অস্থির বিশ্ব : লোকের প্রাণ যেখানে মূল্যহীন

অনুপ দাশ গুপ্ত | বুধবার , ৩০ মার্চ, ২০২২ at ১১:০০ পূর্বাহ্ণ

অবিশ্বাসের পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে, রাশিয়া কি আমেরিকার কোনো ধরনের আশ্বাসের উপর ভর করে আলোচনায় বসবে? ন্যাটোর সম্প্রসারণ বন্ধের কথা ছিলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ন্যাটো কেউ কথা রাখে নি! এরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাশিয়ার আক্রমণ বন্ধের চিন্তা করা নিতান্তই অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছুই নয়। কথায় আছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়,উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ইউক্রেনের অজস্র সাধারণ ও নিরীহ জনগণের প্রাণহানি এখন সেই প্রবাদটির কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই গোটা বিশ্বে মানুষের জীবন এমনিতেই গত দুবছরে করোনার মতো অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বিপর্যস্ত। মহামারির প্রকোপ কমতে না কমতেই বিশ্ব এখন আবার নতুন আরেকটি সংকটের মুখোমুখি। জোর ও জুলুমই হয়ে উঠেছে এখনকার বিশ্ব পরাশক্তিধর দেশগুলোর মূলমন্ত্র। যার করুণ পরিণতি হচ্ছে বর্তমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের প্রভাব কি শুধু ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি আরো আরো বহু কঠিন অর্থনৈতিক যুদ্ধ, স্নায়ু যুদ্ধ, শরণার্থী বা বাস্তুহারা ক্ষুধার্ত মানুষের জীবন যুদ্ধের জন্ম দেবে? তা অবশ্য সময়েই বলে দেবে। এ প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনির নির্বাসিত বিখ্যাত কবি, নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর ও ফিলিস্তিনির জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের একটা কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেলো-‘যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে/ নেতারা হাত মেলাবে/ বৃদ্ধ তাঁর শহীদ সন্তানের ফিরে আসার জন্য পথ চেয়ে, অপেক্ষা করতেই থাকবেন,/ মেয়েটি অপেক্ষা করবে তাঁর প্রিয়তম স্বামীর জন্য/ আর তাঁর সন্তানেরা অপেক্ষা করবে তাদের বীর বাবার জন্য/ আমি জানি না, কে আমাদের জন্মভূমিটাকে বেচে দিয়েছিলো/ কিন্তু আমি দেখেছি, তার দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে কাকে?’( নির্বচিত মাহমুদ দারবিশ, হায়াৎ মামুদ)। কী নিদারুণ উচ্চারণ! ইউক্রেনের মানুষকে আজ কার দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে? এই জিজ্ঞাসা আজ সারা বিশ্বের সমস্ত বিবেকবান জনতার! অস্ত্র, সন্ত্রাস ও লোভের অক্টোপাস জালে আজ বিশ্বের বিবেক নিথর নির্জীব ও অন্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী নোয়াম চামস্কি সম্প্রতি দেশটির অনলাইন সংবাদ মাধ্যম-‘ট্‌রুথআউট’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘বৃহৎ শক্তিগুলো অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। ইন্দোচীনে মার্কিন যুদ্ধ ও ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনের ধ্রুপদী উদাহরণ: যেখানে এরা এমন সব অপরাধ করেছে, যে ধরণের অপরাধের জন্য নুরেমবার্গে নাৎসিদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ছোট রাষ্ট্রগুলোও বড়দের ছত্রছায়ায় সুযোগ পেলে একই কাজ করছে। যেমন ইসরাইল অবৈধভাবে সিরিয়ার গোলান মালভূমি ও বৃহত্তর জেরুজালেম দখল করেছে। ওয়াশিংটন শুধু তা এড়িয়েই যায় নি, প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ডোনাল্ড ট্রাম তা অনুমোদনও করেছেন। আন্তর্জাতিক আইন কাঠামোর প্রতি পরাশক্তিগুলোর এমন অবজ্ঞা এত হরহামেশা ঘটছে যে, এসব এখন অনেকেরই গা-সওয়া হয়ে গেছে’। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে আজ প্রায় একমাস হতে চললো, এই চলমান যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়-ক্ষতি এই মুহূর্তে হিসেব করা না গেলেও তার পরিণতির আঁচ এখন থেকেই দৃশ্যমান হওয়া শুরু করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞরা এইও মত দিচ্ছেন যে, রাশিয়া হয়তো পারমানবিক বোমাও ব্যবহার করতে পারেন। যদি তাই হয় তাহলে তার পরিণতি হবে আরো ভয়াবহ। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন পারমানবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তার ভাবগত অর্থ হচ্ছে-‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোন অস্ত্র ব্যবহৃত হবে জানি না। কিন্তু চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হবে লাঠি ও পাথর। তিনি এও বলেছিলেন- ‘আমি কেবল শান্তিবাদী নই, আমি একজন উগ্রশান্তিবাদী। যে কোনও যুদ্ধ দুষ্টু চক্রকে বৃহত্তর করে তোলে যা মানবসমাজের উন্নতির ধারাকে ব্যাহত করেৃ..আমাদের সন্তানদের শান্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করে সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে শিক্ষিত করে তুলতে হবে’ (আলবার্ট আইনস্টাইন ও তাঁর মানবিক সত্তা, স্বামী তথাগতানন্দ, পৃ:১৩৮)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে আমেরিকা যখন প্রথমবার পারমানবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটাল, তখন আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল শঙ্কিত হয়ে বলেছিলেন, ‘সর্বনাশ হয়ে গেল, যে দানবের আজ জন্ম হলো, সেটি একদিন মানবসভ্যতার সব কিছু ধ্বংস করে ফেলবে’। মার্কিন প্রেসিন্ডেন্ট এস ট্‌রুম্যান ১৯৪৫ সালের ২৫ জুলাই নিজ ডায়েরিতে পারমানবিক অস্ত্র সম্পর্কে যে মন্তব্য লিখেছিলেন, সেটির উল্লেখ পাওয়া যায় বিখ্যাত সোভিয়েত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাইকেল চোসুডোভস্কির রচনা-‘টুওয়ার্ডস আ ওয়াল্ডওয়ার-থ্রি সিনারিও’ গ্রন্থের সপ্তম পৃষ্ঠায়। টরুম্যান যা লিখেছিলেন তার ভাবার্থ হচ্ছে, মনে হতে পারে সবচেয়ে ভয়াবহ জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু এটাকে কার্যকর করা যেতে পারে?’। হ্যাঁ, যদিও পারমানবিক বোমা ব্যবহারের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল।
এই পৃথিবী থেকে রোগ-শোক, ক্ষুধা-দারিদ্র, অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর করে শান্তির পৃথিবী সামনের দিকে অগ্রসর হবে, সেটাই ছিল শান্তিকামী মানুষের চাওয়া। পশ্চিমা বিশ্বসহ আমেরিকা কিছুদিনের মধ্যে সবকিছু ভুলে গেল। ন্যাটো জোট সম্প্রসারিত হতে লাগলো। ন্যাটো জোটের ১২ টি দেশ থেকে ৩০টি দেশে তাদের সম্প্রসারণ ঘটল। ওয়ারশ জোটের প্রায় সবগুলো দেশ ও তদানিন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনটি দেশ লিথুনিয়া, ইস্তেনিয়া ও লাটভিয়াকে ন্যাটো জোটের অন্তর্ভূক্ত করল। আমেরিকা ও পশ্চিমার সম্প্রসারণ নীতি আগ্রাসী রূপ ধারণ করল।
ন্যাটোর শুরুরটা ছিল ৪ মার্চ ১৯৪৭ সালে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে ‘ট্রিটি অফ এলায়েন্স অ্যান্ড মিউচুয়েল এসিস্ট্যান্স’ নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি বা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ আক্রমণ ঠেকাতে এই টেরিটরির জন্ম। পরবর্তীতে ৪ এপ্রিল ১৯৪৯ সালে এটির নামকরণ করা হয় নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজেশন। ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হলে ওয়ারশ প্যাক্ট অকার্যকর হওয়া শুরু হয় এবং ১ জুলাই ১৯৯১ সালে একে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ওয়ারশ প্যাক্ট ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা যদিও গুরুত্ব হারায়, কিন্তু পুঁজিবাদী ও আগ্রাসী যুক্তরাষ্ট্র কখনই ন্যাটোকে বিলুপ্ত করার চিন্তাতো করেইনি, বরং দিন দিন আরও শক্তিশালী করে পূর্বদিকে এর আওতা বাডাতে থাকে। সোভিয়েত পতনের ধাক্কা সামলে যখন রাশিয়া আবার ক্রমে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী হতে থাকে তখন থেকে তাদের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ন্যাটোর আগ্রাসী ভূমিকার সমালোচনা করতে থাকে এবং রাশিয়া নিজের আত্মরক্ষার জন্য তার পাশ্ববর্তীদেশ ইউক্রেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভূক্তি হতে চাওয়াকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। আর এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি, যিনি ছিলেন এক সময়ের কৌতুক অভিনেতা, তাঁর শাসনকালই আজ ইউক্রেন পুতিনের অমানবিক হত্যা যজ্ঞের শিকার।
একটা সময় ছিল রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা ’মা’, ‘পৃথিবীর পথে’, ‘পৃথিবীর পাঠশালা’ ইত্যাদি পড়ে রাশিয়ানদের জীবন ও সমাজ নিয়ে ভাবতাম ও স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করতাম। এরপর রুশ দেশের উপকথা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। একে একে পরিচয় হয় রুশদের মানবিক লেখক পুশকিন, দস্তভয়স্কি, তলস্তয়, নিকোলাই গোগল, মায়াভর্স্কি, ইয়েসিনিন, বুনিন, বুলগাকভ, চেখভ, ব্রদস্কি, ভজনিসেন্সকি সহ আরো কত লেখকের অমর কাজের সঙ্গে। তার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরের উপলব্ধিতে আসে ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যের মতো রুশ সাহিত্যের বিশালতা এবং অমরত্ব। তারপর পরিচয় ঘটে যুদ্ধবিরোধী মানবিক ছবি ‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, যা সত্যজিৎ রায়ের করা অমর একটি শিল্প। সংস্কৃতির সার্বজনিন আবেদনময় কাজগুলো একটা মানুষের, একটা জাতির ভেতরের সৌন্দর্য বোধ থেকে আসে বলেই বিশ্বাস করি ও করতাম। যেরকম এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষে বিশ্বাস করে। তা নাহলে ইউক্রেনীয় জাতি এই তো ২৪ ফেব্রুুয়ারি’২২ এর আগে বিশ্বাসই তো করতে পারেনি তাদের জ্ঞাতি ভাইয়েরা তাদের উপর এরকম নির্মম আক্রমণ করবে! ঐতিহাসিককভাবে ইউক্রেনীয় আর রুশরা পরস্পরের জ্ঞাতি। ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির বন্ধনও খুব দৃঢ। তাইতো কালজয়ী লেখক নিকোলাই গোগল রুশ না ইউক্রেনীয়এ নিয়ে এখনও বিতর্ক চলমান।
এতকিছুর পরেও ইউক্রেন ও রাশিয়ার ইতিহাস বড়ই বেদনা বিদূর। ২০১৪ সালের ২৯ অগাস্ট, এলনাভিস্ক যুদ্ধের দিন। যে যুদ্ধে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে ৩৬৬ জন যোদ্ধাকে হত্যা করেছিলো রুশ সৈন্যরা। হলডোমার সোভিয়েত ইউক্রেনেরই অংশ ছিলো। যেখানে ক্ষমতাশীনদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেছিলো লক্ষ লক্ষ ইউক্রেন অধিবাসী। বেনিন ইয়ার হচ্ছে কিয়েভের একটি গিরিখাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে জার্মান নাৎসি বাহিনী হত্যা করেছিলো প্রায় চৌত্রিশ হাজার জুইসকে। সাম্প্রতিক সময়ের ইউক্রেনের আলোচিত কবি ও অনুবাদক হলেন ‘ইয়া কিভা’। এই কবি ২০১৪ সালে মিলিটারিদের রোষানলে পড়ে নিজ শহর ছেড়ে এখন বসবাস করছেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভেতে। তাঁর মর্মস্পর্শী একটা কবিতা সারা বিশ্বের মানুষকে অনুরণনিত করেছে, কবিতাটির কয়েকটি লাইন পড়ে দেখা যাক -‘এখানে একটি দেশ, মনে করিয়ে দিচ্ছে চেরনোবিলের কথা/মনে করিয়ে দিচ্ছে হলডোমোরের কথা/ বেবিন ইয়ারে, ভিন্নমতে, জ্বলছে রক্তবর্ণ তারা/ একটি কুঠার স্বর্গবে ঝুলছে বিক্ষত গলায়/ অথচ দীর্ঘ লাইনে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি ক্যাশ বাক্সের জন্য’।
অমানবিক যুদ্ধবিগ্রহময় এ পৃথিবীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে জন লেনন একদা উদাত্ত কন্ঠে গেয়েছিলেন,’ গিভ পিস আ চান্স’! (শান্তির সুযোগ দাও)।এ বিশ্বে শান্তি ফিরুক, জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন,’ সন্ত্রাস ও যুদ্ধের উদ্দেশ্য নাকি কেবলই যুদ্ধ ও জুলুমের’। তাই জগদ্বিখ্যাত লেখক লিও তলস্তয়ের বিখ্যাত উপন্যাস,-‘যুদ্ধ ও শান্তি(ওয়ার এন্ড পিস)’-এর ভাষায় বলতে চাই, ‘প্রত্যেকে যদি নিজস্ব বিশ্বাসের জন্য লড়াই করেন, তাহলে পৃথিবীতে আর যুদ্ধ হবে না’। আমরা বিশ্বাস করি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার মতো দেশগুলো রাষ্ট্রীয় ও আদর্শের পেছনে রক্ত না ঢেলে, তাদের নাগরিকদের নিজস্ব জগত ও বিশ্ব মানবতার জন্য শান্তির নীড় তৈরিতে তাদের মেধা ও মনন ঢালছেন। জোর জুলুমের পথ থেকে ফিরে এসে মানবজাতি ও সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধআগে পুনর্বাসন চায় পরে উচ্ছেদ