অবিনাশী প্রাণ

বেগম মুশতারী শফী

ফেরদৌস আরা আলীম | শনিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

বেগম মুশতারী শফী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাশে জ্বলজ্বলে এক নক্ষত্র-নাম। এই বিজয়ের মাসে তাঁর জীবনাবসান এক মহাজীবনের মহাবসান। আনত শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
১৯৩৮ সালে ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। মাত্র ষোল বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে বিয়ের পর সন্তানের কলকাকলিতে ভরে উঠতে থাকা সংসারের সকল কাজের পরে স্বপ্ন দেখতেন। যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশে তিনি যে নানা পরিচয়ে অভিষিক্ত হবেন তার শুরুটা হয়েছিল মাত্র এগার বছর বয়সে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘মুকুলের মাহফিল’-এ গল্প লেখার মধ্য দিয়ে। তারপর ষাটের দশকে গড়লেন বান্ধবী সংঘ। এই সংঘের মুখপাত্র হয়ে এল মাসিক বান্ধবী পত্রিকা। ১৯৬৯-এ বাড়ির গাড়িঘরে সম্পূর্ণ নারীকর্মী পরিচালিত ‘মেয়েদের প্রেস’ থেকে সে-পত্রিকা ছাপার কাজটিও শুরু হয়। কিন্তু ততদিনে অগ্নিগর্ভ স্বদেশ রুষে-ফুঁসে উঠেছে। সে-আগুনে যে অগ্নিকন্যারা ঝাঁপ দিয়েছিলেন মুশতারী শফি তাঁদের অন্যতম একজন। তবে নিয়তি তাঁর সহায় হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ তাঁকেও উথাল-পাতাল করে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি ভুলে গেলেন যে তিনি থাকেন এক অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় জোড়া-জোড়া শকুনি চোখের সার্বক্ষণিক পাহারায়। অনায়াসে সতীর্থজন তাঁর বাড়িতে অস্ত্রভর্তি ভারি ভারি বাক্‌সো মজুদ করে। আবার তাঁরই মুশতারী লজে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের স্বপ্ন বোনা হয় দিনের পর দিন। অতঃপর স্বামী এবং একমাত্র ছোট ভাইটিকে হারান তিনি। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় একটি সুখের নীড়। অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ান তিনি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে কেটেছে তার নয়টি মাস। এই ন’ মাসে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু তিনি যুদ্ধ করেছেন আমৃত্যু। সংসার নিয়ে পেশাগত জীবন নিয়ে একরকম যুদ্ধ। দেশের কাছে দায়বদ্ধতার অন্যরকম যুদ্ধ। নিজের লেখক সত্তার তাড়না তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে আরেক রণক্ষেত্রে। আসলে যে-জীবন তিনি যাপন করেছেন সে কোনও গতানুগতিক জীবন ছিল না। গৎবাঁধা, একমাত্রিক, এক-ঠাঁই জীবনও সে নয়। হালকা-পাতলা উপরিতলের কোনও রঙ্গীন ভাসমান জীবনের স্বপ্নও তাঁর ছিল না। গুরুভার একটি জীবন তিনি তিলে-তিলে দান করেছেন স্বদেশ, স্বসমাজ ও আমাদের সংস্কৃতির উন্নতিকল্পে। তাঁর একাধিক পরিচয়ের এই ছিল হেতু। তিনি ছিলেন একাধারে সম্পাদক, সংগঠক, উদ্যোক্তা, বেতার-ব্যক্তিত্ব, নারীনেত্রী এবং মুক্তিযোদ্ধা তো বটেই। তাঁর জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতার অগ্নিমশাল ছিল তাঁর সাহিত্য। বিশেষ করে ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’ গ্রন্থদ্বয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা স্মৃতিকথায় তিনি এবং জাহানারা ইমাম ও বাসন্তী গুহঠাকুরতা প্রমুখ যা লিখেছেন তাতে অসামান্য যে-কাজটি তাঁরা করেছেন সেটিই স্বাধীনতার চার দশক পরে ‘বীরাঙ্গনা’দের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি পাবার পথ কেটেছিল। তাঁর বিশালায়তন গ্রন্থ ‘একাত্তরের চিঠি’ জাহানারা ইমাম’কে (পত্র-সঙ্কলন গ্রন্থ) একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল করার আন্দোলনটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। এ-যুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ এবং তিনি এ-যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ধ্যানে-জ্ঞানে, মনে-প্রাণে এবং মাঠে-ময়দানে।
জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন মুশতারী শফী। নামের সঙ্গে ‘শহীদ জায়া’ বা ‘শহীদ ভগিনী’ জুড়ে দেবার ফলে একাকী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব মুশতারী শফীকে আমরা খুঁজে পাইনি। কিন্তু ২০১৭ সালের শেষদিকে ঢাকা থেকে তাসমিমা হোসেন মালেকা বেগমসহ আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের সুধীজনদের ডেকে মুশতারী শফীকে সকলের মধ্যমণি করে (বিস্তার আর্টস কমপ্লেঙের সহযোগিতায়) অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করে গেছেন। ওদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, সৃজনশীল সাহিত্য রচনা ও সাহিত্য সংগঠক হিসেবে বিশেষ অবদান রাখায় এ-পুরস্কার পাচ্ছেন তিনি। এ-বিজ্ঞপ্তি অনেকের বিস্ময়ের কারণ হলো। অথচ মূলত তিনি লেখক। সাহিত্যিক। ঔপন্যাসিক এবং গল্পকারও বটে।
প্রচুর লিখেছেন তিনি। একজন ভাষাশিল্পীর পক্ষে যা কিছু বাঞ্ছনীয় তার সবই তাঁর ছিল। নিজস্ব বর্ণনাভঙ্গি, ভাষারীতি এবং বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়া। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি, কল্পনা ও চিন্তাশক্তির জন্য জীবনভিন্ন আর কারও দ্বারস্থ হবার প্রয়োজন ছিল না তাঁর। না উচ্চশিক্ষা, না ব্যাপক অধ্যয়নের। তাঁর শস্যক্ষেত্র তাঁর চাষবাস; তাঁর ফলানো ফসল তাঁকে প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
ঔপন্যাসিক মুশতারী শফী রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন। ভাবনার প্রতিটি স্তরে রাজনৈতিক চেতনার সচেতন প্রয়োগ তাঁকে বিশিষ্ট করেছে, আমাদের করেছে বিস্মিত। ‘একদিন এবং অনেকগুলো দিনে’র মসিউর রহমান এবং অকালবোধনের উম্মে কুলসুম একই ভাবনাচিন্তার মানুষ। মানুষ তাঁরা, পুরুষ বা নারী নয়। বেঁচে থাকার জন্য ক্ষুণ্নিবৃত্তির প্রয়োজন আছে কিন্তু খাদ্যবস্তু বা ভোগ্যবস্তু বা কোনো ধরনের বিলাস-ব্যসনের জন্য তিনি কালক্ষেপণ করেননি। একহন নারী ঔপন্যাসিক রান্নাবান্না বা মেয়েদের সাজপোশাক নিয়ে ভাবিত নন- এ কম বিস্ময়ের কথা নয়।
উপন্যাসে অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরিতে তিনি অতুলনীয়। এ ঘরে সিরাজুল মজিদ মামুনের খবর পাঠ শোনা যাচ্ছে তো ও ঘরে নীরেন্দ্রকৃষ্ন ভদ্রের স্তোত্রপাঠ হচ্ছে। রাজপথ তখন হয়তো শ্লোগানমুখর; ছয় দফা মেনে নাও, নিতে হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে। অতঃপর মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন স্বদেশ। অতি দ্রুত বদলে যাওয়া সময়। সন্ত্রাস-কবলিত ছাত্র-রাজনীতি। ছাত্রখুন, শিশু ধর্ষণের সূচনা। একের পর এক বেঈমানের ক্ষমতা দখল। ‘এক বেঈমান তো দেশটাকে খৎনা করিয়ে ছাড়লো।’ এভাবেই তাঁর উপন্যাস জীবন্ত, জ্বলন্ত সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যায়। কাহিনী তো নিশ্চয়ই আছে। আছে বিষাদ, হাহাকার, রোমান্টিকতা যা থাকে জীবনজুড়ে।
প্রচুর গল্প লিখেছেন মুশতারী শফী। মুক্তিযুদ্ধের গল্প, একুশের গল্প শিরোনামের গ্রন্থ আছে তাঁর। গল্পগুলোর একটা বড় অংশ বেতারের প্রয়োজনে লেখা। গ্রামীণ জীবন, বস্তি জীবনের সুখ-দুঃখ তাঁর গল্পকে মানবিকতার স্পর্শে আর্দ্র করেছে। পাহাড়ি এলাকার বন-বনানী, সকাল-দুপুর-সন্ধ্যের রোমান্টিক সৌন্দর্য নিয়েও লিখেছেন। জীবনের নানা অভিজ্ঞতারও গল্পরূপ দিয়েছেন তিনি। মুশতারী শফীর জীবন জোড়া কাজের উপজীব্য স্বদেশ- দেশের মাটি ও মানুষ। দেশের রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাহিত্যকর্মের নানা জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর নারী চরিত্রগুলি নিরন্তর যা করেছে তাতে যে যুদ্ধটা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটা রাজনৈতিক , সামাজিক ধর্মীয়, সমাজতাত্ত্বিক সর্বোপরি মানবিক যে-সব জটিলতা তৈরি করেছে আজকের গবেষকরা তা প্রমাণ করেছেন। বেগম মুশতারী শফী তাঁর চুরাশি বছরের দীর্ঘ জীবনব্যাপী তাঁর সকল কাজে নিজেকে নিঃশেষে নিংড়ে দিয়েছেন। তাঁকে সালাম। শ্রদ্ধা। ভালোবাসা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইংরেজদের সাজানো রেঙ্গুনে
পরবর্তী নিবন্ধ‘মাইজভাণ্ডারী গান বিশ্ব সঙ্গীতের অমূল্য সম্পদ’