আইডি কার্ড

মোহছেনা ঝর্ণা | শুক্রবার , ৩১ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

অল্পবয়সী লোকটার মুখের ভাষার ছিরি দেখে আমি তবদা খেয়ে গেছি। এরকম একটা ঝকঝকে অফিসে বসে কারও মুখ দিয়ে নর্দমার গন্ধযুক্ত ময়লার মতো অশ্রাব্য শব্দ বের হতে পারে এই অফিসে না আসলে আমার জানাই হতো না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলার সাথে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শেষে ভদ্র মহিলা যখন রাগ করে বেরিয়ে গেলো তখন অল্পবয়সী লোকটার পাশের মধ্যবয়সী লোকটা বললো, ‘ওই বেডি একটা বেশ্যা। এজন্যই জামাইর ভাত খাইতে পারে নাই।’

লোকটার মুখে এই জঘন্য কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল আমার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি যে কোনো সময় অজ্ঞান হয়ে যাবো। অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়। আমিও বোধহয় কিছুক্ষণের জন্য পাথর হয়ে গেছিলাম। সংবিত ফিরে পেলাম পাশের একজনের হালকা ঝাঁকুনিতে। আমার নাম ধরে ডাকছিল অল্পবয়সী লোকটা। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার বিশ্রী মুখটাকে আরও বিশ্রী করে বললো, ‘কানে শুনেন না? কানে কি তুলা লাগাই আসছেন?’

পাথর চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। তারপর কিছু না বলে বিড়বিড় করতে করতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, এটা সামনের ওনাকে দেন। আমি আমার হাতে টাকা জমা দেওয়ার রিসিটটা দেখিয়ে বলি, ‘এই কাগজটা লাগবে না?’ জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, ভুল করে ফেলেছি। জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি।

কিন্তু ততক্ষণে ধনুক থেকে তীর ছুটে গেছে। লোকটা খেঁকিয়ে উঠে বললো, ‘বেশি কথা বলেন কেন?’

মনে মনে বলি, কথাই বললাম একটা। সেটাই বেশি হয়ে গেলো! একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভাবি একটা জীবন কেবলই আপোষের!

আমি মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি সামনের মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঘরভর্তি মানুষ। এই দুইটা লোক একটু পর পর একে ধমক দিচ্ছে, ওকে বকা দিচ্ছে। দুই একজন পড়ালেখা না জানা মানুষ সাইন করতে পারছে না, কাগজে কি লিখা তা পড়তে পারছিল না বলে তাদের তুলোধুনা করছিল তারা। কিন্তু কেউ কোনো শব্দ করছিল না। কারণ কেউ টু শব্দটি করলে ভোগান্তি নাকি আরও বাড়বে। কেউ একজন বললো, যেই মহিলাকে গালি দিচ্ছিল তিনি নাকি ওদের একটা ভুল নিয়ে জেরা করছিল। আর তার পরিণতি হচ্ছে তার কাজটাতেও অনেক প্যারা খেতে হয়েছে আবার পেছনেও বিশ্রী ভাষায় অশ্লীল গালাগালি শুনতে হয়েছে। এই সমস্ত জটিলতার কারণে সবাই মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। এখানে অনেকে সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছিল, অনেকে খুব ক্লান্ত। এদের ক্লান্তি দেখার কেউ নেই। মানুষের সুখ, দুঃখ, ক্লান্তি, শ্রান্তি বোঝার জন্য মনুষত্ব্যবোধ লাগে। এখানে কোনো মানুষ নেই।

ভাড়াটিয়া জীবনটা আমার যাযাবরের মতো লাগে। পরিযায়ী পাখিও বলা যায়। শিকড় গজাতে না গজাতেই শিকড় উপড়ানোর যন্ত্রণা। শিকড় উপড়ানোর পাশাপাশি এবার আমার ডালপালাও ভেঙে শেষ। ভোটার আইডি কার্ড খুঁজে পাচ্ছি না। পাচ্ছি না তো পাচ্ছিই না। পুরো ঘরের সব জিনিস তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। এরকম তন্নতন্ন করে খুঁজলে ১০৮ টা অমরাবতী ঠিকই পাওয়া যেতো, কিন্তু আমার আইডি কার্ডটা পাইনি। আর তখনই সব রাগ চড়ে গেছে রেজাউল ভাইয়ের উপর। বাসা পালটানোর সময় বারবার বলে দিয়েছিলাম আমার কিছু যেন নষ্ট না হয়, রেজাউল ভাই তার ভ্যানগাড়ি নিয়ে এসে বললো, আফা, যেমনের জিনিস তেমনেই পাইবেন। খালি টাকাটা একটু বাড়াই দিয়েন।

টাকা বাড়িয়ে নিয়েছে কিন্তু আমার সব জিনিসের হাড়কবজা ভেঙে একাকার। নতুন বাসায় ওঠার পর থেকে এটা পাচ্ছি না, ওটা পাচ্ছি না। পাক্কা দুই মাস লেগেছে মোটামুটি একটা পর্যায়ে আসতে। এরমধ্যে ভোটার আইডি আর কিছুতেই পাচ্ছি না। ভোটার আইডি কার্ড ছাড়া এখন আমি ডানা ভাঙা পাখি। যে কাজই করতে যাই ভোটার আইডি কার্ড লাগবে। ব্যাংকে একাউন্ট করবো ভোটার আইডি কার্ড লাগবে, বিকাশে একটা একাউন্ট খুলবো সেখানেও আইডি কার্ড লাগবে। বাচ্চার স্কুল ফর্ম ফিল আপ করবো সেখানেও ভোটার আইডি কার্ড ছাড়া হবে না। এত্তগুলা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ঝুলে যাচ্ছে এক ভোটার আইডি কার্ডের অভাবে। এলাকার কমিশনার কার্যালয়ে গেলাম। বলে প্রথমে ভোটার আইডি কার্ড হারানোর জন্য একটা জিডি করে নির্বাচন কমিশনারের অফিসে যান। ছুটির দিন ছাড়া দৌড়ানোর উপায় নাই। শনিবারে ঠা ঠা রোদ মাথায় নিয়ে থানায় গিয়ে জিডি করে আসলাম। জিডির কাজটা দ্রুত হয়ে যাওয়ায় বেশ শান্তি শান্তি লাগলো। কী এক অজ্ঞাত কারণে থানা, পুলিশ বিষয়গুলো আসলেই আমার অস্বস্তি হয়। মনে হয় কাজ বুঝি আরও জটিল হয়ে গেলো।

জিডির কপি নিয়ে গেলাম নির্বাচন কমিশনার অফিসে। অফিসে ঢুকতেই বড় একটা ছাতিম গাছ। দুপুরের কড়া রোদেও চারপাশটা এত শান্ত, মায়াবী দেখাচ্ছিল। অফিসটাও বেশ সুন্দর। সিঁড়িগুলো পরিষ্কার। সাধারণত সরকারি অফিসগুলোয় গেলে অফিসের ভগ্ন দশা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। এখানে কিন্তু একেবারেই বিপরীত। ঝকঝকে টাইলস। বেশ আলো বাতাস। সিঁড়িগুলাও চওড়া। অভ্যর্থনা কক্ষ নামে একটা কাউন্টারের সামনে গিয়ে আইডি কার্ড হারানোর কথা বলতেই ভেতরের লোকটা বললেন, ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে আসেন। এবার ব্যাংক খোঁজার পালা। নিউমার্কেট গিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে আসতে আসতে বিকাল হয়ে গেলো। আজ আর হবে না। পরদিন সকালে গিয়ে আইডি কার্ড এর ফটোকপি জমা দিয়ে বসে আছি। আমার সাথে বসে আছে আরও অনেকেই। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ডাক এলো। তারপর বললো, ‘বিকালে আসেন।’ আমি বলি, ‘বিকালে কেন? এখন দিতে সমস্যা কোথায়?’ লোকটা চোখ পাকিয়ে কপাল কুঁচকে আরও কয়েকটা কাগজ দেখিয়ে বললো, আপনার আগেও মানুষ আছে। আমি ঘড়িতে সময় দেখি মাত্র এগারটা বাজে। বিকাল মানে নির্ঘাত তিনটা হবে। আরও পরও নিশ্চয়ই হতে পারে। চারঘন্টা সময় এখানে নষ্ট করার মতো এতো বেকার সময় হাতে নেই। আবার একবার গিয়ে আরেকবার এতটা পথ পেরিয়ে আসবো, মন সায় দিচ্ছিল না। তাই খুবই নরম গলায় বললাম, ‘আগামীকাল সকালে আসি আমি?’

এবার ভদ্রলোক তার হাতের কাগজটা আমার সামনে বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তাহলে সকালে এসে এটা জমা দিয়েন। তারপর কালকে বিকালে আবার আসবেন।’ আমি বুঝি না আমাকে দু’বার কেন আসতে হবে? একবারে কাজটা হলে সমস্যা কি? কিন্তু কথা বাড়াই না। কারণ এই লোকগুলোর ভাষা সম্পর্কে ধারণা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। গাড়ি ভাড়ার শ্রাদ্ধ করে বিকেলের রোদটা নরম হওয়ার আগেই আমি আবার আসি কার্ড নিতে। আমার সাথে আরও অনেকেই থাকে অপেক্ষমান চেয়ারগুলোতে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ডাক আসে আমার। মধ্যবয়সী লোকটা কম্পিউটার বাটন চেপে তারপর ড্রয়ার খুলে আমার দিকে একটা খাম বাড়িয়ে ধরলেন। লোকটার সামনে দাঁড়িয়েই খাম খুলে দেখি, আমার ভোটার আইডি কার্ড। এবার একেবারে স্মার্ট কার্ড। কার্ডটা হাতে নিয়ে মনে হলো, এই অমূল্য রতন আমি কেমন করে করবো যতন!

বিকালের নরম রোদে আইডি কার্ড নিয়ে রিকশায় বাতাস খেতে খেতে বেশ ফুরফুরে মুডে বাসায় ফিরে এলাম। বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে বেশ কিছু ছবি তুলে আইডি কার্ড টা যত্ন করে আলমারিতে রাখতে গিয়ে মনে হলো, এই কার্ড আলমারিতে না, ব্যাংকের লকারে রাখতে হবে। কারণ গয়নাগাটি খোয়া গেলে তা টাকা থাকলেই পুনরায় উদ্ধার করা সহজ। কিন্তু আইডি কার্ড আরেকবার যদি হারায় এটা উদ্ধার করতে আবার মৃত্যু দুয়ার ঘুরে আসতে হবে। একটা মানুষ কয়বার মৃত্যু দুয়ার ঘুরে আসতে পারে! আলমারিতে বেশ কিছু ফাইলপত্র আছে। কোনটা প্রয়োজনীয় আর কোনটা অপ্রয়োজনীয় এটা দেখার জন্য একটু সময় নিয়ে বসা দরকার। কিন্তু সময় আর করে উঠতে পারছি না। কয়েকটা ফাইল খুলে দেখি কিছু প্রয়োজনীয় কাগজের পাশে কিছু কাগজ খুবই এলোমেলো হয়ে আছে। মনে হচ্ছিল বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয়। ফেলে দেওয়ার আগে আরেকবার চেক করার জন্য নিচে নামিয়ে দেখতে গিয়ে আমি ভূত দেখার মতো চমকে যাই। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। দুঃখে আমার গলা ছেড়ে কান্না চলে আসছিল। মনে হচ্ছিল, হায় জীবন! জীবন এত পান্ডুর কেন? জীবন এত্ত রসিকতা কেন করবে আমাকে নিয়ে? হায় কপাল! পুরনো টাইপের ফাইলের ভেতর ফ্রিজ, আইপিএস, ওভেনের ক্যাটালগ আর দর্জির দোকানের রিসিটের ফাঁক গলে আমার পুরনো আইডি কার্ডটা আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের কাছে সরকারের উন্নয়ন তুলে ধরতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধআম্মার ঘরদোর