অমর একুশে

নাসের রহমান | শুক্রবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ

ভার্সিটিতে আসার পর থেকে শাইয়ানের সময়টা ভাল কাটে। একটানা ক্লাস করতে হয় না। দু’টি ক্লাসের পর একটা বিরতি থাকে। এ সময়টাতে অনেকে গল্পে মেতে উঠে। কেউ চা সিংগারা খায়, খানিকটা ঘুরে আসে। এখানে ঘুরাঘুরির জায়গা গুলো খুবই চমৎকার। যেদিকে তাকায় সহজে চোখ ফিরানো যায় না। অনেক গাছ পালা দেখা যায়। সবুজ লতা পাতায় ছেয়ে আছে কোন কোন দিক। যেন সবুজে সুবজে ভরা বন বনানী। কোথাও কোথাও এসবের মাঝে সুরম্য সব দালান কোঠা গড়ে উঠেছে। এসব ভবন খানিকটা একই আদলের। বেশির ভাগই ফ্যাকালটি ভবন। কোনটা একাডেমিক ভবন আবার কোনটা প্রশাসনিক ভবন নাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটার চেয়ে আরেকটা কিছুটা দূরে দূরে হওয়াতে একসাথে চোখে পড়ে না। কিছুদূর গেলে দেখা যায় সবুজের মাঝে আরেকটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে। সবুজটা কখনো বিলীন হয় না। আশেপাশের গাছ গাছালি লতা পাতা জায়গাটিকে মায়াময় করে রেখেছে। এতে ভবন গুলোর সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভবনের চারপাশ অপরূপ হয়ে থাকে। নৈসর্গিকতার ছোঁয়ায় জায়গাটি অপূর্ব হয়ে উঠে। তখন দৃষ্টি নন্দন এ অপূর্ব সুন্দর চত্বর থেকে চোখ ফেরানো যায় না। থাকার হলগুলোও যেন নৈসর্গিকতার নান্দনিকতায় ডুবে আছে। এক একটি হলের নামকরনও ভিন্ন মাত্রা বহন করে। বেশির ভাগ হলের নাম শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির খ্যাতিমান ব্যক্তি বর্গের নামে। একটি হলের নাম নারী জাগরণের অগ্রদূত মহিয়সী বেগম রোকেয়ার নামে। বিশ্ববিদ্যালয়টি আবাসিক হওয়ায় সহজে হলে সিট পাওয়া যায়। প্রায় ছাত্র ছাত্রীরা হলেই থাকে। ফলে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র ছাত্রীদের আনা গোনা লেগে থাকে। আশেপাশে কয়েকটি জলাশয় পুকুর আর বেশ বড় বড় লেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো বেশি নান্দনিক করে তুলেছে। এসব লেকে শীতের সময় অতিথি পাখিরা এসে ভীড় জমায়। সূদুর সাইবেরিয়া থেকে দল বেঁধে উড়তে উড়তে অতিথি পাখিরা এখানে এসে আশ্রয় নেয়। লেকের পানিতে ভেসে বেড়ায়। পদ্ম পাতা বা ফানার আড়ালে পানকৌড়ি ডাহুক কখনো এদের সাথে মিশে না। হঠাৎ একটি অতিথি পাখি উড়ে উঠলে সাথে সাথে অন্য পাখিরাও উড়তে শুরু করে। আবার এক ঝাঁক পাখি কোথা থেকে উড়ে এসে ঐ জায়গায় ভেসে বেড়ায়। এ যেন এক অপূর্ব দৃশ্য, পুরা ক্যাম্পাসটা অন্যরকম হয়ে উঠে।
এসবের মাঝে সময়টা ভালই কাটতে থাকে। সহপাঠীদের কয়েক জনের সাথে ঘনিষ্ঠতাও হয়ে যায়। অনেকটা বন্ধুর মত। কিন্তু একটা জায়গায় এসে সে কোনমতে মেলাতে পারে না। বিশ্ববিদ্যারয়ের মূল ভবনের সামনে বিশাল মাঠ। মাঠের ঠিক মধ্যখানে সুউচ্চ একটি মিনার। আধুনিক ডিজাইনে স্থাপত্য শেলীতে নির্মিত বিভিন্ন কারুকাজে ভরা এ মিনার শৃঙ্খ সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে। বিশেষ দিবসে অনেকে এখানে এসে সমবেত হয়। সবাই এ জায়গাকে শহীদ মিনার চত্বর বলে। একুশে ফেব্রুয়ারীর শহীদ মিনারের একটি স্বরূপ সারা দেশের মানুষের হৃদয়ে অংকিত আছে। মাতৃভাষার জন্য সন্তানের আত্মত্যাগ দেখে যেখানে মা তার দুই সন্তানকে মাথা নত করে আর্শীবাদ করছে। সে শহীদ মিনার এখানে নেই কেন? এসব প্রশ্নের জওয়াব সে খুঁজে পায় না। পরিচিত জন যারা তাদের কেউ এসব নিয়ে ভাবে না। একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদদের উদ্দেশ্যে ফুল দেওয়া হয় তাই সবাই ফুল দিতে আসে। ফুল দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। মিনার কি রকম হলো সেদিকে কারো খেয়াল নেই। এখানে যে শুধু ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় তা নয়। ছেলে মেয়েরা খেলাধূলা করে। বিশেষ করে পড়ন্ত বিকেলে এ জায়গাটাও কিছুটা জমে উঠে। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসে নয় ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস ও ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসেও এখানে ফুল দেওয়া হয়। কেবল ভাষা শহীদ নয় স্বাধীনতার শহীদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। তবে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা একটা সুনাম আছে। বিশেষ করে নাট্যকলায় এ সুখ্যাতি অনেকের মুখে মুখে ফিরে। বহুমাত্রিক নাট্য অভিনেতা তৈরীতে এ বিভাগের জুড়ি মেলা ভার। একই সাথে অসাধারণ নাট্যকারও এ বিভাগকে সম্মৃদ্ধ করে তুলেছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে আসল প্রশ্নটি থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়। যেদিকে তাকায় সবকিছু যেন প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। মনটা ক্ষনিকের জন্য হলেও হালকা হয়ে যায়। প্রশ্নটা আর আগের মত ঘুরপাক খায় না। তবে একেবারে মাথা থেকে সরে যায় না। সে শহীদ মিনারে থেকে পূর্বদিকে হাঁটতে থাকে।
সোজা পথ ধরে কিছুদূর হাঁটার পর সে থমকে দাঁড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে ‘অপরাজয় বাংলা’ সে দেখেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য। এটি কিসের ভাস্কর্য! পশ্চিমে সুউচ্চ শহীদ মিনার এখনও কিছুটা দৃশ্যমান। রাস্তার ওপাশে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ। সামনে আশে পাশে গাছে পালায় পত্র পল্লবে ছেয়ে আছে। পূর্বদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা গেইট । প্রান্তিক গেইট নামে বেশি পরিচিত। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি পাম গাছ যেন মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। একপাশে বড় একটি খেলার মাঠ । মাঠের এক পাশে ছেলেরা খেলাধূলা করছে। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। সূর্যের আলোতে এ জায়গাটা কেমন যেন আলোকময় হয়ে উঠেছে। ভাস্কর্যের পেছনে দক্ষিনে মুক্তিযোদ্ধা চত্বর, ক্যাফেটিরিয়া। মাঠ সংলগ্ন নাট্যকার সেলিম আলাদীন মুক্তমঞ্চ। ছেলে মেয়েরা এ মঞ্চে নাটক করে। অনেকে সে নাটক উপভোগ করে। কখনো কখনো অনুষ্ঠানও হয়। সমবেত সকলের করতালিতে মুখরিত করে তোলে জায়গাটি। কিন্তু এ ভাস্কর্য কার কথা বলে, কাদের কথা বলে? নিশ্চয় একুশের ফেব্রুয়ারীর শহীদদের কথা বলে। সে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে। মা তার গুলিবিদ্ধ সন্তানকে দু’হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তানের এক হাত মায়ের পায়ের কাছে ঝুলে আছে অন্য হাত মায়ের বুকের কাছে বাহু বন্ধ হয়ে আছে। পা দু’টি মাটিতে আবদ্ধ, বুকটি যেন মায়ের কোলে আর মাথাটি মার স্নেহমাখা হাতের পরশ নিয়ে বাবার কোমরে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েছে। মার পাশে দাঁড়ানো বাবার মুষ্টিবদ্ধ হাত দূঢ় শপথের বানী উচ্চারন করছে। গর্বিত জননী দু’হাতে সন্তানকে ধরে রেখে মাথা উচুঁ করে আকাশের দিকে দূরদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। মার আর্তনাদ আকাশ বিদীর্ন করে তুলেছে। সন্তান হারার বেদনা আর শোক তাদের কাছে শক্তিতে পরিনত হয়েছে। সন্তানের প্রাণহীন নিথর দেহটি মা মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দিতে চায় না। ছেলের হাঁটুতে জোর নেই, পায়ে নেই শক্তি। তারপরও পা যুগল মাটির মায়া ছাড়তে চায় না। বাম হাতটিও মাটির স্পর্শ পেতে কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। মাথাটিও যেন কাত হয়ে মাটির দিকে হেলে আছে। কিন্ত জননী কোন মতে সন্তানকে হাতছাড়া করতে চায় না। মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেয়না। বুলেটবিদ্ধ এ সন্তানই তার বড় গর্বের ধন। অসীম আকাশের মত বড় এ সন্তান। বাবার ডান হাত বজ্র মুষ্টি দিয়ে উপরে দিকে যেন গগনের বজ্র নিনাদ। বাম হাতের মুষ্টি যেন ধরনী তলে বজ্রের ঘনঘটা। বাবা মা দু’জনই সন্তানের বীরত্ব গাঁথায় বলীয়ান।
শাইয়ান বিম্ময়ভরা নয়নে অপূর্ব সুন্দর ভাস্কর্যের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। আশে পাশে গাছ পালার ডালে ডালে পাতার আঁড়ালে পাখিরাও বসে আছে। এরাও যেন আবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। এদের কন্ঠেও কোন গান নেই। পাখিরা কখনো এভাবে নিঃশব্দে বসে থাকে না। মাঠে যারা খেলছে তাদের উচ্ছ্বাস এ পর্যন্ত এসে পৌঁছে না। মুক্তিযোদ্ধা চত্বরেও তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মুক্ত মঞ্চে যারা অভিনয় করেছে তাদের মাঝেও কোন সংলাপ নেই। তারা কি মুখ বা বধিরের অভিনয় করছে নাকি মুখাভিনয়? দর্শক সারীতে যে ক’জন বসে আছে তারও নির্বাক দৃষ্টি মেলে আছে। চুপচাপ নিঃশব্দে বসে আছে। এ জায়গাটা হঠাৎ এরকম নিরবতায় ডুবে গেল কেন? রাস্তায়ও তেমন কারও চলাফেরা নেই। সব আয়োজন মূল ভবনের সামনে বড় মাঠটির সুউচ্চ মিনারটির পাদদেশে। সকাল থেকে ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছে। শিক্ষক পরিষদ, ছাত্র সংসদ, ছাত্রদের নানা সংগঠন, কর্মচারীদের সংগঠন কোনটাই বাকী নেই। সবাই গিয়ে ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা । আগে সবাই শহীদ দিবস বলতো এখন আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। কিন্তু এ ভাস্কর্যের কাছে কেউ এসে দাঁড়ায়নি। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেনি। এর প্রতি কারো কোন আবেগ নেই। অথচ এ ভাস্কর্য মাতৃভাষার সর্বোচ্চ ত্যাগকে কিভাবে ধারন করে আছে তা কি একবারও কেউ ভেবে দেখলো না। এসব প্রশ্নের কোন জওয়াব সে খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু কোন মতে এ ভাস্কর্যের উপর থেকে চোখ নামতে পারছে না। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় এ অমর ভাস্কর্য যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। সূর্য তার সবটুকু আবীর মেখে দিয়ে বিদায় অভিবাদন জানাতে চায়। বুলেট বিদ্ধ শহীদ সন্তান, সাথে পিতা মাতাকেও । হঠাৎ তার চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠে। ফুলের অজস্র পাপড়ি পদপ্রান্তে সূর্যের রক্তিম আভায় রঙিন হয়ে উঠে। ভাস্কর্য যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পাদদেশে সিঁড়ির ধাপে ধাপে সবুজ গাছগুলোতে অসংখ্য ফুল ফুটে আছে। রং বেরংয়ের নানা রংয়ের ফুল। সে ফুলগুলো যেন সব পাপড়ি মেলে দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। এসব ফুলের অজস্র পাপড়ির মাঝে ভেসে উঠছে ভাস্কর্যটির পাদদেশে খোদাই করা অপূর্ব সুন্দর নামটি -‘অমর একুশ’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচুয়েটে ‘ম্যাটল্যাব ও ল্যাটেক্স’ বিষয়ক কর্মশালা
পরবর্তী নিবন্ধঅভিমান