অর্থনীতিতে নোবেল- শিক্ষা ও আয়ের সম্পর্ক

ড. নারায়ন বৈদ্য | সোমবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতা পূর্ব এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সন্তানদের প্রথম শিক্ষা দেয়ার জন্য তথা হাতেখড়ি দেয়ার জন্য একটি ছোট পুস্তক ছাড়া অন্য কোন পুস্তক ছিল না। এ পুস্তকটির নাম ছিল ‘বাল্যশিক্ষা’। পুস্তকটির গায়ে লেখকের নাম লিখা আছে ‘রামসুন্দর বসাক’। কথিত আছে, বাংলা সাহিত্যের গদ্যের জনক ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালী জাতির ভবিষ্যৎ বংশধরদের যথাযথ প্রারম্ভিক শিক্ষা বা হাতেখড়ি দেবার জন্য ‘বাল্যশিক্ষা’ পুস্তকটি লিখেছিলেন। তিনি পুস্তকটি তাঁর দীর্ঘদিনের ভৃত্য রামসুন্দর বসাকের নামে ছাপিয়েছিলেন এ বলে যে, এ পুস্তক থেকে প্রাপ্ত রয়েলিটি দিয়ে রামসুন্দর যেন অবশিষ্ট জীবন নির্বাহ করতে পারে। অবশ্য এ বিষয়টি আমি এ যাবৎকালে কোন গ্রন্থে পায়নি। যতটুকু মনে পড়ে, এ বাল্যশিক্ষা নামক পুস্তকে একটি বাক্য আছে যে, ‘পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। পুস্তকটি শেষের দিকে একটি পৃষ্ঠায় সুন্দর একটি বাড়ির পাশে মা ও ছেলের ছবি দিয়ে নীচে লিখা আছে- মা ও ছেলের কথোপকথন। ছেলে মাকে জিজ্ঞাস করছে- মা, ঐ বাড়িটি কার? মা ছেলেকে বুঝিয়ে বলছে যে, ঐ বাড়িটি একজন বিত্তশালীর যিনি লেখাপড়া করে বিত্তশালী হয়েছেন। কাজেই এখানে একটি মৌলিক বিষয় প্রকাশ পায়। সেটা হচ্ছে শিক্ষার সাথে আয়ের সম্পর্ক আছে।
প্রায় একশো বছর পর বাল্যশিক্ষার এ জ্ঞান ধারার ন্যায় শিক্ষা ও আয়ের মধ্যে সম্পর্ককে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০২১ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন অর্থনীতিবিদ। এ তিন অর্থনীতিবিদ প্রমাণ করেছেন যে, শিক্ষার মেয়াদের সাথে আয়ের সম্পর্ক আছে। অর্থনীতিতে অবদানের জন্য ২০২১ সালে যে তিন অর্থনীতিবিদ একত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা হলেন ডেভিড কার্ড, জোশুয়া ডি অ্যাংরিষ্ট ও গুইডো ডব্লিউ ইমবেনস। ডেভিড কার্ড, কানাডা বংশোদ্ভুত একজন মার্কিন নাগরিক। তিনি ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন ‘শ্রম অর্থনীতি’তে তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ অবদানের কারণে। সামাজিক বিজ্ঞানের অনেক বড় বড় প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ কার্য-কারণ সম্পর্ক নিরূপণে গলদঘর্ম হয়। যেমন অভিবাসন ও মজুরীর মধ্যে যদি সম্পর্ক স্থাপন করা হয় তবে তা নিরূপন করা কঠিন ব্যাপার। আবার শিক্ষার ডিউরেশন বা মেয়াদ মানুষের ভবিষ্যৎ আয়ের মধ্যে কোন প্রভাব ফেলে কিনা তা নিরূপন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। এ সব বিষয়ে গবেষণার নির্দিষ্ট কোন মানদন্ডও থাকে না। অভিবাসন যদি কম হয় অর্থনীতিতে তা কী প্রভাব ফেলে। অথবা কোন শ্রেণি বা গোষ্ঠী পড়াশোনা বেশিদিন চালিয়ে না গেলে কী প্রভাব পড়তে পারে তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। অথচ ২০২১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা দেখিয়েছেন, অভিজ্ঞতাভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ সব বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব। এবারের নোবেল বিজয়ীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে একটি উদাহরণের সাহায্যে বুঝানো যায়। যেমন- একটি নতুন উদ্ভাবিত ঔষধের কার্যকারিতাকে সাধারণত পরীক্ষা করা হয় এভাবে। একই ধরণের লক্ষণযুক্ত রোগীদের মধ্যে এক দলকে নির্দিষ্ট ঔষধটি দেয়া হলো। অন্যদলকে দেয়া হলো না। এ অবস্থায় ঔষধ প্রয়োগকারী দলের মধ্যে কয়জন ভাল হলো আর ঔষধ প্রয়োগ করা হয়নি দলটির মধ্যে কয়জন ভাল হলো, এ দুয়ের মধ্যে তুলনা করে ঔষধটির কার্যকারীতা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তে আসা যায়। অনুরূপভাবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা দেখিয়েছেন আকস্মিক ঘটনা বা নীতিগত পরিবর্তনের কারণে কিছু মানুষের জীবনে ভিন্ন কিছু ঘটছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণের মধ্যেই উত্তর পাওয়া যাবে। যেমন- নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠী তাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মেয়াদ যদি এক বৎসর বাধ্যতামূলক বৃদ্ধি করা হয় এবং অন্য গোষ্ঠীকে শিক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধি করা না হয় তাহলে দেখা যাবে মেয়াদ বৃদ্ধি প্রাপ্ত গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের কাছে এ ব্যবস্থায় প্রভাব সমভাবে পড়ছে না। কিছু পড়ুয়া শিক্ষার্থী তাতে উপকৃত হলেও কিছু শিক্ষার্থী উপকৃত হবে না। এই না হওয়াদের দল পুরো গোষ্ঠীর পরিচয় বহন করতে পারে না। এ বিষয়ে পদ্ধতিগত সমস্যার সমাধান করেছেন নোবেল বিজয়ী অপর দুই অর্থনীতিবিদ। এদের একজন হচ্ছে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণকারী জোশুয়া ডি অ্যাংবিষ্ট। তিনি জন্মসূত্রে ইসরায়েলি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনষ্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অর্থনীতির অধ্যাপক। অপরজন হলেন, ১৯৬৩ সালে নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণকারী গুইভো ডব্লিউ ইমবেনস। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিষয়ক পত্রিকা ইকনোমেট্রিকস এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ প্রখ্যাত দুইজন অর্থনীতিবিদকে ‘কজাল রিলেশনশিপ’ বা কার্য কারণ সংক্রান্ত বিশ্লেষণের বিষয়ে পদ্ধতিগত অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। এখানে ‘কজাল রিলেশনশিপ’ বলতে অর্থনীতিতে কার্যকরণের সেই সম্পর্ক বিন্যাসকে বোঝানো হয়, যেখানে কার্য ও কারণের মধ্যে ভিত্তি এবং উপাদানগত সম্পর্ক বিরাজ করে।
অ্যাংরিষ্ট এবং ইমবেনস ব্যাপক গবেষণা করে দেখান যে, শিক্ষার মেয়াদ একবছর বাধ্যতামূলকভাবে বৃদ্ধি করা হলে যে তার প্রভাব সবার ওপর সমানভাবে পড়ে না। এ থেকে কিভাবে উপসংহারে পৌঁছতে হবে তা তাঁরা বিশ্লেষণ করেন। জোশুয়া ডি অ্যাংরিষ্ট এ নিয়ে ১৯৯১ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেন। তিনি সেখানে দেখেছেন, মানুষের শিক্ষার মেয়াদের সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক আছে। যাঁরা ১২ বছর পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের আয় ১১ বছর পড়াশোনা করা মানুষের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। আর যাঁরা ১৬ বছর পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের আয় ৬৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে কার্য-কারণ সংক্রান্ত। এ নিয়েই কাজ করার জন্যই নোবেল পেয়েছেন জোশুয়া ডি. অ্যাংরিষ্ট।
অন্যদিকে ডেভিড কার্ড ১৯৯০ এর দশকে ন্যূনতম মজুরি বিষয়ে অর্থনীতির বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত ধারণার সমালোচনা করে নজর কাড়েন। পরে অভিবাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি গবেষণা করেন। বিভিন্ন অভিবাসী গোষ্ঠীর ওপরে নিরীক্ষা চালিয়ে কার্ড দেখান, অভিবাসনের ফলে কোনো দেশের অর্থনীতি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন সময়ের অভিবাসন বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, এর ফলে দুই দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেন যে, আমেরিকার শ্রমবাজারে, বাইরের শ্রমের অনুপ্রবেশের কারণে আমেরিকার শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এই গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে প্রমানিত হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন বিরোধী যে শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তা ছিল ভুল।
ডেবিড কার্ড আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবদান রেখেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করলেই যে কর্মসংস্থানের হার কমে যাবে তা কিন্তু নয়। কোনো দেশে নতুন অভিবাসনের কারণে সেখানকার নাগরিকেরা যেমন উপকৃত হতে পারে, তেমনি সেই দেশে যাঁরা আগে অভিবাসী হিসেবে এসেছেন, তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গবেষণায় এটাও প্রমানিত হয় যে, বিদ্যালয়ের সম্পদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে শ্রমবাজারে প্রবেশের সম্পর্ক আছে। যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিক বৃহৎ এবং সম্পদের পরিমাণ অধিক সেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনামও অধিক। আর সুনামধর্মী প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের শ্রম বাজারে চাহিদা অধিক।
২০২১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদের গবেষণা দ্বারা বিশ্ব উপকৃত হবে। পূর্ব থেকে ধারণা করা একটি চিন্তাধারাকে তাঁরা ভেঙ্গে দিয়েছেন। সমাজের অন্তরালের সমস্যা নিয়ে কার্ডের গবেষণা এবং অর্থনীতির পদ্ধতিগত আলোচনার ক্ষেত্রে অ্যাংরিষ্ট ও ইমবেনসের গবেষণা জ্ঞানজগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।
অর্থনীতিতে প্রাপ্ত নোবেল পুরস্কারের মূল্যমান ১১ লাখ ডলার। মোট পুরস্কারের অর্ধেক পাবেন ডেভিড কার্ড। বাকি অর্ধেক জোশুয়া ডি অ্যাংরিষ্ট ও গুইডো ডব্লিউ ইমবেনসের মধ্যে সমান হারে ভাগ করে দেয়া হবে। অর্থাৎ ডেভিড কার্ড পাবেন ১১ লাখ ডলারের ৫০ শতাংশ। আর জোশুয়া ডি অ্যাংরিষ্ট পাবেন ২৫ শতাংশ এবং গুইডো ডব্লিউ ইমবেনস পাবেন ২৫ শতাংশ। অবশ্য প্রত্যেকে সোনার মেডেল পাবেন।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাঙ্গু নদীর কপার মহাশোল
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল