আজ বসন্তের আমন্ত্রণে

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

‘আজ হোক না রং ফ্যাকাশে, তোমার আমার আকাশে, চাঁদের হাসি যতোই হোক না ক্লান্ত; বৃষ্টি নামুক না-ইবা নামুক, ঝড় উঠুক না-ইবা উঠুক, ফুল ফুটুক না-ইবা ফুটুক আজ বসন্ত।’- আজ ফাল্গুনের ১ তারিখ, ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী দিন। বসন্তের আগমন নীরবে নিভৃতে হওয়ার জন্য নয়, তাকে বরণ করে নিতে এই বিশাল প্রকৃতি যেমন তার সবটুকু দিয়ে অর্ঘ্য সাজিয়েছে, তেমনি নগরবাসীও বসন্তকে বরণ করে নেবে আপন রঙে।
শীতের খোলস ছেড়ে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম এখন যেন কোনো অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। পলাশ আর শিমুল গাছে যেন লেগেছে আগুনের ছোঁয়া। প্রকৃতিতে মধুর বসন্তে সাজ সাজ রব। তাইতো প্রকৃতির সাজের সঙ্গে গুণ গুণ করে গেয়ে উঠছে মন, ‘আহা আজি এ বসন্তে… কিংবা মনেতে ফাগুন এলো…’। পহেলা ফাল্গুনে আনুষ্ঠানিকভাবে মর্ত্যলোকে অভিষেক ঘটে ঋতুরাজের, আর তাকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি নেয় এক বর্ণিল সাজ। গাছে গাছে জাগে নতুন পাতা, নতুন ফুলের সমারোহ। সবাই যেন মত্ত শীতের শুষ্কতাকে প্রাণপণে আড়াল করার চেষ্টায়।
প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি অতি জাঁকজমকের সাথে পালিত হয় বসন্ত বরণ উৎসব। তবে গত দুই বছর করোনার ছোবলে বসন্তকে সম্ভাষণ জানানো যায়নি। এবারও হয়তো সেই বর্ণাঢ্যতা থাকবে না, কিন্তু প্রাণের তাগিদ এতটুকু কম হবে না; এ কথা নিশ্চিত। পহেলা বৈশাখের পর এটি যে বাঙালির দ্বিতীয় প্রাণের উৎসব। এ দিনটিতে প্রকৃতির সাথে সাথে বাসন্তি সাজে সেজে ওঠে বাংলার মানুষ। আর শুধু এই বাংলায় নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যাসহ অন্যান্য রাজ্যেও দিনটি বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হবে।
বাংলার প্রকৃতি, ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বড় স্থান দখল করে আছে বসন্ত। প্রাচীন আমল থেকেই এদেশে পহেলা ফাল্গুন পালন করা হতো। হিন্দুদের পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোতে এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শান্তি নিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন করার রীতি চলে আসছে। ১৪০১ বঙ্গাব্দে এদেশে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ পালিত হয়। বসন্ত এলে প্রাণের তাগিদে প্রাণের মানুষকে খুঁজে ফিরে সবাই। মনে রঙ, বনে রঙ, সকলেই যেন রঙের মানুষ, রঙিলা বাতাসে উড়ায় অন্তরের ফানুস।
বসন্ত মানেই যৌবন-কথা। বসন্ত মানে সৃজন, জাগরণ আর উদ্বোধন। আমাদের প্রাণের ভেতরে যে আরেকটি প্রাণ আছে, জীবনের ভেতরে যে আরেকটি জীবন আছে, আত্মার গহীনে যে রূপ-অরূপের আকাঙ্ক্ষা আছে, জীবন ও প্রকৃতির সমান্তরালে তাকে অনুভব ও উৎসরণের নামই বসন্ত। আমাদের কথার ভেতরে কিছু কথা আছে, কথার অন্তরালে কিছু সূক্ষ্ম বার্তা আছে, প্রাত্যহিকের যাপিত গদ্যের ছায়ায় অদৃশ্য সুর ও গান আছে এবং সীমাবদ্ধ বাঁধনের তারে অসীমের তরঙ্গ স্পর্শ আছে। এই অদৃশ্য তরঙ্গের স্পন্দন, জীবনের দোলা, বাণী আর সুরের মূর্চ্ছনায়-রূপে-রসে, মনে ও প্রকৃতিতে জমে ওঠে মায়ার খেলা-প্রাণের খেলা। যার কান আছে সে শোনে, যার চোখ আছে সে দেখে এবং যার হৃদয় আছে সে টের পায় কেউ আসছে, কেউ জেগে উঠছে। কে সে ? কার এই জাগরণ? সীমার ভেতরে অসীমের মূর্তিতে কার এই সম্ভোগ অভিসার? কার এই নীরব জিকির, গোপন আহ্বান? দেহে-মনে-পুলকে-শিহরণে-বোধে-মননে এই আহ্বানকে স্পর্শ করার যে ইচ্ছা-সময়, বাঙালি তারইতো নাম রেখেছে বসন্ত। আর প্রকৃতির বসন্তকে জীবনের লৌকিক ও আত্মিক আনন্দের গভীরতম স্পর্শে-অনুরাগে, রূপলোকের প্রতিমার ছোঁয়ায় শিহরিত-স্পন্দিত করার মনন আয়োজনের নামই বসন্ত উৎসব। বাঙালি আদি ও অকৃত্রিম হৃদয় ছোঁয়ায় বরণ করতে প্রস্তুত। ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নিতে থিয়েটার ইন্সটিটিউট, পাহাড়তলী আমবাগান শেখ রাসেল পার্ক, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলার চিরায়ত গান, নাচ, আবৃত্তি, কথামালাসহ নানা আয়োজনে শুরু থেকেই মুখর হবে উৎসব অঙ্গন। আজ বসন্তের প্রথম দিনটি ভালোবাসা দিবসও। তাই আনন্দ আয়োজনেও ভিন্নমাত্রা থাকাটাই স্বাভাবিক।
বসন্ত উৎসব উপলক্ষে ফোন, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে চলছে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বসন্তকে বরণ করার লক্ষ্যে চলেছে সাজ সজ্জা। বসন্তের বাউলা বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ বাউল শাহ আবদুল করিমের মতো ঠিক পৌঁছে যাবে আমাদের প্রত্যেকের মনপুরায়।
পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত, আমাদের সাংস্কৃতিক অনুসঙ্গ যেমন, তেমনি এ মাসের রাজনৈতিক গুরুত্বও অসীম। ফাগুনে শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ মনে করিয়ে দেয় বায়ান্নর ফাগুনের শহীদদের কথা। মনে করিয়ে দেয় ভাষা শহীদের রক্তের ইতিহাস। এ মাসেই মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন রফিক সফিক বরকত সালামরা। তাদের রক্তের সোপান বেয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই ফাগুন বাঙালীর দ্রোহেরও মাস।
বোধনের বসন্ত উৎসব থিয়েটার ইন্সটিটিউটে : বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম প্রতিবারের মত এবারও ‘নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে’ শিরোনামে চট্টগ্রাম থিয়েটার ইন্সটিটিউটে ঋতুরাজ বসন্তবরণ উপলক্ষে আজ ১ ফাল্গুন ১৪ ফেব্রুয়ারি, সোমবার সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দিনব্যাপী সামাজিক বিধিনিষেধ মেনে বোধন বসন্ত উৎসব ১৪২৮ উদযাপন করতে যাচ্ছে। এ বছর এই উৎসব ১৭ বছরে পদার্পণ করছে। বসন্ত আবাহন, আবৃত্তি, সঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, পিঠাপুলির সমারোহে দিনব্যাপী এ উৎসব সাজানো হয়েছে। উৎসবে আনন্দ সঙ্গীত একাডেমির পরিবেশনায় রয়েছে তবলা লহড়া। দলীয় সংগীত পরিবেশন করবে সংগীত ভবন, অদিতি সঙ্গীত নিকেতন, কলাবন্তী সঙ্গীত একাডেমি, গীতধ্বনি ও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। দলীয় নৃত্য পরিবশন করবে ওডিসি এন্ড টেগোর ড্যান্স মুভমেন্ট সেন্টার, নৃত্যম একাডেমি, স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ডান্স, নৃত্য নিকেতন, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, সঞ্চারী নৃত্যকলা একাডেমি, নটরাজ নৃত্যাঙ্গন একাডেমি, ঘুঙুর নৃত্যকলা একাডেমি, দি স্কুল অব ক্লাসিক্যাল এন্ড ফোক ডান্স, আলোড়ন ডান্স একাডেমি ও গুরুকুল। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করবে বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম ও বোধন আবৃত্তি স্কুল চট্টগ্রাম। এ ছাড়া রয়েছে দেশের স্বনামখ্যাত শিল্পীদের পরিবেশনায় একক ও দ্বৈত সংগীত, একক আবৃত্তি, ঢোলবাদন ও নাটক। উৎসবে সবার উপস্থিতি কামনা করেছেন বোধনের সভাপতি আবদুল হালিম দোভাষ ও সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী। অনুষ্ঠানে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে আছে দৈনিক আজাদী।
প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের আয়োজন : বসন্ত উৎসব উপলক্ষে প্রমা আবৃত্তি সংগঠন আজ বিকেল তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বসন্ত উৎসব উদযাপন করবে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনের সহযোগিতায় অনুষ্ঠানে আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য, কবিতা পাঠ ও যন্ত্রসংগীতের আয়োজন থাকছে। অনুষ্ঠানে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে থাকছে দৈনিক আজাদী ও প্রাইম চ্যানেল। প্রমার কর্ণধার আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ হাসান বলেন, দেশীয় সংস্কৃতি, দেশীয় ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় আমরা বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছি। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতিকে জাগ্রত করে আমরা অন্ধকারের অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই।
বোধনের আয়োজনে বসন্ত উৎসব : আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন সকাল আটটা থেকে শুরু হবে নগরীর পাহাড়তলী আমবাগান শেখ রাসেল পার্কে বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম আয়োজিত ‘নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এলো প্রাণে’ শীর্ষক বোধন বসন্ত উৎসব ১৪২৮। এতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট সংস্কৃতি অনুরাগীদের অংশগ্রহণে গান, কবিতা, কথামালা, নৃত্য, ঢোলবাদন ও যন্ত্রসংগীতে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণের উৎসব সূচি সাজানো হয়েছে। এছাড়া উৎসব অঙ্গন থেকে রয়েছে বসন্তবরণ শোভাযাত্রা। বাঙালির প্রাণের এ আয়োজন করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধুমাত্র দুপুর পর্যন্ত চলবে। সংস্কৃতিপ্রেমীদের এ আয়োজন উপভোগ করতে বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি সোহেল আনোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক এস এম আব্দুল আজিজ অনুরোধ জানিয়েছেন।
শব্দনোঙর বসন্ত উৎসব : শব্দনোঙর আবৃত্তি সংগঠন বসন্ত উৎসব উদযাপন করছে ১৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। ‘শব্দনোঙর বসন্ত উৎসব’ শিরোনামে বিকেল ৪টায় বেলুন উড়িয়ে এবং মোহন বীণার সুরে উদ্বোধন হবে এ উৎসবের। উৎসবের পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে রয়েছে একক আবৃত্তি, দ্বৈত আবৃত্তি, সম্মেলক আবৃত্তি, একক সঙ্গীত, দলীয় নৃত্য, সঙ্গীত শিল্পী ও নৃত্য শিল্পীদের পরিবেশনা। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। শব্দনোঙর সভাপতি আবৃত্তিশিল্পী হাসান জাহাঙ্গীর এবং শব্দনোঙর উচ্চারণ স্কুলের পরিচালক আবৃত্তিশিল্পী দিলরুবা খানম দম্পতি সকল সংস্কৃতি অনুরাগী দর্শক-শ্রোতাকে অনুষ্ঠান দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছেলে-মেয়ে নাতির সাথে পাস করলেন সিরাজুল
পরবর্তী নিবন্ধমোট নম্বর ২০০, পেল ২১৮!