অভাব ৫০ লাখ টাকার!

পাইপ লাইন না সরিয়েই কালভার্ট নির্মাণ, সুফল নিয়ে সংশয়

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১০ মার্চ, ২০২১ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

নগরের সিরাজদ্দৌলা রোডের চকবাজার পোস্ট অফিসের সামনে কাঁচাবাজার শাখা খালের উপর পুরনো বক্স কালভার্টটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। রাস্তার চেয়ে ২০ ইঞ্চি উঁচু করা হচ্ছে কালভার্টটি। এরপরও নির্মাণ শেষে এ কালভার্টের সুফল নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। কারণ সেখানে ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থার যেসব পাইপলাইন আছে সেগুলো অপসারণ করা হয়নি। পাইপ লাইনগুলো রেখেই কালভাটটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ভাসমান ময়লা-আবর্জনা ওসব পাইপে আটকে গিয়ে খাল ভরাট হয়ে যাবে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, পাইপ লাইনগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিতে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শুধু ওয়াসা দাবি করেছে ৪১ লাখ টাকা। এ অর্থ পরিশোধের সামর্থ্য সিটি কর্পোরেশনের নেই। তাই পাইপলাইনগুলো রেখে দিয়েই কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে।
তাছাড়া টাকা পরিশোধ করলেও বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে পাইপ লাইনগুলো সরিয়ে নিতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে। প্রকল্পের মেয়াদ আছে মাত্র সাড়ে তিন মাস। পাইপ লাইন সরানোর পর কাজ শুরু করলে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা যাবে না। পাশাপাশি জনদুর্ভোগ এড়াতে দ্রুত সময়ে কালভার্টের কাজ শেষ করতে চসিকের উপর চাপ আছে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের। ফলে পাইপ লাইন সরানোর প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে না চসিক।
নগর পরিকল্পনাবিদগণ বলছেন, টাকার জন্য অপূর্ণ কাজ করা উচিত হবে না। কিছুটা সময় লাগলেও পাইপ লাইনগুলো অন্যত্র সরিয়ে কালভার্ট নির্মাণ করা উচিত। অন্যথায় যে উদ্দেশ্যে নতুন কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে তা পূরণ হবে না। কালভার্ট নির্মাণের জন্য সড়ক বন্ধ থাকায় গত প্রায় দুই মাস ধরে জনগণের ভোগান্তি হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ কাজের স্বার্থে জনগণ প্রয়োজনে ভোগান্তি আরো দুই মাস বেশি সহ্য করবে। সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পরিপূর্ণভাবে কাজ করা উচিত।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, জাইকা ব্যাচ-২ এর বর্ধিত প্রকল্পের আওতায় কালভার্টটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পে সিরাজদ্দৌলা রোডের দিদার মার্কেট থেকে তেলপট্টি মোড় এবং কাপাসগোলা রোডের ওয়ালি খাঁ মসজিদ থেকে বহদ্দারহাট পুলিশ বঙ পর্যন্ত ৫টি সড়ক অন্তর্ভুক্ত। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ কোটি ২০ হাজার টাকা। তবে চকবাজার পোস্ট অফিসের সামনের কালভার্টটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ লাখ টাকা। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ১৫ মিটার, প্রস্থ ৬ দশমিক ৮০০ মিটার। বেইজমেন্ট থেকে ব্রিজটির উচ্চতা হবে ৩ দশমিক ৭০০ মিটার, যা বর্তমান রাস্তা থেকে ২০ ইঞ্চি উঁচু হবে। গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান র‌্যাব আরসি অ্যান্ড মহসিন অ্যান্ড ব্রাদার্স (জেভি) পুরাতন কালভার্ট ভাঙার কাজ শুরু করে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দ্রত গতিতে চলছে নির্মাণ কাজ। সেখানে ওয়াসা, গ্যাস, বিটিসিএলের ৬টি পাইপলাইন দেখা গেছে। কালভার্ট নির্মাণের জন্য সিরাজদ্দৌলা রোডের তেলিপট্টি মোড় থেকে প্যারেড কর্নার পর্যন্ত অংশে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে বহদ্দারহাট থেকে কাপাসগোলা হয়ে আসা গাড়িগুলো অলি খাঁ, গোলজার মোড় ও কেয়ারি ইলিশিয়ামের সামনে দিয়ে প্যারেড কর্নারে আসছে। মুরাদপুর থেকে তেলিপট্টি হয়ে যেসব গাড়ি চলত সেগুলোও একইভাবে যাচ্ছে। সবগুলো সড়কের যানবাহন একই অংশ দিয়ে যাতায়াত করায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। এতে ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ লোকজনের। পথচারীরা দ্রুত সময়ে কাজ শেষ করার দাবি জানান।
পাইপ লাইন রেখে দিয়ে কাজ করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী ফরহাদুল আলম আজাদীকে বলেন, ইউটিলিটি শিফটিং করার জন্য আমরা সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা ৫০ লাখ টাকার ডিমান্ড দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, একসঙ্গে এত টাকা পরিশোধ করা আমাদের জন্য কঠিন। ওয়াসাকে বলেছিলাম, রোড কাটিং বাবদ তাদের কাছ থেকে আমরা যে টাকা নিই তার সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য। আবার কাজ শুরুর আগে ডিসি ট্রাফিকের সাথে মিটিং করেছিলাম। তিনি দুর্ভোগ এড়ানোর জন্য প্রথমে তিন ভাগে কাজ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত একসাথেই কাজ করছি। আবার জাইকা থেকে জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার তাড়া আছে। ইউটিলিটি শিফটিংয়ের টাকা জাইকা থেকে নিলে দীর্ঘসূত্রতার বিষয় আছে। ফলে বাধ্য হয়ে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। তবে এতে পানি চলাচলে সমস্যা হবে না। কালভার্ট নির্মাণ হয়ে গেলেও পাইপলাইনগুলো সরিয়ে নেয়া যাবে।
পাইপ লাইন সরিয়ে না নিলে সুফল বেশি হবে না বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী আনোয়ার। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়েছি সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে। না নিলে বেশি উন্নতি হবে না। তাছাড়া পরে পাইপ লাইনগুলো সরিয়ে নিতে গেলে হয়ত আবারো রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। তখন আবার দুর্ভোগ হবে জনগণের। নির্মাণ কাজ শেষ করতে কতদিন সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ছয় মাস সময় দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসেই কালভার্টের স্ল্যাব বসানো হয়ে যাবে। পুরো রাস্তা খুলে দিতে দুই-তিন মাস লাগতে পারে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, আমাদের পাইপলাইন ওভারক্রসিং অবস্থায় আছে। সরিয়ে নিতে সিটি কর্পোরেশন চিঠি দেয়। তারা রোড কাটিংয়ের অর্থের সঙ্গে সমন্বয়ের যে প্রস্তাব দিয়েছে সেভাবেই করব। তবে ঠিকাদার নিয়োগসহ পাইপ প্রতিস্থাপন করতে দুই-তিন মাস সময় লাগবে। কালভার্ট নির্মাণ শেষে পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন করা যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি সিটি কর্পোরেশন ব্যবস্থা রাখে তাহলে পারা যাবে।
তিনি বলেন, কাজ শুরু করার আগে সমন্বয় করা উচিত ছিল চসিকের। সিটি কর্পোরেশন যখন কালভার্টের প্রাক্কলন করে তখন কি পাইপ লাইনগুলো দেখেনি? তখনই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জানিয়ে দেয়া দরকার ছিল।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি সোহেল শাকুর আজাদীকে বলেন, যেকোনো কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে করা উচিত। জনগণের সুবিধার জন্যই তো কালভার্ট করা হচ্ছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ না হলে অসুবিধা হবে। এখানে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকতে পারে। এখানে যে সমস্যা তা সিটি কর্পোরেশন নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কিংবা বিষয়টি একার সমস্যা ধরে না নিয়ে সবার সাথে কো-অর্ডিনেশন করতে পারে। অন্যথায় দীর্ঘমেয়াদি সুফল মিলবে না।
তিনি বলেন, অর্থ সংকটের যে বিষয়টি আসছে সেটাও কেমন যেন মনে হচ্ছে। যেখানে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়ে যাচ্ছে সেখানে ৫০ লাখ টাকার অভাবে ইউটিলিটি শিফটিং কাজ হবে না, সেটা হয়? তাই মনে হচ্ছে উদ্যোগের সমস্যা আছে। তাছাড়া পূর্ণাঙ্গভাবে করার জন্য দুই মাস বেশি লাগলে সমস্যা কি? জনগণের তো আরো বেশি দুর্ভোগ সহ্য করার অভিজ্ঞতা আছে। পরিপূর্ণভাবে কাজের স্বার্থে আরো কিছুদিন কষ্ট তারা নিশ্চয় মেনে নেবে। না হয় ভবিষ্যতে আরো বেশি কষ্ট করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুলিশ কর্মকর্তার কোটিপতি স্ত্রী কারাগারে
পরবর্তী নিবন্ধড্রেনে উপুড় হয়ে পড়েছিল যুবকের মরদেহ