর হৈ হুল্লোড় করে কোন উৎসব অথবা দিবস পালন থেকে বিরত থাকা আমাদের ধর্মীয় ও নাগরিক দায়। আসুন, আবেগের ফেনা ঝেড়ে সবার আগে আমরা মানুষ হই।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিঃস্বার্থ অনুভূতিটুকুই ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে