অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে পরিকল্পিত উদ্যোগ জরুরি

| বৃহস্পতিবার , ১৯ মে, ২০২২ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশে অশান্তিঅস্বস্তির খবর যেমন প্রতিনিয়ত শুনতে পাই, তেমনি সুখবরও আসে মাঝে মাঝে। বর্তমানে সরকার যে খবরটি আমাদের শোনাচ্ছে, সেটি হলো জিডিপি নিয়ে। আগামী বাজেটের চেহারাও ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২৮২৪ ডলার। গেল অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তবে এই সুখবর দিয়েই পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ক্ষান্ত দেননি। তিনি বলেছেন, ‘এটা ঠিক যে সব মানুষের আয় সমানভাবে বাড়ছে না। বৈষম্য বাড়ছে। মাথাপিছু আয় এটি গড়ের হিসাব। তবে এখন মানুষ খালি পায়ে থাকে না। প্রত্যেকের হাতে মোবাইল আছে, গায়ে জামা আছে। এগুলোই প্রমাণ করে মাথাপিছু আয় বাড়ছে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু এসব যুক্তি নয়, আরও অনেক যুক্তি দিয়ে ড. আলম প্রবৃদ্ধির হারকে যৌক্তিক করার প্রয়াস পেয়েছেন। দৃশ্যত এসব যে ঘটছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন তাদের কথাও আমলে নিতে হবে, যাতে দুই ধরনের মূল্যায়নের মধ্যে একটা ‘গোল্ডেন মিল’ পাওয়া যায়।

বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সামপ্রতিককালের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত হয় বেশকিছু সূচকের ঊর্ধ্বগামী গতিধারা। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীতে টানেল, তৃতীয় পায়রা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম। এছাড়াও জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, সর্বোপরি গড় আয়ু বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বার্তাই প্রকাশ করে থাকে। দেশের এ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাঝেও যে তথ্যটি একটি নেতিবাচক অবস্থার জানান দেয় তাহলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। ধনীদরিদ্রের আয় ও সম্পদ বৈষম্য, জেন্ডার বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য ইত্যাদি। ধনীদরিদ্রের আয় ও সম্পদ বৈষম্য পৃথিবীব্যাপী আজ এক আলোচিত বিষয়। ধনীদরিদ্রের বৈষম্য পরিমাপক আন্তর্জাতিক পদ্ধতি জিনি সহগের মান অনুসারে বর্তমানে আমাদের দেশের বৈষম্য স্তর রেড জোনের খুব কাছাকাছি। দেশে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বহুতল বিশিষ্ট সুউচ্চ অট্টালিকা, রাস্তায় নামিদামি বিভিন্ন মডেলের গাড়ি, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ির দিকে বাড়ানো ভিক্ষুকের হাত আর ফুটপাতে ঘুমানো মানুষের সংখ্যা। অর্থনৈতিক এ বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে সামাজিক অপকর্ম এবং অসামঞ্জস্যতা। দরিদ্র মানুষ শুধু অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিতই হচ্ছে না, শিকার হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিকূল অবস্থার।’

অর্থনীতিবিদরা বলেন, অর্থনীতির প্রকৃত উন্নয়ন দেখতে হলে বণ্টন ব্যবস্থায় ন্যায্যতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে দেশের আর্থিক খাতে সুশাসন ফেরাতে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বর্তমান অবস্থা থেকে আর্থিক উত্তরণে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত ইতোপূর্বে চারটি পথের সন্ধান দিয়েছেন। তিনি বলেন, আর্থিক মন্দা থেকে প্রভাবমুক্ত হতে হলে সরকারের ব্যয় সংকোচন, সরকারিবেসরকারি ঋণ পুনর্গঠন, ধনীর সম্পদ গরিবদের মধ্যে পুনর্বণ্টন ও নগদ টাকা ছাপানো যেতে পারে। এ চার কর্মপদ্ধতি অর্থনীতির তুলনামূলক মসৃণ উত্তরণ ঘটানোর শ্রেষ্ঠ পথ। বাজার অর্থনীতির সমালোচনা করে আবুল বারকাত বলেছেন, ঋণগ্রস্তরা যখন ঋণ ফেরত দেয়ার অবস্থায় থাকছেন না, তাদের দেনা বাড়ছে। তখন ঋণ প্রদান করা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ছে। ঋণ প্রদান একসময় সম্পদ হিসেবে গণ্য হতো, এখন সেটি বোঝা। অন্যদিকে ঋণগ্রহীতাও ফেরত দিতে চাইলেও সেটি পারবেন না। কারণ তার সম্পদ বা মজুদের মূল্য কমেছে। আবার ক্রেতাও তেমন নেই। ফলে সবাই মিলে সম্মিলিত এক বিপদের মধ্যে পড়বেন। বাণিজ্য চক্রের এ বিপদ পুঁজিবাদী বা বাজার অর্থনীতির সহজাত বিষয়।

যতই দিন যাচ্ছে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। এই বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি যে, দেশে এখন তিন কোটি দরিদ্র জনসংখ্যা রয়েছেযা মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। করোনাকালে এই হার আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমাজ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা সম্ভব না হলে এই বৈষম্য কমবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগ জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে