অবৈধ ইটভাটায় বিবর্ণ চট্টগ্রাম

রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত ইটভাটা রয়েছে মাত্র ১২০টি। এর বাইরে অবৈধ ৩ শতাধিক ইটভাটা পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে। এসব ইটভাটার অধিকাংশ গড়ে উঠেছে পাহাড়, ফসলি জমি, লোকালয় কিংবা জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর পাড় ঘেঁষেও অনেক ইটভাটা রয়েছে। গত ১৩ নভেম্বর উচ্চ আদালতের দেয়া এক নির্দেশনায় দেশের সব জেলার অবৈধ ইটভাটা ৭ দিনের মধ্যে বন্ধ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলায় ইটভাটা আছে ৪১৩টি। এর মধ্যে ফিক্স চিমনি (৮৯১২০ ফুট উঁচু) ইটভাটা আছে ২৭৩টি, জিগজ্যাগ চিমনি আছে ১১৬টি এবং পরিবেশ ফ্রেন্ডলি টেকনোলজির ইটভাটা আছে মাত্র ১১টি। ইটভাটা পরিচালনার জন্য ছাড়পত্র আছে ১২০টির। সংস্থাটির হিসেবে আরও ২৯৩টি ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে অনুমোদনহীনভাবে।

সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার ১২টি ইটভাটার মধ্যে সবগুলোর অনুমোদন আছে। তবে আনোয়ারায় দুটির মধ্যে একটি, পটিয়ায় দুটির মধ্যে একটি, সন্দ্বীপে ১১টির মধ্যে ৯টি, বাঁশখালীতে ১২টির মধ্যে ১০টি, বোয়ালখালীতে ৫টির মধ্যে ৪টি, মীরসরাইয়ের ১৫টির মধ্যে ৯টি, সীতাকুণ্ডে ৮টির মধ্যে ৬টি, চন্দনাইশে ৩২টির মধ্যে ২৫টি, লোহাগাড়ায় ৪৮টির মধ্যে ৪৫টি, ফটিকছড়িতে ৫৫টির মধ্যে ৪৩টি, সাতকানিয়ায় ৭০টির মধ্যে ৪৫টি, রাউজানে ৩৭টির মধ্যে ২৯টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৬৯টির মধ্যে ৬৬টি ও হাটহাজারীতে ৩৫টির মধ্যে ২০টি ইটভাটা অবৈধ বলে জানিয়েছেন সংস্থাটি।

সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে রাঙ্গুনিয়ায়। এসব ইটভাটাগুলোর মধ্যে দক্ষিণ রাজানগর, রাজানগর, ইসলামপুর, হোসনাবাদের নিশ্চিন্তাপুর, সরফভাটা ইউনিয়নেই অধিকাংশ গড়ে উঠেছে। এছাড়া বেতাগী, পৌরসভা এবং কোদালা ইউনিয়নে রয়েছে বাকী ইটভাটাগুলো। পাহাড়ে কিংবা ফসলি জমি, কর্ণফুলী নদীর পাড়, শস্যভাণ্ডার গুমাইবিলেও গড়ে উঠেছে ইটভাটা। ইটভাটাগুলোতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের কাঠ। উপজেলার হোছনাবাদ এলাকায় প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা হয় পক্ষীশালা। কোদালা বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬০০ একর বনভূমিতে এই পক্ষীশালা গড়ে তোলা হয়। অথচ সেই পক্ষীশালার পাশেই গড়ে উঠেছে ৬টি ইটভাটা। চিমনির ধোঁয়ায় পক্ষীশালায় এখন পাখির দেখা মেলাই ভার।

উপজেলার নিশ্চিন্তাপুর এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শেখ রাসেল অ্যাভিয়ারি অ্যান্ড ইকোপার্কের পাশে হোছনাবাদ ইউনিয়নের নিচিন্তাপুরের এক জায়গায় রয়েছে ৫টি ইটভাটা। তার পাশে লালানগর ইউনিয়নের ফুইট্টা গোদা এলাকায় রয়েছে আরো একটি ইটভাটা। পাহাড় বেষ্টিত পক্ষীশালার পাশে নিচিন্তাপুরের সবুজ প্রকৃতি বিবর্ণ হচ্ছে ইটভাটার ধোঁয়ায়। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘিরে পাহাড়ের পাদদেশে ও পরিবেশ সংরক্ষণে গড়ে তোলা পক্ষীশালার সবুজ বেষ্টনী ঘিরে একের পর এক গড়ে উঠেছে ইটভাটা। সব ইটভাটায় ব্যবহারের জন্য বনাঞ্চল উজাড় করে সংগ্রহ করা হয় জ্বালানি কাঠ। জমির টপ সয়েল কেটে বানানো হচ্ছে ইট। ইট তৈরির সরঞ্জামাদি ও ইট আনা নেয়ার কারণে নিচিন্তাপুরের অন্তত ৪ কিলোমিটার রাস্তা জন ও যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পক্ষীশালার পাশে গড়ে ওঠা ৬টি ইটভাটার কোনোটির ছাড়পত্র নবায়ন করেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা এসব বেশির ভাগ ইটভাটার মালিক স্থানীয় সরকার দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।

উপজেলার ইসলামপুর ছাদেকনগর এলাকার বাসিন্দা মো. হাশেম জানান, আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও একটি প্রভাবশালী চক্র তার মালিকানাধীন জমি দখল করে ইটভাটা গড়ে তুলেছে। এই ইটভাটার পাশে লোকালয় এবং ছাদেক শাহ মাজার ও মাদ্রাসাও রয়েছে। তিনি ইটভাটা বন্ধ করে তার জমি ফেরত পেতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তর বরাবর আবেদন করেছেন বলে জানান।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোর সরকারি অনুমোদন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ইট তৈরিতে পাহাড় কেটে ও জমির টপসয়েল কেটে মাটি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করে জ্বালানি কাঠের জোগান দেওয়া হচ্ছে।

পরিবেশবিদরাও ইটভাটাগুলোকে পরিবেশ দূষণ ও বনাঞ্চল উজাড়ের জন্য দায়ী করে বলেছেন, ইটভাটার কালো ধোঁয়া বিশাল অঞ্চলের চাষাবাদ, সবজি ও ফলমূল উৎপাদন এমনকি আম গাছের মুকুল সৃষ্টিও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। এই কালো ধোঁয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম এখনি বন্ধ করা না গেলে আগামী প্রজন্মকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ও বিপদের মুখোমুখি হতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাঙ্গুনিয়ার এক ইটভাটার মালিক জানান, ইটভাটা নির্মাণের পর পরিবেশ অধিদফতরে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ইটভাটা অনুমোদন পেয়েছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন। কয়লার দাম বেশি এ কারণে কয়লা জ্বালানোর প্রতি ভাটা মালিকদের আগ্রহ কম। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ।

অবৈধ ইটভাটা প্রসঙ্গে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গণি ওসমানি বলেন, জমির টপসয়েল কেটে নেওয়ার অপরাধে কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম পরিবেশ আদালতের বিশেষ পিপি এডভোকেট হুমায়ুন রশীদ তালুকদার অবৈধ ইটভাটা প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইটপ্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা আছে, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চালালে দুই বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একইভাবে ইটভাটায় মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিশেষ করে টপ সয়েলের ব্যবহার বন্ধ করা, ইটের বিকল্প ব্লক উৎপাদন ও ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ, ইটভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক এবং ব্লক তৈরিতে লাইসেন্সের অপ্রয়োজনীয়তা, নির্দিষ্ট এলাকায় ইটভাটার জায়গা ও ভাটার সংখ্যা নির্ধারণ করা। এসব না মানলে সংশ্লিষ্ট ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় দায়িত্বশীলরাও ম্যানেজড হয়ে মামলা দেয়ার সময় হালকা করে ধারা দিয়ে দেন। আমার কাছে এভাবে কেউ এলে আমি কিন্তু ফেরত পাঠিয়ে দেই।’

চট্টগ্রামে অবৈধ ইটভাটা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিচালক মো. মুফিদুল আলম বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে যতটুকু অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন ততটুকু করা যাচ্ছে না। তবে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুই পক্ষে ফের সংঘর্ষ, হল প্রভোস্টের কক্ষ ভাঙচুর
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানে সার্কিট হাউসের কর্মচারী ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার