‘অধ্যাপক ড. আসমা সিরাজুদ্দিন’ স্মরণে : তাঁকে মনে পড়ে

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ

চাঁদগাঁও আবাসিক এলাকার ৩৬৯ নম্বর বাড়ির দীর্ঘদিনের বাসিন্দা দু’জন অধ্যাপক। একজন জাতীয় অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন আর অন্যজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ড. আসমা সিরাজুদ্দিন। টানা ছয়টি দশকের পথচলা তাঁদের। এই পথচলায় তাঁদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী বই আর কাগজকলম। দিনরাত তাঁরা লেখাপড়া করেন। দর্শনার্থী আসে মাঝে মাঝে, লেখাপড়ার প্রয়োজনেই; পড়াশোনা সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁদের কোন উপদেশ বা পরামর্শ নিতে। বিদ্যানুরাগীদের কাছে এযেন এক তীর্থস্থান। অশীতিপর দুই শিক্ষাবিদ একজন অন্যজনকে আঁকড়ে ধরে জীবনের কথা বলেন, ভালোবাসার কথা বলেন। সেজীবন কানায় কানায় ভরা; স্বাচ্ছন্দ, খ্যাতি, সম্মানসবার ওপরে ভালোবাসা। চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নেই, নেই কোন অভিযোগ, নেই কোন শূন্যতা।

আজ এক বছরএই বিশেষ বাড়িটি প্রাণহীন, খাঁ খাঁ করছে শূন্যতায়। আজও দর্শনার্থী আসে, লেখাপড়ার কথা হয়, ইতিহাসের কথা হয়। কিন্তু অদ্ভুত এক নীরবতা সমগ্র বাড়ি জুড়ে। যাঁর হাতের ছোঁয়া কেবল বইখাতায়ই নয়, দেয়ালে ঝুলানো ছবি আর আসবাব থেকে শুরু করে হাঁড়িকুঁড়ি, থালাবাটি সর্বত্র, সেই তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের আঙিনায়। তিনি একজন মমতাময়ী অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিন (১৯৩৭২০২১), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী অধ্যাপক।

পাকিস্তানের লাহোর প্রদেশের কন্যা আসমা হকের আসমা সিরাজুদ্দিন হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক বিরাট ইতিহাস। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫৭ সালে বিএ, এবং চারুকলা নিয়ে ১৯৫৯ সালে এমএ পাস করার পর লাহোর মহিলা কলেজে যোগ দেন তিনি শিক্ষক হিসেবে। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (ঝঙঅঝ) পড়তে যান ১৯৬২ সালে। দেশে ফিরে গিয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। এরপর আবারও তিনি লন্ডনে গমন করেন। লন্ডনের হর্নজী আর্ট কলেজ হতে স্থাপত্বিক অলংকরণের ওপর ডিপ্লোমা করেন (১৯৬৫) এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন (১৯৬৮)

তবে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউরোপে গিয়ে আর হয়নি তাঁর ঘরে ফেরা। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে পড়তে যাওয়া তরুণ আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনের সঙ্গে জীবনের গাঁটছাড়া বেঁধে আসমা হক হয়ে যান আসমা সিরাজুদ্দিন। ভালোবাসার টানে পশ্চিম পাকিস্তানী কন্যা বসত গড়েন এই বাংলায়। তখন ষাটের দশক। তীব্র ঘৃণায় বাঙালি ফুঁসে উঠতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানী অপশাসনের বিরুদ্ধে। সেইদিনগুলো মোটেও সহজ ছিল না তাঁর জন্য। সব প্রতিকূলতা জয় করেন তিনি ভালোবাসা দিয়ে। বাংলা ভাষা শেখেন, বাঙালি রান্না শেখেন, বাঙালি মেয়েদের মতো করে শাড়ি পরা শেখেন। বলা যায় শত্রুপুরিতেই থিতু হন তিনি ভালোবাসার জোরে।

. আসমা সিরাজুদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে মুসলিম আর্ট এন্ড আর্কিটেকচার শাখায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৬৯ সালে। ১৯৭৪ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলে নবস্থাপিত বিভাগে যোগ দেন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। পরের বছর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেন ইতিহাস বিভাগে এবং অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন ১৯৮৩ সালে। ড. আসমা সিরাজুদ্দিন ইতিহাস বিভাগের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত।

ইংরেজি, উর্দু, ছাড়া আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষতা ছিল তাঁর গবেষণার প্রধান শক্তি। ইন্দোমুসলিম কলা ও স্থাপত্য, মুসলিম আমলে বাংলার প্রত্নতত্ত্ব বিশেষত মুদ্রা ও লিপি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ছিল তাঁর গবেষণা ও পাঠদানের প্রধান বিচরণক্ষেত্র। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাThe Representation of Architecture in the manuscript painting of the Abbasid Period, Mughal Artist Manuhar and His Portrait of Muhammad Hossain ZarrinQalam, Fortified Places in the Early Timurid Miniature Paintings, Towers of Humayun Heads, Akbar and his School of Painting. বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টোরাল করেন (১৯৭৪৭৫), হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে সহযোগী গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন (১৯৮৬৮৭), রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির রিসার্চ ফেলো (১৯৬৮৬৯) হিসেবে কাজ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর (১৯৯৬) হিসেবে শিক্ষকতা করেন অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষে অবসর গ্রহণ করেন ২০০২ সালে।

অধ্যাপনা থেকে আনুষ্ঠানিক অবসর গ্রহণ করলেও জ্ঞানচর্চা অব্যাহত থাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আসমা সিরাজুদ্দিনের কথা আজও তাঁর শত সহস্র শিক্ষার্থীর মুখে মুখে। তাঁর শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যাও অগণিত। মানুষকে আপন করে নেওয়ার এক অসাধারণ শক্তি ছিল তাঁর। একবার যে তাঁর সংস্পর্শে এসেছে, সে কখনও ভুলতে পারেনি তাঁকে। তাঁর মানবিক গুণাবলীর কথা বলে শেষ করার নয়। তিনি ছিলেন নিরহংকারী, উদারমনা, ধার্মিক ও রুচিশীল। একজন অতিথিপরায়ন সুগৃহিণী হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। পড়ন্ত বেলায় এসেও প্রযুক্তিতে হাতেখড়ি নিতে কোন কার্পণ্য করেননি ড. আসমা সিরাজুদ্দিন। কাজের প্রয়োজনে কম্পিউটার ও মুঠোফোনের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়লে অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না। তাঁর সহায় হয়ে এগিয়ে আসেন সহধর্মিণী। ছায়ার মতো পাশে পাশে থাকেন প্রতি মুহূর্তে। কাগজের লেখাগুলোকে কম্পিউটারে ফুটিয়ে তোলা, সম্পাদনা করা, এরপর অন্তর্জালের মাধ্যমে যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিশ্চিন্ত রাখেন তাঁকে।

চিরকাল নিভৃতচারী ছিলেন অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিন। জীবনসঙ্গীই তাঁর শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে দিতে উন্নত বিশ্বে নিজের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের সকল সুযোগকে পরিত্যাগ করেন তিনি। ঘর ছাড়েন, দেশ ছাড়েন, আত্মীয়পরিজন সবাইকে ছেড়ে দিয়ে জীবন নৌকার নোঙর ফেলেন এক অচেনা পৃথিবীতে। নতুন ভুবনে ঝড়ঝাপটা এলেও প্রাপ্তি ছিল সীমাহীন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফেলে আসা জীবন নিয়ে কোন আক্ষেপ ছিল না এই মহীয়সী নারীর। পরম প্রশান্তি নিয়ে চোখ বোজেন তিনি ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর।

রূপকথাকে হার মানায় একীর্তিময়ীর অনন্য জীবনগাঁথা। মৃত্যুতেও শেষ হয়ে যায়নি সেজীবনের কথকতা। শারীরিকভাবে প্রস্থান করলেও তিনি আছেন তাঁর পরিপাটি করে সাজানো গৃহকোণে। সেই চেনা হাসিমুখ অক্ষত শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে। পরম যত্ন আর ভালোবাসায় তাঁর স্মৃতিকে লালন করে চলেছেন তাঁর প্রাণের মানুষ, একজন জাতীয় অধ্যাপক। শোকে বিহ্বল, তাই বলে থেমে যায়নি তাঁর কলম। প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি কর্মে অনুভব করেন প্রিয়তমার উপস্থিতি। জীবদ্দশায় যেভাবে তাঁকে কাজে উৎসাহ দিতেন, মৃত্যুর পরও একইভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে যান অন্য ভুবন হতে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিজের যত্ন নিন
পরবর্তী নিবন্ধছলেমা খাতুন