অন্তিম যাত্রায় পরম বন্ধু গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ

মইনুদ্দিন জামাল চিশতী | শুক্রবার , ২৫ জুন, ২০২১ at ৭:২৭ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এক অদৃশ্য আতংকে ভীতসন্ত্রন্ত হয়ে পড়েছে পুরো দেশের মানুষ। চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া মরণব্যাধি করোনার ছোবল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশকেও ছাড় দেয় নি। আমাদের বুদ্ধি হওয়া বয়স থেকে এ পর্যন্ত এমন কঠিন পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। করোনার এমন কঠিন মুহূর্তে মানুষের মন যখন এমনিতেই অনেক আতংকিত অবস্থায় ছিল, তারমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের সঠিকভাবে কাফন-দাফনের ব্যাপারে নানারকম ভীতি ছড়িয়ে পড়ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের অনেক দূর থেকে লাঠি দিয়ে গর্তে ফেলে দেওয়া ও আগুনে পুড়িয়ে ফেলার মতো নির্মম ভিডিও’র দৃশ্য দেখে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মারাত্মক দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। এমন কঠিন সময়ে সংক্রমণের ভয়ে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের কাছে ঘেঁষছিল না কেউই। এমনকি মা-বাবা, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন সকলেই লাশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। অনেক সময় মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরাও জানাজা পড়ানোর ভয়ে অনেক দূরে পালিয়েছে। মানবতার এমন করুণ মুহূর্তে এক যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়ে করোনায় মৃত মানুষের পাশে থাকার ঘোষণা দেয় গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে গাউসিয়া কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বলেন, সারাদেশে করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের কেউ যদি কাফন-দাফন ও জানাজার ব্যবস্থা না করে তবে আমরা নিজেরাই গিয়ে সেখানে যাবতীয় কার্যক্রম সমপন্ন করবো। যেই ঘোষণা, সেই কাজ। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ঘোষণা অনুযায়ী সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর হাজারো বীর মুজাহিদ কর্মী ভাইয়েরা উজ্জীবিত হয়ে এই মহান কাজে শামিল হতে কাজ শুরু করে দেয়। দুদিনের মধ্যেই গাউসিয়া কমিটির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় শুরু হয় স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা গঠনের কাজ। সরকার ও প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে মানবতার কঠিন সময়ে আল্লাহ্‌ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি লাভের আশায় করোনা আক্রান্ত বা করোনা উপসর্গে মৃত্যুবরণ করা মুসলমান ভাইদের লাশ কাফন-দাফনের মহান কাজ শুরু করে দেয় তারা।
শুধু তাই নয়। করোনায় মৃত্যুবরণ করা ভিন্নধর্মী মানুষের সৎকারেও এগিয়ে আসে গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা। এ যেন শতবৎসরের বাঙালি মুসলিম ঐতিহ্যের বাস্তুব প্রতিচ্ছবি। হিন্দু-বৌদ্ধ যে জাতিই হোক না কেন, করোনার কারণে মানবিক দুর্যোগের এমন সময়ে ইসলামের শান্তির পয়গাম হাতে গাউসিয়া কমিটির বীর মুজাহিদ কর্মীরা তাদের সৎকারে এগিয়ে আসে। যে মুহূর্তে নিজের পরিবারের সদস্যরাও কাছে ঘেঁষছিল না, সে মুহূর্তে এমন অনন্য মানবিক নজির স্থাপন করে দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়েছিল গাউসিয়া কমিটির কর্মীরা। বর্তমান যুগে যখন ইসলামের নাম দিয়ে ধর্মান্ধতা ও সামপ্রদায়িকতার বিষবাষপ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন প্রকৃত ইসলামের এমন আদর্শ চর্চার বিরল নিদর্শন হিসেবে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর কার্যক্রম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। রাতদিন, ঝড়-বৃষ্টি, প্রতিকূল আবহাওয়া সহ শত বাধাবিপত্তি পেড়িয়ে সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে লাশ গোসল, কাফন-দাফন ও সৎকারের কাজে বিরামহীনভাবে ছুটে চলেছে গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা। এই সংগঠনের সাথে যারা জড়িত তারা সকলেই নিঃস্বার্থ মানবিক কর্মী। তাদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী, কেউবা ছাত্র। মৃত মহিলাদের গোসল ও কাফন দেওয়ার কাজ করেন গাউসিয়া কমিটির একদল প্রশিক্ষিত নারী কর্মী। তারা সকলেই মানবতার ডাকে একাট্টা। তাদের মধ্যে কোন অলসতা নেই। একটি লাশ দাফন-কাফনের কাজ করে এসে আরেকটির ডাক আসলেও তাদের মধ্যে বিরক্তির ছাপ নেই। বরং, এমন মহান কাজ করতে পেরে তাদের চোখেমুখে প্রশান্তির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। বিশাল এ কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে কাজ করছে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর প্রায় ১০ হাজার নিবেদিতপ্রাণ মানবিক সদস্য। দেশের বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি এই মহান কার্যক্রমে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে তবে এই কার্যক্রমের পরিধি আরো অনেক বিস্তৃৃত হবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ্‌ পাকের দরবারে প্রার্থনা করি, এমন দুঃসাহসিক কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট আমাদের গাউসিয়া কমিটির নিবেদিতপ্রাণ ভাইবোনদের উপর যেন আল্লাহ্‌ পাকের করুণা বর্ষিত হতে থাকে। তাদের সুস্থতা ও সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ : এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
পরবর্তী নিবন্ধঅনেক দিন পর