অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু প্রত্যাশিত নয়

বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২২

সৈয়দ মোহাম্মদ জাহেদুল হক | বৃহস্পতিবার , ১০ মার্চ, ২০২২ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

“কিডনি সুরক্ষা ও রোগ প্রতিকারের একমাত্র উপায়- জনসচেতনতা” এবং “অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু নয়” হোক আমাদের প্রত্যয়ে “কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা” বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২২ উদযাপন করতে যাচ্ছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, ১৮ কোটি জনসংখ্যার এই বাংলাদেশে ২ কোটিরও অধিক মানুষ কোনো-না-কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। মরণব্যাধি কিডনি রোগের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রতি বছর অগণিত মানুষ অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছে। প্রিয়জনকে বাঁচাতে মৃত্যুর দিনক্ষণ পর্যন্ত চিকিৎসার পেছনে ছুটতে বাধ্য থাকে ভুক্তভোগী পরিবার। প্রবাদ আছে : “কিডনি রোগী মরেও যায়, মেরেও যায়”। বাস্তবে আমৃত্যু চিকিৎসার ভার সয়বার সাধ্য ধনী, মধ্যবিত্ত বা হতদরিদ্র কারো নেই। এমন বাস্তবতায় আমাদের অদম্য প্রত্যয় “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”। কিডনি রোগের দুষ্প্রাপ্য, ব্যয়বহুল চিকিৎসায় ভুক্তভোগী এবং নির্মম বাস্তবতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে অর্থাভাবে চিকিৎসাবঞ্চিত হতদরিদ্র কিডনি-রোগী ও ভুক্তভোগী পরিবারের বুকফাটা বোবাকান্না ও নির্মম কষ্টের আওয়াজ সরকার, সামর্থ্যবান ও মানবিক সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে সর্বজনীন সহযোগিতা ও উদ্যোগের মাধ্যমে জীবন রক্ষার প্রয়োজন বোধ থেকে প্রতিষ্ঠা করা হয় “কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা”।
৬৮ হাজার গ্রামবাংলার অগণিত হতদরিদ্র কিডনি রোগী চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করছে। অপর দিকে সীমিত সাধ্যের গুটিকয়েক কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস অর্থাভাবে মাঝপথে বন্ধের কারণে ব্যাপক হারে কিডনি রোগীর মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। কোনো একক ব্যক্তি বা পরিবারের পক্ষে কিডনি রোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসা সামাল দেয়া সম্ভব নয়। ক্রমবর্ধমান কিডনি রোগী ও মৃত্যুর হার কমাতে প্রয়োজন রাষ্ট্রের যথোপযুক্ত পদক্ষেপ ও মানবিক সমাজের সহযোগিতা। বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২২ উপলক্ষ্যে দেশের ২ কোটিরও অধিক কিডনি রোগীর দাবি ও প্রত্যাশা পূরণে চিকিৎসক, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব, ব্লাড ও অঙিজেন ব্যবস্থাপনা, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, ন্যায্যমূল্যে ডায়ালাইসিস, ঔষধসহ সমন্বিত প্রচেষ্টায় কিডনি-রোগীদের চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। লক্ষ্য অর্জনে স্বাস্থ্যবিষয়ক দপ্তর, এনজিও, মানবিক সংগঠন, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ও দেশ-বিদেশের সহযোগিতায় রোগীদের বিড়ম্বনামুক্ত সাশ্রয়ী মূল্যে, বিনা মূল্যে চিকিৎসার সু-ব্যবস্থার মাধ্যমে জীবন রক্ষার এক অদম্য প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে আসছে “কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা”। মূলত জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও মানবিক সহযোগিতা।
(১) কিডনি সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় জনসচেতনতা :- এ উপলক্ষ্যে ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, ক্যান্সার, থেলাসেমিয়া, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার, পাইলস, গ্যাষ্ট্রিক, লিভার ডিজিজ, হৃদরোগ, প্যারেলাইজডসহ মাতৃত্বের গর্ভ ও প্রসবকালীন সচেতনতা ইত্যাদি ক্রমবর্ধমান রোগসমূহের প্রতিকারমূলক প্রাথমিক ধারণা (প্রযোজ্য শ্রেণির) পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা হলে অনায়াসে ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে জনসচেতনতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচার সকল রোগের উৎপত্তির মূল উৎস। এসব জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যাবলি প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনসাধারণের অসচেতনতা, অসাবধানতা, রোগের লক্ষণ সম্পর্কে ধারণার অভাব, রোগ প্রতিকারক ও আক্রান্ত রোগীর করণীয় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানের যাবতীয় তথ্যাবলি সম্প্রচারে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ।
(২) বিদ্যমান ক্লিনিক ও হাসপাতালসমূহে স্বল্পমূল্যে মানসম্মত ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু ঃ পরিসংখ্যানমতে, দেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ২ কোটিরও অধিক মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। তার উপর প্রতিবছর ৪০ হাজারেরও অধিক মানুষ যু্‌ক্ত হচ্ছে কিডনি বিকলের তালিকায়, যা খুবই উদ্বেগজনক। এই বিশাল সংখ্যক কিডনি-রোগীর তুলনায় চিকিৎসা-সুবিধা, চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী, চিকিৎসা উপকরণ ও মেশিনারীজ সল্পতা-সংকট রোগীর চিকিৎসা প্রাপ্তির পথে মূল প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে চুড়ান্ত পর্যায়ের রোগীদের জীবন রক্ষার অন্যতম অবলম্বন মানসম্মত ডায়ালাইসিস সেন্টার অপ্রতুল। তাই দরিদ্র ও হতদরিদ্র রোগীদের সামর্থ্যের মধ্যে বিদ্যমান হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে মানসম্মত ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন সময়ের দাবি।
(৩) অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু নয়ঃ প্রবাদ আছে ‘কিডনি রোগী মরেও যায় মেরেও যায়’। অসম্ভব ব্যয়বহুল এ-রোগের চিকিৎসা মৃত্যুর দিনক্ষণ পর্যন্ত। এমন বাস্তবতায় ডাক্তার ভিজিট, টেস্ট রিপোর্ট ফি, রিপোর্র্ট পর্যবেক্ষণ ফি, ফেষ্টুলা স্থাপন, ডায়ালাইসিস, কিডনি প্রতিস্থাপন ব্যয় ও ওষুধের উচ্চমূল্যসহ কিডনি চিকিৎসায় সর্বক্ষেত্রে ব্যয়হ্রাসে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ। এ লক্ষ্যে জীবনরক্ষাকারী ডায়ালাইসিস মেশিন, ডাইলেজার ও ডায়ালাইসিস উপকরণসহ যাবতীয় ওষুধ, যন্ত্রপাতি ও মেশিনারীজ সরঞ্জাম দেশি বিদেশি অংশীদারীত্বে দেশে উৎপাদন এবং জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির উপর যাবতীয় আমদানি শুল্ক মওকুফ করে চিকিৎসাব্যয় কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ।
(৪) জনবহুল এলাকায় শৌচাগার স্থাপন :- প্রস্রাবের চাপ দীর্ঘমেয়াদি চেপে রাখা-অভ্যাসে পরিণত হলে কিডনি তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একজন পুরুষ যতটা সহজে শোভন কিংবা অশোভনভাবে পয়-প্রস্রাব ত্যাগের সুযোগ নেয়, একজন মহিলার পক্ষে তা কখনো সম্ভব নয়। ফলে মহিলা কিডনি রোগীর সংখ্যা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, শৌচাগার একদিকে মানবসেবা অপরদিকে লাভজনক ব্যবসাও বটে। সে বিবেচনায় উপজেলা থেকে শুরু করে জেলাশহর পর্যন্ত প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক জনবহুল এলাকায় সরকারি, স্থানীয় সরকার, এনজিও, মানবিক, সামাজিক উদ্যোগে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নির্মাণ কিডনিসহ নানাবিধ রোগ প্রতিকারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
এছাড়াও সব ধরনের ওষুধের প্যাকেট ও পাতার গায়ে ওষুধের দাম মুদ্রণ, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন বন্ধ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রয়ের উপর কঠোর নজরদারি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাসহ ব্যাথানাশক ও এন্টিবায়োটিক সেবনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ বাধ্যতামূলক করণ। সর্বসাধারণের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্বাস্থ্যবীমা প্রচলনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির বিষয়ে সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অন্যান্য সাধারণ অবদান রাখতে সহায়ক হবে।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সরকারি উদ্যোগ, মানবিক সমাজের মনোযোগ, নাগরিক সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যখাতে শৃঙ্খলা ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ হতে পারে স্বাস্থ্যও চিকিৎসা-ট্যুরিজমের জন্য সারা বিশ্বের রোল মডেল।
লেখক: সভাপতি, কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংগ্রামী সৈনিক সেই আমি
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল