আন্তর্জাতিক কিডনি ও লিভার পাচার চক্রের শেকড় চট্টগ্রামে!

তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে চলে কেনাবেচা

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

আন্তর্জাতিক কিডনি ও লিভার পাচার চক্রের শেকড় চট্টগ্রামে! প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে বেআইনি বেচাকেনায় জড়িত চট্টগ্রামসহ সারা দেশের কিছু হাসপাতাল, এক শ্রেণির অসাধু চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও বেসরকারি সংস্থা। চট্টগ্রাম তথা সারাদেশে সংঘবদ্ধ আটটি চক্র এই কিডনি ও লিভার পাচারের সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি দলে নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়া পাঁচ থেকে ১০ জন করে সদস্য রয়েছে। বিদেশ ফেরত মানুষকে একপ্রকার ফাঁদে ফেলে তাদের ভারতে পাঠিয়ে কিডনি ও লিভার পাচার করে থাকে তারা। সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর র‌্যাব-৭, চট্টগ্রাম বিশেষ অভিযান চালিয়ে একটি চক্রের মূল হোতাসহ তিন জনকে আটক করেছে। চক্রটির সদস্যদের আটকের পর খুলশী থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। কিডনি বিক্রির জন্য এ পর্যন্ত চক্রটি ৪০ জনকে ভারতে পাঠিয়েছে বলে স্বীকার করেছে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে। কিডনি নিয়ে চক্রটির বেশ কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ সক্রিয়।
র‌্যাব-৭ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ বলেন, কিডনি ও লিভার পাচারকারী তিন সদস্যের মধ্যে রনি আন্তর্জাতিকভাবে সম্পৃক্ত। করোনা মহামারির কারণে এতদিন যারা প্রবাসে ছিলেন তাদের অনেকেই বর্তমানে দেশে ফিরে এসেছেন। প্রবাসীদের অনেকেই বিদেশে যাওয়ার আগে বিভিন্ন জনের কাছে ধার দেনা করে গেছেন। দেশে ফিরে আর্থিক সমস্যায় পড়া এ ধরনের লোকদেরই মূলত তারা টার্গেট করে। পাশাপাশি দরিদ্র লোকদেরও টার্গেট করে তারা। চট্টগ্রামে ধরা পড়া ডালিম কিডনি-লিভার পাচার চক্রের বাংলাদেশের প্রধান। ভারতে অবস্থান করা পাচারকারী চক্রের শাহিন নামে একজন বাংলাদেশে রনি, আলম সহ অন্যদের মাধ্যমে কিডনি ও লিভারের ডোনার সংগ্রহ করে থাকেন। ডোনার সংগ্রহ করে তাদের ভারতে পাচারের ব্যবস্থা করে চক্রটি। এ জন্য তাদের পাসপোর্ট তৈরি করে দেওয়াসহ সব ব্যবস্থা করে চক্রের সদস্যরা। প্রতি কিডনি ডোনারের সঙ্গে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় মৌখিক চুক্তি হতো। আর চক্রটি কিডনি বিক্রির জন্য ভারতীয় এজেন্টদের কাছ থেকে নিত ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা।
যেভাবে এ চক্রের সন্ধান পায় র‌্যাব: ২-৪ লাখ টাকায় কিডনি-লিভার বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলত ডোনারদের। ফেসবুক পেজে প্রচারণা চালিয়ে চক্রের সদস্যরা এই কাজ করত। প্রতারণার শিকার হওয়া কয়েকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ কিডনি ও লিভার ডোনেশনের আড়ালে কেনাবেচা চক্রের তথ্য সংগ্রহে মাঠে নামে। শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসা সেবা এবং কিডনি-লিভার চিকিৎসা সেবা নামে দুটি পেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়। এ দুটি পেজের অ্যাডমিন ছিলেন শাহরিয়ার ইমরান (৩৬)। তার বিরুদ্ধে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টিরও বেশি মামলা রয়েছে। ১২ অক্টোবর রাজধানী ঢাকা ও জয়পুরহাটে অভিযান চালিয়ে কিডনি কেনাবেচায় জড়িত এ চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-২। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগী কিডনি দাতাদের চারটি পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য বিশেষ পাসপোর্ট ও ভিসা সম্পর্কিত বেশ কিছু নথিপত্র, পাঁচটি মোবাইল ফোন ও দেশি-বিদেশি মুদ্রাও জব্দ করা হয়। তাদের কাছ থেকে চট্টগ্রামে ধরা পড়া কিডনি ও লিভার পাচার চক্রের তথ্য পায়। তাদের তথ্যের সূত্র ধরে ৩০ ডিসেম্বর র‌্যাব-৭ এর একটি দল খুলশীর জাকির হোসেন রোডের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে একই কায়দায় ডালিম চক্রের কাছ থেকেও বিভিন্ন নথিপত্র জব্দ করা হয়। র‌্যাব নিশ্চিত হয় আন্তর্জাতিক কিডনি ও লিভার পাচার চক্রের শেকড় চট্টগ্রামে। চক্রের অন্যান্য সদস্যদের সন্ধানে কাজ করছে র‌্যাব।
তিনটি ভাগে চলে কার্যক্রম : প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জানান, তাদের চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। তারা ৩টি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি লিভার কেনাবেচা করে থাকে। চক্রের প্রথম গ্রুপ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। আর চক্রের দ্বিতীয় দলটি চাহিদা অনুযায়ী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষ চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে নিয়ে আসে। অপরদিকে তৃতীয় গ্রুপটি প্রলোভনের শিকার কিডনি ডোনারদের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায়। ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হওয়ার পর তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়। এ চক্রের কয়েকজন সদস্য এর আগে জেল খাটলেও লাভজনক হওয়ায় আবার ফিরে আসে ব্যবসায়।
কেন ভারতে পাঠানো হয় : অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিস্থাপনের জন্য ভারতে বছরে যেখানে দুই লাখেরও বেশি মানুষের নতুন কিডনির দরকার হয়, সেখানে পাওয়া যায় বড়জোর আট হাজারের মতো কিডনি। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ব্যবধান এত বেশি হওয়ায় কিডনি, লিভার ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লাভজনক অবৈধ ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠছে ভারতের পাশাপাশি বংলাদেশেও। চলছে লাখ লাখ টাকার খেলা। কিডনি অপারেশনে সাধারণত খরচ পড়ে গড়ে ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা। কিডনি পাচারকারীরা প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে গিয়ে অতি গরিব পরিবার এবং দিন আনে দিন খায় এমন ‘অশিক্ষিত’ লোকদের টার্গেট করে। তাদের নানাভাবে মগজ ধোলাই করে। বোঝায়, মানুষের দুটো কিডনির একটা দিলে তার কোনো ক্ষতি হয় না। কয়েকদিনের মধ্যে সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারবে। অপারেশন হবে ভারতের বড় বড় সব হাসপাতালে। এজন্য সে পেয়ে যাবে তিন-চার লাখ টাকা। লোভ সামলাতে পারে না বেচারা গরিব পরিবার, রাজি হয়ে যায়। প্রতারকদের প্রলোভনে পা দিয়ে কিডনি দাতাদের অনেকেই এখন নানা ধরনের জটিল স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছেন। লাভের বদলে নিজের জীবন নিয়েই শঙ্কায় প্রতারিতরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোবাইল উপহার থেকে খুন
পরবর্তী নিবন্ধটাকা লুটের জন্য হত্যা