অকৃত্রিম বন্ধু পল কনেট

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শুধু বাঙালিরা নয়, অনেক বিদেশির ভূমিকা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। পল কনেট দম্পতি তাদের অন্যতম। ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। ‘মিলিয়নস অব সোলস নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান, হোমলেস অন যশোর রোড আন্ডার গ্রে সান, আ মিলিয়ন আর ডেড, দ্য মিলিয়নস হু ক্যান, ওয়াক টুওয়ার্ড ক্যালকাটা ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান’। কবিতার ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানই হলো বর্তমান বাংলাদেশ। এ কবিতার সূত্র ধরেই বিখ্যাত বাঙালি গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক কবিতাটির কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করেছেন তার ‘যশোর রোড’ গানটি।
‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত মানুষের দল/ যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল/ কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে/ আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে/ ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ি দেশ/ মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ/ শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে/ এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে/ সময় চলেছে রাজপথ ধরে যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল/ সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, গরু গাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল/ লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে, লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়/ ঘরহীন ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়/ রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু, পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে/
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ দিশেহারা মা কারকাছে ছোটে/ সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, এত এত শুধু মানুষের মুখ/ যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ/ কারকাছে বলি ভাতরুটি কথা, কাকে বলি করো, করো করো ত্রাণ…।’
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড ও পল কনেট যেন একসূত্রে গাথা। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিজ দেশে দেন তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বেগবান করতে দিয়েছিলেন। আর বাংলাদেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন তখন দেশ শত্রুমুক্ত হয়। ইংরেজ এ দম্পতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজ দেশে কাজ করেছেন। কারাভোগও করতে হয়েছে।
পল কনেট গেয়েছেন মানবতার জয়গান। প্রতিবাদ করেছেন অন্যায়ের। পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সবটুকু শক্তি নিয়ে। তাকে সঙ্গ দিয়েছেন স্ত্রী অ্যালেন কনেট। ভালোবেসে অ্যালেন বিয়ে করেছিলেন পলকে। দুজনেই ছিলেন অ্যাকটিভিস্ট। লন্ডন ভিত্তিক ওয়ার রেসিস্টারস ইন্টারন্যাশনাল (ডাব্লিইআরই) সংগঠনের কর্মী ছিলেন। যখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের সাহায্যে এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কনেট দম্পতি এখানে আসার আগ্রহ দেখায়। ছোটো ছোটো ভাগ হয়ে ডাব্লিইআরই তাদের কর্মীদের নিয়ে চালু করে ‘অপারেশন ওমেগা’। ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট ৮ জনের একটি দল নিয়ে উদ্বোধন হয় ‘অপারেশন ওমেগা’র। শুরুতে ৫ সেপ্টেম্বর ‘অপারেশন ওমেগা’র চার জনের দল ত্রাণ নিয়ে ধরা পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে। ১১ দিন তাদের আটকে রেখে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই দিন আরেকটি সফল মিশন করে ‘অপারেশন ওমেগা’। আরেক সীমান্তে দুই জনের দল খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ ও কাপড় বাঙালিদের মাঝে বিতরণ করেন। ১০ সেপ্টেম্বর আবারও তাদের তিন জনের একটি দল বাংলাদেশে এসে ত্রাণ বিতরণ করে।
অক্টোবরের শুরুতে পল কনেট দম্পতি শিমুলিয়া প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে ছিল দুইশর কাছাকাছি শাড়ি, শীতের জন্য গরম কাপড় ও শুকনো বিস্কুট। সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়লেও বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারেননি। ৪ অক্টোবর স্থানীয় এক গির্জা থেকে তাদের এসব ত্রাণসামগ্রী জব্দ করা হয় এবং তাদের গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সেনারা। অভিযোগ এই দম্পতি বাঙালিদের সাহায্য করছে। সামরিক আদালতে তাদের বিচারও হয়। বিচারে শাস্তি হলো দু’বছরের জেল। তাদের পাঠানো হয় যশোর কারাগারে। কিন্তু পুরো মেয়াদে জেল খাটতে হয়নি।
নিউইয়র্ক টাইমসে পরদিনই অ্যালেন কনেটের মুক্তিসংবাদ ছাপা হয়। ওয়াশিংটন পোস্টে আরও বিশদ সংবাদ প্রকাশিত হয়। মার্কিন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তার কথাগুলো ছিলো অসাধারণ-মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওরা স্বাধীনতা পাবেই। ঈশ্বর সাক্ষী যেই নারকীয়তার মধ্যে দিয়ে তারা গেছে এরপর এটাই তাদের অধিকার। বন্দীদশার বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছেন তার সঙ্গে আরো দুশো নারী আটক ছিলেন।
১৯৭১ সালের যশোর জয় হওয়ার পর কারাগার থেকে মুক্তি পান পল কনেট দম্পতি। বাংলাদেশের বিজয় দেখার সুযোগ হয়েছিল তাদের। হাজারো বাঙালির সঙ্গে রাস্তায় নেমে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়েছিলেন তারাও। যশোর কারাগারে অ্যালেন কনেট যখন বন্দি ছিলেন তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। পরের বছরের মাঝের দিকে তিনি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার হৃদয়ে এতটাই জায়গা করে নিয়েছিল যে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অনুসারে তার ছেলের নাম রাখেন- পিটার উইলিয়াম মুজিব কনেট। কোনো কিছু পাওয়ার ইচ্ছেয় তারা বাংলাদেশে আসেননি। এসেছিলেন মানবতা, বিবেকের ডাকে।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আবেদন জানিয়ে এবং জনমত গঠনের জন্য ১৯৭১ সালে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে একটি সমাবেশ করেন পল কনেট। বাংলাদেশে আসার আগে পল কনেট প্যারিসে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের একটি পতাকা হাতে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পুরো দৃশ্যটা টিভিতে ধারণ করা হয় এবং এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন- তুমি তো বাঙালি নও, ইংরেজ, তুমি একা কীভাবে ইয়াহিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বে আর বাংলাদেশ স্বাধীন করবে? পতাকা নাড়তে নাড়তে পলের দৃঢ় উচ্চারণ ছিলো- দেখোই না আমি কী করতে পারি! আসলে পল কনেট দম্পতি দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাদের ভূমিকা অনন্য। ২০১৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে এসেছিলেন পল কনেট। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। স্যালুট বাংলাদেশের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধুকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসি বিজয়ের হাসি
পরবর্তী নিবন্ধরেলওয়ে বাজার মৎস্য আড়তদার সমিতির সভা