অদ্বৈত মল্লবর্মণ: অদ্বৈত জীবনের প্রতিবেদন

কমলেশ দাশগুপ্ত | রবিবার , ৩ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

বেশ কয়েকবছর আগে পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাহিত্যিক, লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির গবেষক শ্রী সুধীর চক্রবর্তী ‘জলজ জীবনের ভাষ্যকার: অদ্বৈত মল্লবর্মণ’ এই শিরোনামে ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবন, পরিবেশ, সাহিত্যচর্চার প্রতি যে অকৃত্রিম অনন্য অনুরাগ ও অনুভবের দুর্লভ ছবি এঁকেছিলেন তা এখনো বেশ মনে আছে। এই শব্দ নির্মিত ছবি বা প্রবন্ধিত বিষয়টিকে একটি কমিটমেন্ট বা দলিলসদৃশ সাহিত্যসন্দর্শন বলা যেতে পারে। সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোঁড়াই চরিত্র মানস’, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অদ্বৈতমল্ল বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরন্যের অধিকার’ দেবেশ রায়ের ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’ আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’, সমরেশ বসু’র ‘গঙ্গা’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলির মর্মবেদই যে সম্পূর্ণ মানুষের জীবনবেদ তাই যেন আমাদের বোধিতে আঘাত করে জানিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় উল্লেখিত শ্রদ্ধেয় ঔপন্যাসিকেরা লেখক, পাঠকের এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সুগঠিত এক একটি সাহসী টাওয়ার। যাঁরা আমাদের অন্ধ আবরিত ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজের বহুমাত্রিক অবক্ষয় ও অবনমনের প্রতিরোধক।
তিতাস নদীর পাড়ে সে প্রাচীন মালো পাড়াটি শুধুমাত্র জলজ উপাদান আহরণ ও জৈবিক প্রয়োজন নির্ভর ছিল তা কিন্তু নয়। তাঁদের জীবন যৌবন, বার্ধক্যকে শেষ অবধি জলজ জীবনবেদের (সুখ, দুঃখ ও আনন্দ বেদনার উৎসব, পালা, পার্বণ) আদর্শে ও মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল তারই একটি পূর্ণতর কিন্তু ব্যতিক্রমী শপথের প্রচ্ছদ ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ। অদ্বৈত একজনই যথার্থ অর্থে মূল্যায়িত হতে পারেন। যিনি সমগ্র মালো সমাজের অনিশ্চিত জীবন, জীবনের সহস্র সুখ স্বপ্নের নির্মাণ ও নির্মম তার প্রতিদান; নিম্নবর্গীয় শিরোনাম বিষয়ক অপবাদ কিন্তু বেগবান মুক্ত জীবনস্রোতের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা ও সংরুদ্ধতার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বহীন এক অদ্বৈত ভাষ্যকার।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস একটি একক জবানবন্দী কিন্তু সমগ্র মালো সমাজের সরল সনিষ্ঠ জীবনগাথা। আমরা যখন উপন্যাসটি পড়ি বা ঋত্ত্বিক ঘটক পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এ জলমথিত দুঃখ, বেদনার মর্মভেদী স্রোত ও আর্ত আহ্বান ধ্বনিত হতে দেখি; জীবনের সংসারের এবং সহায় সম্বলহীন অকাতর পাড় ভাঙ্গার শব্দ শুনি তখনই অদ্বৈত জীবনের এই শক্তিমান সৃজনের স্পর্শ পাই। মালো সমাজ, প্রগতি ও সংস্কৃতির চর্চা যে তাঁদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তারও আভাস পাই।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর স্বল্পায়ূ (১৯১৪-১৯৫১) জীবনে কী অসাধারণ মানসিক শক্তি ও সাহস নিয়ে উদ্বেগ, শংকাহীন এবং স্থিতধী থেকে একটি বিরাট নগরের প্রবল জনস্রোতে সামিল হয়ে ব্যক্তিগত জীবনের দায়, নিদারুণ ক্ষতজড়িত স্বজনপোষণের বিষয় এবং দূরারোগ্যের সীমাহীন ভার বয়ে বয়ে; ক্ষয়ে যেতে যেতে সহিতত্ত্বের ও সাধনার যূপকাষ্টে নিজেকে করেছেন সমর্পণ। এই সমর্পণের সরণীতে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবন ও প্রত্যক্ষিত হয় কিন্তু অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁকে ও তাঁর জীবনকে দেখেছেন প্রাচীন নিয়মের বর্গে ও বর্ণে। সে হলো ‘মানিক বন্দোপাধ্যায় বড়ো আর্টিষ্ট। মাষ্টার আর্টিষ্ট, কিন্তু বাওনের পোলা-রোমান্টিক। আর আমি তো জাওলার পোলা।’
এখানেই আমার লেখাটা শেষ করবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু তা হলো না কারণ স্বল্পমাত্রিক জীবনের ছকে অদ্বৈত’র যে দুটি জীবনপর্বের সৃষ্টি হয়েছিল তার একটি ছিল রক্ত, জল, ভূমি মিশ্রিত এক অন্তরভুবন; অপরটি ছিল এক বিরাট পাষাণসম নগরের কন্দরে ফেলা তাঁর হাজারো দীর্ঘশ্বাস ও অসম্পূর্ণ জীবনের সংক্ষুব্ধ মানচিত্র। এই দুইয়ের বিপরীত পরিক্রমণে অদ্বৈত ফিরে ফিরে গেছে বারংবার তাঁর পরম প্রিয় জীবনের পুনরুদ্ধার ও তা সংরক্ষণের দিকে। তাই তো দেখি অদ্বৈত জীবনের শেষ সংশপ্তক হয়ে ফুটে আছে সেই রক্ত, জল, ভূমির সঙ্কর্ষনে একটি চিরজীবী রক্তকমল।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক; প্রতিষ্ঠাতা, চট্টগ্রাম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধমাহে রমজান মাগফিরাত ও নাজাতের মাস