পাঠক, আসুন শুরুতেই আমরা একটি বাংলা শব্দের ব্যবচ্ছেদ করি। তবে বিনীতভাবেই বলে নিচ্ছি, এটি বাংলা ভাষা বা ব্যাকরণ নিয়ে আপনাদের জানাশোনা কতটুকু সেটা বোঝার চেষ্টা নয় বা এটি কোনো খেলাও নয়। কেবলই মনে করিয়ে দেওয়া। সেই শব্দটি হচ্ছে ‘নিষ্ক্রিয়’। যার মানে দাঁড়ায় কাজ নেই যার, ক্রিয়াহীন, অলস, কর্মরহিত, নিষ্কর্মা ইত্যাদি। মনুষ্য সমাজে এই শব্দটি আকছার ঋণাত্মক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যেমন কাজে নাই–কর্মে নাই, পড়াশোনায় নাই, কামাই রোজগারে নাই…ইত্যাদি মূলত নিষ্ক্রিয় মানুষদেরকেই অভিহিত করা হয়।
এবারে একটি পরিসংখ্যান দিই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস–২০২২’ প্রতিবেদনে জানাচ্ছে ‘পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই’ বাংলাদেশে এমন নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ। অর্থাৎ, দেশের মোট তরুণদের ৪১ শতাংশ নিষ্ক্রিয়। এরমধ্যে প্রায় ১৯ শতাংশ ছেলে এবং ৬২ শতাংশ মেয়ে। সংস্থাটি আরও জানাচ্ছে যে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ধরা হয়েছে ১৫ থেকে ২৪ বছর। অর্থাৎ বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশই আছেন নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণে নেই। এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার ছেলেদের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি মেয়েদের ক্ষেত্রে। যেটি অত্যন্ত আশংকাজনক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাজ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, মেয়েদের বাল্যবিয়ে, শিক্ষার মানে ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা পরিস্থিতি, অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি, যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া, শোভন কাজের অভাব ও সামাজিক পরিস্থিতর জন্যই নিষ্ক্রিয় নারী তরুণের হার বেশি হওয়ার কারণ। এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা তাদের চিন্তা জানাচ্ছেন, ‘’১৫ থেকে ২৪ বছর হলো প্রাইম এইজ বা মৌলিক/ আদ্য বয়স। এই বয়সের ৪০ শতাংশ তরুণ–তরুণী কিছু করছে না, অর্থনীতিতে অবদান রাখছেনা এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
এই বয়সে যদি তারা পড়াশুনা বা কর্মসংস্থানে না থাকে তাহলে তারা করছে কী?’’
আসুন এবারে জানার চেষ্টা করি, তরুণীরা কি কি কারণে বেশি নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় আছে। কাজের জন্য তরুণীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, বাল্য বিয়ে, শিক্ষার মানে ঘাটতি, তরুণীদের জন্য যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া, প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়া–সহ বেশ কিছু বিষয়কে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। তাদের মতে মেয়েদের মধ্যে একটা বড় অংশের ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এটি একটা মূল কারণ আর এ কারণেই পুরুষদের তুলনায় নারীদের নিষ্ক্রিয়তার হার অনেক বেশি। বিষয়টিকে আবার একটু ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, নারীদের বড় একটা অংশ গৃহস্থালির কাজের সাথে জড়িত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নারীদের এই গৃহস্থালির কাজকে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করা যাচ্ছে না, যে কারণে এই পরিমাণ এত বেশি মনে হচ্ছে। আবার অনেকই বলছেন যে আমাদের দেশে নারীবান্ধব কর্ম পরিবেশ রয়েছে। তারপরও সামাজিক কারণে নারীর কাজকে গৃহস্থালির কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে নারী স্বাচ্ছন্দ্যে কাজে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। এর বাইরে আরো কিছু কারণকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি এসব ক্ষেত্রে আরো বেশি ভালো করার সুযোগ থাকলেও নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া কোভিড পরিস্থিতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও সামাজিক দ্বন্দ্ব এসবও কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে। যদিও এসব কারণে গোটা পৃথিবীতেই পরিস্থিতি শোচনীয় এবং বিভিন্ন ধরণের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।
এ–হার কমাতে বিশেষ করে তরুণীদেরকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জোর দেওয়া, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের আবার শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা ও নারীদের বিনামূল্যের পারিবারিক শ্রমের বোঝাও কমাতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশপাশি বাল্যবিয়ে রোধে বাংলাদেশ যে মডেল হিসাবে পরিগণিত সেটিকে আরো কার্যকরভারে পরিচালনা করা যেতে পারে বলে তারা মনে করছেন।