অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ

শঙ্কর প্রসাদ দে | শুক্রবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

কাঠালছড়ি শরণার্থী ক্যাম্পে বাবা একটি প্রাইমারী স্কুল খুলেছিলেন। বাবা ভিয়েতনামের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, যুদ্ধ কয়েক বছর প্রলম্বিত হবে। সুতরাং প্রতিকূল পরিস্থিতি হলেও পরবর্তী প্রজন্মের হাতে যতদূর সম্ভব শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়া দরকার। বাবার ভবিষ্যতবাণী মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে।

জুনের শেষ দিকে এসে মুক্তিযুদ্ধ স্তিমিত হয়ে এসেছিল। বর্ষা নেমে আসায় গেরিলারা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। নিয়মিত বাহিনীর জন্য বর্ষা মওসুম এমনিতে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এরূপ পরিস্থিতিতে বাবা বলেছিলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেকেই পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনে রাজি হবে। মেজ কাকার মত ছিল, কয়েকজন নেতা দেশে ফিরে গেলেও বেশির ভাগ নেতার ফিরে যাওয়ার পথ নেই। কনফেডারেশনের চিন্তা কোনও বিকল্পই হতে পারে না।

এককোটি শরণার্থীর সমস্যা কনফেডারেশনে সমাধা হবে না। প্রায় নব্বই লাখ হিন্দু শরণার্থী হওয়ায় পাকিস্তান খুশী ছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থক জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও ভূমি দস্যুরা খুশী হয়েছিল। হিন্দুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবার সময় ধরে নেয়া হয়েছিল, হিন্দুরা আর দেশে ফিরতে পারবে না। মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই ক্ষুদ্র অংশ ধরেই নিয়েছিল, সময়ের ব্যবধানে হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি ভাগ করে নেয়া যাবে। সুতরাং শরণার্থীদের নিজ দেশে রেখে কনফেডারেশন পন্থীদের বিরুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। খন্দকার মোশতাককে জাতিসংঘে যেতে না দেয়া এর প্রমাণ। মেজ কাকার মন্তব্য সঠিক ছিল।

মেজ কাকা মনে করতেন, যুদ্ধ বছর তিনেক প্রলম্বিত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে যদি চীন ও আমেরিকা সরাসরি সৈন্য নিয়ে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে হাজির হতে পারে। বাবা মনে করতেন, ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে সরাসরি সৈন্য নামাবে না। ভিয়েতনামের লাগোয়া বড় কোনও মিত্র শক্তি ছিল না। অথচ বাংলাদেশ রণাঙ্গনের পাশেই রয়েছে বিশাল ভারতবর্ষ। বাবার মত সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকা ও চীন সরাসরি সৈন্য প্রেরণ থেকে বিরত ছিল।

জুলাই- আগস্টের দিকে ডায়রিয়া, ডিপথেরিয়া, ধনুষ্টংকার, টাইফয়েড, মেনিনজাইটিস সহ জটিল কিছু রোগে শরণার্থী ক্যাম্পগুলো এক একটা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। মেজ কাকা মনে করতেন, যুদ্ধ ডিসেম্বর জানুয়ারীতেই শেষ করা উচিত। নচেৎ শিশু ও কিশোরদের অর্ধেকাংশ মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ছোট ভাই লালন ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। তখন গভীর রাত। আমার গায়েও তখন ১০৩ ডিগ্রী জ্বর। গভীর জঙ্গলে শশ্মান। দাড়িয়ে ভেবেছি, মেজকাকার বক্তব্যই সঠিক। এখন ভাবি সত্যিই যদি যুদ্ধ আর এক বছরও প্রলম্বিত হতো তবে শরনার্থীদের মধ্য থেকে হারিয়ে যেতো আরো দশ লক্ষ শিশু, কিশোর ও বয়োবৃদ্ধ।

অধীর মামা অপারেশন শেষে ফেরার পথে একবার কিছুক্ষণের জন্য আমাদের দেখে গিয়েছিলেন। এই অল্প সময়েও সে কাঁদছিল। কারণ তাদের আক্রমণের মুখেও হানাদাররা কয়েকজন বোরকাপড়া নারীকে উলঙ্গ করে জীপে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এ কাহিনী ছিল নিত্য নৈমিত্তিক। অধীর মামা কাঁদার অন্যতম কারণ ছিল, ঐ মেয়েগুলোর মধ্যে ১ জন ছিল তার বাল্যবন্ধুর রূপসী বোন। মেজ কাকার মন্তব্য ছিল, যুদ্ধ যদি বছর তিনেক প্রলম্বিত হয় তবে বাংলার মাটিতে অন্তত ৩০ লক্ষ যুদ্ধ শিশুর জন্ম হবে। বাঙালি জাতিসত্তাই ঝুঁকির মুখে পড়বে। তখন হয়তো পাকিস্তানী আর গোলাম আযমরা বলতো বাঙালি এমনিতে পাক্কা মুসলমান নয়। এই যুদ্ধ শিশুদের দিয়েই খাটি মুসলিম বাঙালি সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। কাকার এই ভবিষ্যবাণী সত্য হবার সম্ভাবনাই বেশি ছিল।

জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন, নয়াদিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন সরদার শরণ সিং ও আঁন্দ্রে গ্রোমিকো। ৯ আগস্ট ১৯৭১। গ্রোমিকো শুধু বললেন, ভারত-সোভিয়েত এই মৈত্রীচুক্তি উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। সরদার শরণ সিং কোনও কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসলেন। এ খবর ওয়াশিংটনে পোঁছামাত্রই গভীর রাতে নিক্সন নিরাপত্তা নেতৃত্বদের ডাকলেন। বৈঠকে কেউ কিছু বললো না।

১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পর নিঙনের প্রকাশিত আত্মজীবনী, ‘হোয়াইট হাউস ইয়ারস্‌’ বই থেকে জানা যায়, নিক্সনের মনে হয়েছিল এটি একটি ‘বোম শেল চুক্তি’। বাবা বলেছেন সর্বাত্মক যুদ্ধ অবধারিত। মেজ কাকা বলেছেন, এখন আমেরিকা সরাসরি বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে সৈন্য নামাতে চাইবে। দ্বিমত করে বাবার মন্তব্য ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনীর দক্ষতা আমেরিকা এখনো ভুলেনি। সরাসরি সৈন্য নামানোর মতো গুরুতর ভুল আমেরিকা করবে না। এরপরও যদি আমেরিকান সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয় তবে এবার আরো ১ কোটি মুসলমান শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেবে। বাবার এই ভবিষ্যতবাণী সত্য হবার সম্ভাবনা ছিল। ২৪ অক্টোবর ১৯৭১। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ইন্দিরা গান্ধী আভাস দিলেন’ দেশে ফিরলে সর্বাত্মক যুদ্ধের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

বিদ্যুৎ গতিতে এ খবর ভারতব্যাপী রটে গেল। মেঝ কাকা এবং বাবা দু’জনেই একমত হলেন’ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অতি নিকটবর্তী। ফেরার পথে ইন্দিরা গান্ধী প্যারিস থামলেন। জনকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাবা বলেছিলেন, নেহেরু কন্যা না হলে, শান্তিনিকেতনে পড়ার সুবাধে রবীন্দ্রনাথের শিষ্য না হলে এমন সাহস দেখানোর মতো ক্ষমতা পৃথিবীতে আর কারো নেই।

নভেম্বরের শেষ দিককার ছবি। সাব্রুম সীমান্ত জুড়ে খোড়া হচ্ছে শত শত ব্যাংকার। ২৯ তারিখের দিকে দেখলাম সবার সামনে সারিবদ্ধ পদাতিক বাহিনীর সীমান্ত বরাবর দীর্ঘ কলাম। বাংলাদেশ ও ভারতীয় সৈন্যদের পোশাক প্রায় একই রকম হওয়ায় চিনার সুযোগ ছিল না। বাবা বলেছেন যদি কোনও গ্রুপে পাগড়ীওয়ালা দেখ, ধরে নেবে এরা ভারতীয় আর যাদের কাঁধে রাইফেল জাতীয় হালকা অস্ত্র দেখ, ধরে নেবে এরা বাংলাদেশ আর্মি। পদাতিক বাহিনীর পিছনে ব্যাংকার। এরপরে সেনা জীপ ও ট্রাকের লাইন। এরপরে দেখেছি নানা ধরনের অস্ত্রপাতি নিয়ে অনেকগুলো ট্রাক। সামরিক ভাষায় এওলো ছিল লজিস্টিক ডিপার্টমেন্ট। জরুরি ভিত্তিতে ব্রীজ কালভার্ট তৈরি ও মেরামতের জন্য এগুলো যুক্ত ছিল। এরপরে দেখেছি অনেকগুলো খাদ্যবাহী ট্রাক। ঐ বয়সেও দেখে বুঝেছি, যুদ্ধক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক খাদ্য সরবরাহের জন্য এই ট্রাকগুলো যুক্ত হয়েছে। সর্বশেষ রেডক্রস চিহ্ন খচিত মেডিক্যাল টিম ও ট্রাক। তবে একটি ট্যাঙ্কও দেখিনি। কারণ রামগড় সীমান্ত দিয়ে কোনও ট্যাংক হামলা চালানো হয় নি।

৩ ডিসেম্বর অপরাহ্ন। সীমান্তের ওপার থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, রামগড় শহর জনশূন্য। পাকিস্তানীদের নড়াচড়া নেই। এসব দেখে সন্ধ্যাবেলা ক্যাম্পের সবাই রেডিওকে ঘিরে বসলো। আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হচ্ছিল, পাকিস্তান ভারতের ৬টি বিমান ক্ষেত্রে হামলা চালিয়েছে। মেঝ কাকা বললেন, রামগড় থেকে হানাদাররা পিছু হটেছে। সম্ভবত, চট্টগ্রাম শহরের দিকে চলে গেছে। রাতে বাবার ঘুম নেই। পরদিন সকালে দেখি প্রতিবেশী আরো কয়েকজনকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। সাব্রুম থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব বুনো পথে মাইল দশেকের মতো। সন্ধ্যার পর ফিলে এলেন সবাইকে নিয়ে। বাড়ির ঘরের কথা জিজ্ঞেস করতেই হু হু করে কেঁদে ফেললেন। শুধু এটুকু বললেন, আমাদের বাড়ি ঘরের কোনও চিহ্নই নেই। আমাদের আবার নতুন করে ঘর বাঁধতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী

পূর্ববর্তী নিবন্ধগৌরবদীপ্ত অনন্য এক দিন
পরবর্তী নিবন্ধবিজয় দিবসের প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক ধারা