আনোয়ারায় নিহত ১

ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা, বোয়ালখালী চন্দনাইশে সংঘাত-সংঘর্ষ, বান্দরবান খাগড়াছড়িতে শান্তিপূর্ণ ভোট

আজাদী ডেস্ক | বৃহস্পতিবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

পঞ্চম ধাপে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৩২ ইউনিয়ন পরিষদে গতকাল বুধবার বছরের প্রথম ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোট কেন্দ্রে সংঘর্ষে মৃত্যু, গোলাগুলি, ভাঙচুর, ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে আনোয়ারায় ১০ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সংঘাত-সংঘর্ষ ও ভোটকেন্দ্র দখলের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বোয়ালখালী উপজেলার ৭ ইউপি ও চন্দনাইশের ৭ ইউপির নির্বাচন। অন্যদিকে বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দৈনিক আজাদীর আনোয়ারা, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ ও বান্দরবান প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন।
আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, ভোট কেন্দ্রে সংঘর্ষে মৃত্যু, তিন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভোট বর্জন, কেন্দ্রে ভাঙচুর, গোলাগুলি, হামলা, পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে গতকাল বুধবার আনোয়ারায় ১০ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল ১১টায় উপজেলার সিংহরায় প্রতিপক্ষ মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় নিহত হয়েছেন ওমকার দত্ত (৩২) নামে এক যুবক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১১টার দিকে চাতরী ইউনিয়নের ৭ নম্বর সিংহরা ওয়ার্ডের মেম্বার প্রাথী রঘুনাথ সরকার (আপেল) ও ধনঞ্জয় বিশ্বাস ভোলার (টিউবওয়েল) সমর্থকদের মধ্যে কেন্দ্রে ভোটার আনা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে রঘুনাথের সমর্থকরা ইট, লাঠিসোটা নিয়ে ওমকারের উপর হামলা চালায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আনোয়ারা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের কর্তব্যরত চিকিৎসক মনোয়ারা সুলতানা রোজী জানান, গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত ওমকার আনোয়ারা হাসপাতালে আনার সময়ও অচেতন অবস্থায় ছিলেন। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। চমেক হাসপাতালে দায়িত্বরত জেলা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। শরীরে বড় কোনো জখমের চিহ্ন না থাকলেও ধারণা করা হয় কিল ঘুষি ও লাঠির আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে।
সিংহরা রামকানাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং অফিসার মো. সেলিম মোল্লা বলেন, কেন্দ্র থেকে দূরে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গণ্ডগোল হয়েছে। ঘটনাটি কেন্দ্রের বাইরে হওয়াতে ভোট বন্ধ করা হয়নি। বেলা ২টার দিকে এই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় চাপা আতংক। ওমকারের ঘনিষ্ঠ মেম্বার প্রার্থী ধনঞ্জয় বিশ্বাস ভোলা ওমকারের মৃত্যুর ঘটনায় ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। এ ঘটনার জন্য তিনি প্রতিপক্ষ রঘুনাথ সরকারকে দায়ী করেন।
এ ব্যাপারে রঘুনাথ বলেন, সকালে ঘটনার সময় আমি ছিলাম ভোট কেন্দ্রের ভেতর। এই ওয়ার্ডে ৭ জন মেম্বার প্রার্থী। আমি গত ২ বারের মেম্বার। অন্য প্রার্থীরা একজোট হয়ে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
এদিকে দুপুর আড়াইটায় পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওষখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ইউপি সদস্য প্রার্থী ওয়ারেস আহমেদ চৌধুরী ও আল আমীনের সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এসময় কেন্দ্র ভাংচুর ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়। এসময় ওই কেন্দ্রে ২ ঘণ্টারও অধিক সময় ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়।
উপজেলার পরৈকোড়া, বারশত, হাইলধর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি ও নির্বাচনী এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ এনে স্বতন্ত্র প্রার্থী পরৈকোড়া ইউনিয়নের নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, বারশত ইউনিয়নের আমিনুল হক ও হাইলধর ইউনিয়নের মো. সোলেমান চৌধুরী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
ভোট শুরুর পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার ডুমুরিয়া রূদুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মেম্বার প্রার্থী অহিদুল আলম ও শামসুল আলমের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রায়পুর ইউনিয়নের উত্তর পরুয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের কাছে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে শতাধিক লাঠি, হেলমেট, রামদাসহ বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। র‌্যাবের কোম্পানি কমান্ডার (এসপি) তাহিয়া আহমেদ চৌধুরী জানান, প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী কেন্দ্রে গোলযোগের উদ্দেশ্য এসব দেশীয় অস্ত্র মজুদ করেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জোবায়ের আহমদ জানান, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে।
বোয়ালখালী প্রতিনিধি জানান, বোয়ালখালী উপজেলার ৭ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সংঘাত-সংঘর্ষ ও ভোট কেন্দ্র দখলের অভিযোগ উঠেছে। চরণন্দীপ ইউনিয়নের চশমা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী শোয়েব রেজা নির্বাচন স্থগিত চেয়ে রিটার্নিং অফিসার বরাবর আবেদন করেছেন। ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন শাকপুরায় আনারস প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী গিয়াস উদ্দিন সোহেল। ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করতে গিয়ে ভাংচুরের শিকার হয়েছে গণমাধ্যমের গাড়িসহ ৮-১০টি গাড়ি। আহত হয়েছেন দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্তত ১০ জন। হামলা করতে গিয়ে আটক হয়েছেন সরকারি স্কুলের এক শিক্ষকসহ ২ জন।
সূত্র জানায়, ভোট শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর আহল্লা কড়লডেঙ্গায় আসাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মনসুর আহমেদ এবং আনারস প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা হামিদুল হক মান্নানের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে আহত হয়েছেন দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট মামুন আহম্মেদ অনিক। সংঘর্ষকালে গণমাধ্যমের গাড়িসহ অন্তত ৮/১০টি গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছেন করলডেঙা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ হারুন। ঘটনার সময় আটক হয়েছেন কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমির হোসেন ও এক আওয়ামী লীগ নেতা।
এ বিষয়ে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল করিম বলেন, নির্বাচন চলাকালে বিক্ষপ্ত সংঘর্ষে দুজন আহত হয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার জানান, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েক জায়গায় সহিংসতার অভিযোগ উঠলেও সার্বিকভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক।

চন্দনাইশ প্রতিনিধি জানান, বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষ ও মারামারির মধ্য দিয়ে চন্দনাইশে ৭ ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ঘন কুয়াশার মধ্যেও প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। তবে দুপুরের পর থেকে ভোটারদের উপস্থিতি কমে আসে। এরমধ্যেও কিছু কিছু কেন্দ্রে মারামারির ঘটনায় ১ জন ইউপি সদস্য প্রার্থী, ১ পুলিশ কনস্টেবলসহ ৭ জন আহত হয়েছেন। দুটি কেন্দ্রে কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকলেও পুনরায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন চলাকালে কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শনে দেখা যায়, দুপুরে হাশিমপুর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম হাশিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোট দিতে গেলে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ কেন্দ্রে প্রায় ঘণ্টাকালব্যাপী ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। এসময় এক ভোটার আহত হয়। দুপুরে দক্ষিণ হাশিমপুর জাতীয় তরুণ সংঘ সরকারি বিদ্যালয় কেন্দ্র দখলকে কেন্দ্র করে ২ ইউপি সদস্য প্রার্থী আখতারুজ্জামান মিরু ও জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এসময় ওই কেন্দ্রে ঘণ্টাব্যাপী ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। বৈলতলী ছিদ্দিক মিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রের বাইরে ইউপি সদস্য প্রার্থী মুরাদুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলমের সসমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মিনহাজুল ইসলাম জানান, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চন্দনাইশ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন বলেছেন, কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং হতাহতও হয়নি কেউ।
বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানে ইউপি নির্বাচনে সদর উপজেলার সূয়ালক, কুহালং এবং টংকাবতী ৩ ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। তিন ইউনিয়নেই ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। তবে পুরুষের তুলনায় পাহাড়ের নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শীত উপেক্ষা করে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন তারা।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার রেজাউল করীম জানান, সদরের কুহালং, টংকবতী ও সুয়ালকের ৩টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ৭ জন, সংরক্ষিত আসনে ২৫ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৭৩ জন প্রার্থী লড়ছেন। শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনৌকা ১৭, বিদ্রোহী ৭ ও স্বতন্ত্র ২ জন জয়ী
পরবর্তী নিবন্ধনগর বিএনপির মানববন্ধনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, আটক ৪৯