আগামী প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন উপনিবেশমুক্ত স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সংস্কার

রিজোয়ান মাহমুদ | মঙ্গলবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি স্বভাবজাত স্বপ্নময় স্বতন্ত্র এক জাতি। স্বপ্ন দেখতে এবং তা যৎপরোনাস্তি গড়তেও ভালোবাসে, আবার ধূলিসাৎ করতেও পিছপা হন না। বাঙালিদের এ দোটানা স্বভাব আজকের নয়। প্রায় হাজার বছরের বাঙালি বিভিন্ন ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়েছে। সমতট হরিকল পূর্ববঙ্গের বাঙালি কিংবা গৌড় উত্তর বঙ্গের বাঙালি অবশেষে স্বাধীন ভূখণ্ডের কিংবা রাষ্ট্রের দিক থেকে আজ বাংলাদেশী। বাঙালির মধ্যে নদীর মতো উদ্দাম ও উদারতা আছে। আবার দুর্বলতাও কম নেই। প্রাচীন কাল থেকে তার জ্ঞানগরিমার জায়গাগুলো নিরর্থক অহংবোধে আক্রান্ত। ফলে সর্বক্ষেত্রে সাহস বীর্যশালী ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রগুলোতে ইতিবাচক হলেও মনন ও মেধায় স্থির লক্ষ্যে পৌঁছুনোর ব্যাপারে কুণ্ঠিত। নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাত্তর এর যে বোধ রয়ে গেছে তা হলো ভৌগলিক অর্থে স্বাধীনতা। একাত্তরে ভৌগলিক যে স্বাধীনতা প্রাপ্তি তা পরবর্তী দেশপ্রেমে ঠিক ততটা গুরুত্ববহ ও প্রবল হয়ে ওঠেনি। চিন্তার স্বাধীনতায় ভারসাম্য তৈরি হয়নি কখনো প্রবলভাবে। বোধ করি সে কারণে আমরা এখনো কিছুটা পশ্চাতে অবস্থান করছি। কী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষেত্রে, কিংবা বিশ্বের বিবিধ দেশে আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। আরো এগিয়ে এসে বলা যায়, এশিয়াভুক্ত অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় আমরা দেশ পরিচালনা ও আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে অনেক অর্জন করেও অনেক পিছিয়ে। এ সমস্ত পশ্চাদপদতার কিছু কারণ আছে বলে মনে হয় ;

এক. আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশও গঠন করেছি কিন্তু চরম মূল্যে প্রাপ্ত স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার ও রক্ষায় ততটুকু মনোযোগী হতে পারিনি।

দুই. ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক আকল্পকে ভেঙে স্বাধীনতাকে ভোগ করেছি আনন্দের উপকরণে। নাগরিক হিসাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে বিনিময়ে কোনো কিছু প্রদানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থেকেছি।

তিন. যে বোধ ও প্রেরণার উৎস স্থল থেকে স্বাধীনতাকে তৈরি করেছি অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ ও সাংস্কৃতিক তৎপরতায় এতে উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারিনি।

চার. রাষ্ট্রের মূলভিত্তি সেক্যুলার দর্শনের আওতাভুক্ত হলেও সেক্যুলারিজম রাষ্ট্রধর্ম নির্বিশেষে পালিত হয়নি।

উপনিবেশ উত্তর আমাদের ভাবনা চিন্তা ছিল প্রতিটি বাঙালির স্বপ্ন হবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ এবং উর্বর মননে বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলো পরিবর্তিত হবে। মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র যুগোপযোগী হবে। স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের কাছে জনগণের এ প্রত্যাশাও অযোক্তিক নয়, কারণ যে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাঙালির উন্মেষ, তাতে এরকম চাওয়াটা দোষের কিছু নয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের যে সাহসিক চেতনা ও গরিমা দিয়ে বাঙালি আত্মমর্যাদাশীল জাতিতে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত, সে চেতনা আজ অবহেলিত বিবিধ রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে। স্বাধীনতা উত্তর বাঙালির রাজনীতি আজ দুরাচারে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল বা সংসদের শ্যাডো ডেমোক্রেটিক দল জনগণের জন্য কোনো কাজ করে না। নিজেদের দলবাজি ও ক্ষমতাসীন হওয়ার দৌঁড়ঝাপে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত। আজকাল রাজনৈতিক দলের মেনিফেস্টোতে থাকে নানাবিধ লোভ দেখানো পরিবর্তনের অঙ্গিকার। যাকে ইদানীংকালে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র মেরামত। নিজেদের মেরামতে নজর না দিয়ে রাষ্ট্র মেরামতে আন্দোলন শুরু করেছে সংসদের তৃতীয় প্রভাবশালী দল। আমরা ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এবং ৭১ এর যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে বীরের জাতি রূপে পরিচিত করেছি। এ অর্জন কেবল রাজনীতির প্রবল সদর্থক ব্যবহারের কারণে সম্ভব হয়েছে। আজ রাজনীতি বলতে কদাকার কুৎসিত লোভী মানুষের গুচ্ছ চিত্র ভেসে ওঠে। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের কোথায় অবস্থান জনগণ টের পেয়ে গেছে। মুখে গণতন্ত্রের সশ্রদ্ধ বুলি, বুদ্ধিতে দখলদার স্বৈরাচারী একরোখা রাজনীতির দৌরাত্ম্য। না দলের ভিতরে না আচরিত দেশনীতি ও সমাজনীতির উপর তার কোনো শুভ প্রভাব পড়ছে। দেশের এরকম একটি চিত্র যে কেউ অনায়াসে খাড়া করে দিতে পারেন। তাহলে উপনিবেশকে আঘাত করে, তাদের আধিপত্যকে অস্বীকার করে, যে দেশ আমরা পেয়েছি তাতে জনগণ কিংবা দেশের কী লাভ হলো? একাত্তর এর ভৌগলিক স্বাধীনতা কেবল আমাদের প্রাপ্তি ছিল না, এতে জড়িয়ে ছিল আমাদের অফুরন্ত সম্ভাবনা। আমাদের সাহিত্য, চিত্রকলা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি উর্বর হবে। অথচ আজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে মদদ পুষ্ট হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। সমাজ সেবার নামে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদেশী সাহায্য সংস্থা ও এনজিও। ভোলেন্টারী সার্ভিসের নামে ইউরোপীয় কায়দায় এখানেও গড়ে উঠছে বিভিন্ন সেবা সংস্থা। সমাজ গুরুদের মধ্যে ঔপনিবেশিক শিক্ষা দীক্ষার প্রসার। শিক্ষার নামে অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণির শিক্ষকের সমবায়ে অজস্র কলেজ স্কুল কিন্ডার গার্টেন প্রতিষ্ঠাসহ তরুণতরুণীদের ভুলভাল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। এসমস্ত হলো স্বাধীনতা উত্তর অর্জনের ইস্তেহার! প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাত্তোর বাঙালি সংস্কৃতিকে প্রাকঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। কিছুটা সাংস্কৃতিক কর্মীদের কারণে, কিছুটা দ্বিধা বিভক্ত রাজনীতির অসম ক্ষমতা ও দম্ভের ফলে। শিল্প সাহিত্য উত্তরণের ক্ষেত্রে ৮০ এর মধ্যভাগে এসে সঠিক জায়গা বেছে নিতে সমর্থ হলেও একুশ শতকের প্রারম্ভে এসে তাকেও দোটানায় গড়াতে হচ্ছে। আমাদের কথাসাহিত্য, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ সাহিত্যে স্বাধীনতার স্বপক্ষে যে আচরিত জীবন রোধের ক্ষেত্রগুলো বিস্তৃত হতে চলেছে, সে জায়গায় পরিণত বীজ না ফলানোর আগে কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার পরের দুই দশকের শুরুতে যজমান তরুণরা বাঙালি জাতিতত্ত্বের ঘরানা থেকে কবিতা, গল্পকে বুর্জোয়া শ্রেণি চরিত্রের ঘেরাটোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা পূরণে সামিল হচ্ছিল। এ কাজ তারা করছে প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত। এ জায়গায় নতুন করে উদ্দীপক হচ্ছে নিম্ন বর্গীয় মানুষ, তাদের আশাআকাঙ্ক্ষা, সুখদুঃখ এবং আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা। এটিই স্বাধীনতার উদ্দীপক হওয়া উচিত। এ তো গেলো শিল্প সাহিত্যের অবধারণাগত বিন্যাস। স্বাধীনতা উত্তর আমাদের অর্থনীতিও যুৎসই কোনও জায়গায় দাঁড়াতে পারেনি। বাঙালি দুটো ঔপনিবেশের মধ্যে থাকলেও অর্থনীতির কাঠামোগত অবস্থানে বাঙালির কোনও অংশগ্রহণ ছিল না। ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণভাবে তাদের কল্যাণে নিয়োজিত, পাকিস্তানও অনুরূপ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে গ্রাস করেছিল বাঙলার চা, পাট ও চামড়া সম্পদ। ঔপনিবেশোত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে জাগরণের সম্ভাবনা ছিল, তাও অপসৃয়মান প্রায়। হাতেগোনা জায়েন্ট কিছু বড় কোম্পানীর কাছে আমাদের অর্থনীতি জিম্মি হয়ে আছে। সে কারণে হায়ে না ভূতুড়ে অর্থনীতির উপর পুরো জনগোষ্ঠীর ভাগ্য জড়িয়ে আছে। আর্থসামাজিক মুক্তি বলতে যে চিত্র সচরাচর আমরা বুঝে থাকি, তা থেকে অনেক দূরে আমাদের অবস্থান। স্বাধীনতাত্তোর আমাদের দেশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী হয়েছে সত্যি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে অনেক বেকার যুবকযুবতীর কর্মসংস্থানও হয়েছে এবং হচ্ছে, কর্ম পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। তারপরও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিজ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় আমরা পুরোপুরি এই শিল্পে সফলতা পাইনি। সফলতা আসেনি যোগ্য লবিস্ট নিয়োগের অভাবে। অন্য যে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তাদের অবস্থাও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচিএর মতো অবস্থা। ইদানীং নতুন সংকটের মুখে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্র। পর্যাপ্ত ডলার যোগান দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকগুলো এল সি খুলতে পারছে না। ব্যবসাবাণিজ্য শূন্যের কোঠায়। অন্যদিকে শ্রেণিকৃত ঋণ প্রত্যেক ত্রৈমাসিক হিসেবে বেড়ে চলেছে হু হু করে। ব্যাংকগুলো আশংকাজনকভাবে অবিশ্বাসের জায়গায় চলে যাচ্ছে। একথা স্মর্তব্য যে পাশ্চাত্য শিল্প বিপ্লবের পর বিভিন্নভাবে পুঁজিকে তারা ব্যবহার করেছে। যখনই পুঁজি কোনও জায়গায় মুষড়ে পড়েছে, তখনই তারা পুঁজির খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে। পশ্চিমের সামাজিক ডিসকোর্সে আজকাল উত্তর পুঁজিবাদ প্রসঙ্গ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। এই ডিসকোর্স আধুনিক পুঁজির ব্যবহারকে স্বীকার করেও তার নতুন বিন্যাস ও ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এই উত্তর পুঁজিবাদ অবশ্যই বৃহত্তর অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের অবস্থান। বৃহৎ উদ্যোক্তার সঙ্গে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার একটি যোগসূত্র স্থাপন। সেই সঙ্গে উত্তর পুঁজিবাদে আজকাল বিশ্বায়নের আরো একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে বিশ্বায়ন মানে বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় সকলের অংশগ্রহণ। একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে পুঁজি বিনিয়োগ না হয়ে তা হবে বিশ্বের নানান জায়গা থেকে এবং তা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হবে অঞ্চল ভিত্তিক সামর্থ্যের উপর। আমরা অনুরূপ কোনও পুঁজির কথা হয়তো, এ মুহূর্তে ভাবতে পারবো না তথাপিও আমাদের যা পুঁজি আছে তার যথার্থ ব্যবহারে কেন্দ্র ও প্রান্তের সঠিক নির্ণয়ে যথোপযুক্ত স্থানে ব্যবহারে হয়তো সুফল পাবো। তবে অবশ্যই তা পাশ্চাত্য আঙ্গিকে নয়। মৌলিক চাহিদার আবশ্যিকতা বিচারে তা গ্রহণ করতে হবে । তা হলে এই নিবন্ধে এই বিবেচনায় কি আনা যায়, বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকে মহীয়ান করার জন্য আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কলুষযুক্ত করে উপনিবেশ মুক্ত হয়ে আরো একবার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি। ভৌগলিক অর্থে নয়, মনোজগতের অসুস্থ উপনিবেশকে সমূলে কুঠারাঘাত করে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চায় হাজার বছরের বাঙালি ঘরানাযেখানে অপেক্ষমান আগামী প্রজন্ম আমাদের দীপ্ত উত্তরাধিকার।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগরতলা মামলার আসামী মুক্তি সংগ্রামের বিস্মৃত নায়ক মানিক চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকাশ্যে এলেন ‘আইটেম গার্ল’ ববি