গৌরবদীপ্ত অনন্য এক দিন

বাসুদেব খাস্তগীর | শুক্রবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এ দিনটির দেখা পেতে আমাদের লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে দীর্ঘ নয়টি মাস। বিজয়ের এই দিনটি ধরা দিতে নয় মাসের যুদ্ধের আগে অনেক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে ধাপে ধাপে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে পৃথিবীর অনেক দেশের স্বাধীনতা এসেছে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। আলোচনা ও সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে পশ্চিমা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে এদেশের মুক্তিকামী বাঙালিরা অস্ত্র ধরেছিলো। শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বোপরি স্বাধীনতা সংগ্রামের এ লড়াই ছিলো অনিবার্য একটা ঘটনা।

সুতরাং আমাদের এ বিজয় সব দিক থেকে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। এ মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল প্রকৃত অর্থে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। সে শুরু হওয়া লড়াই অনেক পথ পেরিয়ে শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে। এই সমাপ্তির রেখা বাঙালির ললাটে পরিয়েছিলো বিজয়ের মুকুট। ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এই ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৭১ সালে বাঙালিরা একজোট হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

যার মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সুদীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ ও ত্রিশ লাখ বাঙালির জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের দিনটি আসে। এর সাথে যোগ হয় দু’লক্ষ মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনের মত জঘন্যতম ঘটনাও। তাই লক্ষ লক্ষ প্রিয় মানুষের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা, লক্ষ নরনারীর ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা, কোটি মানুষের অশ্রু বিসর্জনে পাওয়া এ স্বাধীনতা আমাদের কাছে সবচেয়ে গৌরবের ধন।

আমাদের প্রাণের প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন করতে যাঁরা জীবন দিয়ে গেলেন দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রতিদান এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা হতে পারে। অনেক কিছু হারিয়ে ফেলার বেদনায় সিক্ত আমাদের স্বাধীনতা। সুদীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা মানুুষের অনুভূতিটি কী রকম ছিলো সেদিন- তা কি আমরা উপলব্ধি করতে পারি? কেউ কেউ হয়তো সেই উপলব্ধিকে খুব হৃদয় দিয়ে এখনও চিন্তা, চেতনা ও মননে লালন করেন। কোনো মা হয়তো তার বিজয়ী ছেলের ঘরে ফেরার আনন্দে দিশেহারা হয়েছিলো, কোনো ভাই তার ভাই ফিরে আসার আনন্দে উল্লাাসে ফেটে পড়েছিলো। তাদের সে উপলব্ধি মুক্তিপাগল সকল মানুষেরই ছিল প্রাণের অনুভূতি। আবার কারো কারো অনুভূতি ছিলো বেদনার কালো মেঘে ঢাকা ; অশ্‌রুসজল চোখের আকুতিতে ভরা।

কোনো মা তাঁর বুকের ধনকে হারিয়ে বিজয়ের আনন্দে ভেসেছে কান্নাঝরা অশ্‌রুজলে। পিতা ও ভাই হারানোর তীব্র যন্ত্রণা কিংবা স্বামীহারা কোনো বধূর বিজয়ের আনন্দতো সকল আনন্দের সাথে এক হয়ে আনন্দ ছড়ায় না। সেখানে আনন্দ আছে, সে আনন্দতো দেশের স্বাধীনতা পাবার আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে কিছু বেদনা ভুলে থাকার নীরব কষ্টকে হৃদয়ে ঠাঁই দেয়া। তাই আনন্দ বেদনার সংমিশ্রণে গড়া আমাদের একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। অভূতপুর্ব এক পাওয়ার দিন হচ্ছে বিজয়ের এই দিন। বিজয়ের আনন্দের মাঝেই আছে আরো দুঃখ বেদনার নিদারুণ এক ইতিহাস। বিজয়ের ঠিক দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর এদেশের সূর্যসন্তান শত শত বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে ভয়ংকর নির্যাতন করে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানি বাহিনি ও তাদের এদেশীয় রাজাকার আলবদররা। তাই বিজয়ের দিনটিতেও অনেক বুদ্ধিজীবীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গিয়েছিলো। তাই বিজয়ের এই দিন আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত হৃদয়ে রক্তক্ষরণেরই একটি দিন। এই বিজয় দিবস প্রতিবছর আমাদের জীবনে ফিরে ফিরে আসে।

একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা ব্যবস্থা সমৃদ্ধ ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠন করার যে মহান প্রত্যয় নিয়ে এ স্বাধীনতা অর্জন করতে দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ করে বিজয়ের মত গৌরবদীপ্ত দিনকে আমরা পেয়েছিলাম, সেদিনের এ আদর্শগুলোকে সামনে রেখে আমাদের পথ চলতে হবে। এজন্য বিজয় দিবস জাতির জীবনে স্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। অর্থনৈতিক মুক্তি, শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে জয়ী হবার দিন বিজয় দিবস।

আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে রক্ষা করার দিন এই বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে যে ডাক দিয়েছিলেন তাঁর ডাকের মধ্যেই প্রকৃত স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়ে গিয়েছিলো। তারপর সে বীজ ধীরে ধীরে নানা ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা করে ১৬ ডিসেম্বর বাংলার পূর্বাকাশে রক্তিম সূর্য হয়ে উদিত হয়েছিলো।

এজন্য বিজয়ের দিনটিতে আমরা অনুপ্রাণিত হই আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের কথা অনুভব করে। আমরা ফিরে যাই স্মৃতির পাতায় অতীত স্মৃতি রোমন্থনে। এই বিজয়ের দিন অগ্রগতির পথযাত্রায় আমাদের সহযাত্রী করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার দেশটি বিজয় দিবসের গৌরবে নতুন প্রেরণায় প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখে।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধঅসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ