অ্যাডভোকেট ননী দাশগুপ্ত : মানবহিত ব্রতে সমর্পিত যে জীবন

সুভাষ দে | শনিবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

বিগত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে চট্টগ্রাম ছিলো অগ্নিগর্ভ। মাস্টারদা সূর্য সেন এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম-আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র চট্টগ্রাম। তৎকালীন ভারতবর্ষের কংগ্রেস, মুসলিমলীগ, বিপ্লববাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারা প্রায়শই চট্টগ্রামে জনসভা, কর্মীসভা করেছেন। সাহিত্য, সংগীত ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্বাধীনতা ও মানবমুক্তির পথকেই অবারিত করছিলো। এই সময় চট্টগ্রামের তরুণদের দেশপ্রেম ও জাগরণী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। পটিয়ার সন্তান ননী দাশগুপ্ত সে মন্ত্রে দীক্ষিত হন তরুণ বয়সে। বিশেষত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। সেই পথকেই জীবনের ধ্রুবতারা মানলেন।
অ্যাডভোকেট ননী দাশগুপ্ত ১ জানুয়ারি ১৯২৭ ইংরেজি, বুধবার পটিয়া থানার ঐতিহ্যবাহী কেলিশহর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতামহ কেলিশহর গ্রামের প্রথম ফার্সিভাষা অভিজ্ঞ আইনজীবী। তাঁর পিতা চট্টগ্রাম ফৌজদারী আদালতের একজন বিশিষ্ট ব্যবহারজীবী সতীশ দাশ। মাতা প্রফুল্লবালা দেবী।
বাল্যকাল থেকেই তিনি খুব মিতভাষী ও লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। কিশোর বয়সে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন এবং জেএম সেন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চট্টগ্রাম কলেজে কলা বিভাগের একজন কৃতী ছাত্র হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। কলেজে অধ্যয়নকালীন চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি রাম মনোহর লোহিয়ার অনুসারী ও অন্যতম প্রিয় শিষ্য চট্টগ্রামের কমরেড দীনেশ দাশগুপ্ত, অধ্যাপক পুলিন দে, যতীন্দ্র মোহন রক্ষিতের সংস্পর্শে আসেন এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় সোশ্যালিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় কর্মীতে রূপান্তরিত হন। ত্রিশের দশকে তিনি তাঁর অগ্রজ ও নিকটাত্মীয় কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় নেতা কমরেড পুর্ণেন্দু দস্তিদার এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতা ও কৃষক নেতা কমরেড চিত্তপ্রিয় দাশ চৌধুরীর সমাজ উন্নয়ন ও মানুষের মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রামের ধারায় স্বদেশের হিতব্রতে নিয়োজিত হন।
চট্টগ্রাম আইন কলেজে ভর্তি হন কিন্তু আকস্মিকভাবে তাঁর অগ্রজ ভ্রাতার মৃত্যু ও পিতার অবসর তাঁকে আইন কলেজ ত্যাগে বাধ্য করে এবং তিনি মোক্তারশিপ পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। পঞ্চাশের দশকের প্রথম পর্বে তিনি চট্টগ্রাম কোর্টে আইন ব্যবসায় যোগদান করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন সৎ, মানবদরদী বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি পান। চট্টগ্রাম কোর্টের ফৌজদারী আদালতে নির্লোভ, আদর্শবান ব্যবহারজীবী হিসেবে তিনি তৎকালীন সময়ের সিনিয়র আইনজীবীদের কাছেও প্রিয় ছিলেন। ফৌজদারী আদালতের আইনজীবী প্রয়াত মোজাফফর আহমদ, রমনী চক্রবর্তী, জোৎস্না চৌধুরী প্রমুখ তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁর সমসাময়িক অনেক আইনজীবী যেমন ব্যারিস্টার এসএইচ খান মিল্কী, অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান, অ্যাডভোকেট হিমাংশু বিমল ঘোষ প্রমুখ সবাই তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ষাটের দশকের মধ্যভাগে তিনি চট্টগ্রাম আদালতে আইন ব্যবসায় খুবই সুনাম অর্জন করেন এবং একই সাথে তিনি সমাজ ও মানুষের বিবিধ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর গ্রামের সার্বিক উন্নয়নে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন। তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আমলে (অধুনা বাংলাদেশ) কেলিশহর ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সদস্য এবং পরে গ্রামের জনসাধারণের প্রচুর সমর্থন পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি পরপর চারবার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। দীর্ঘকাল এই পদে থেকে তিনি কেলিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম আধুনিকায়নের কাজ শুরু করেন। তাঁর আমলেই ঐ স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়। তিনি কেলিশহর উচ্চ বিদ্যালয়েরও পরিষদীয় সম্পাদক ছিলেন। কেলিশহরে প্রতিষ্ঠা করেন দাতব্য হাসপাতাল, বিভিন্ন জনসেবা কেন্দ্র। এইসব উন্নয়নের মাধ্যমে গোটা পটিয়া অঞ্চলে ও চট্টগ্রামে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও নির্যাতিত মানুষের দরদী বন্ধু হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের বিপ্লবী কেলিশহরের সন্তান প্রমোদ চৌধুরী ও কৃষ্ণ চৌধুরীর ভাস্কর্য স্থাপনে প্রধান উদ্যোক্তা। ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান।
দীর্ঘ চব্বিশ বছর ব্যাপী গ্রামীণ জীবনের, সমাজের উন্নয়ন ও সংস্কার, সমাজ প্রগতির পথে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও জনসেবায় নিজেকে সর্বাত্মক সমর্পণের কথাটুকু আজো পটিয়া অঞ্চলের তথা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তাঁর আদর্শ ও কর্মযজ্ঞের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ স্বরূপ এই প্রতিষ্ঠানগুলো আজো বিদ্যমান। তিনি পটিয়া রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, হিন্দু ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ব্যক্তি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম উপদেষ্টা ও নেতৃস্থানীয় ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিমনস্ক একজন মানুষ। তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন তাঁরা তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছেন খুবই একজন নিকটাত্মীয় ও আদর্শবান হিসেবে। মিতভাষী এবং সুমধুর ব্যবহার, গ্রামের দুঃখী ও দুর্বল মানুষের প্রতি তাঁর সহজাত মানবিকবোধ ও আকর্ষণ ছিল সমানভাবে। তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে এমন কি অবসরকালীন মানুষ ও সমাজ ছিলো তাঁর একান্ত আরাধ্য। যে কারণে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের আদর্শের দিকে তাঁর ছিল নিবিড় অথচ সরল উপলব্ধি ও একাগ্রতা। জীবনের শেষদিনটিও তিনি কাটিয়েছেন এই বোধকে সঙ্গী ও অনুসরণ করে।
তাঁর ছিলো বর্ণাঢ্য জীবন। কৃতি ও কৃতিত্বে ভাস্বর। উপমহাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বদেশবাসীর হিতব্রত সম্পাদনের বিপুল কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিবেদন করে অ্যাডভোকেট ননী দাশগুপ্ত চট্টগ্রামের মানসলোকে দীপ্তি ছড়ালেন, অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকলেন। গত ১৯ নভেম্বর ২০২২ তিনি পরলোক গমন করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের কাজগুলোই একমাত্র কালের সাক্ষী
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে