সুচক্রদণ্ডী গ্রামটি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া পৌরসভায় অবস্থিত। সমগ্র উপমহাদেশে পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী গ্রামটি বেশ সুপরিচিত। গ্রামের নামকরণটি বেশ সুন্দর। সুচক্রদণ্ডী শব্দটি সে সময় বৌদ্ধদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। বৌদ্ধযুগে যেসব গ্রামের নামকরণ হয়েছে তাতে দেখা যায় স্থানীয় সুখ্যাতির সাথে দণ্ডী শব্দটি যুক্ত করে দিত। সুচক্রদণ্ডীকে আবার দাইরও বলা হতো যেমন সুচক্রদণ্ডীকে সুইচ্যা দাইর বা উইচ্য দাইর বলা হয়। আঞ্চলিক ভাষায় বলে “য়ুঁইচ্যাদাইর” বা সুইচ্যাদাইর। সুইচ্যা মানে সূচ বা সূচি সুচের মতো। দাইর মানে সীমারেখা। সুইচ্যা ধার থেকে সুচক্রদণ্ডী সু মানে ভালো, চক্র–বৃত্ত দণ্ডী–দণ্ডধারী বা জনপদ। শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি, হিতৈষী, মূল্যবোধ প্রভৃতি দিক দিয়ে সুচক্রদণ্ডী গ্রামটি শিল্প সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে উর্বর।
ইন্দ্রপুলের নিচ দিয়ে চানখালী খালের তীরে নৌকা নিয়ে বন্ধুদের সাথে হারিয়ে যাওয়া। সুফি সাধক হজরত শাহচান্দ আউলিয়ার নামে নামকরণ চানখালী খাল। খালে শুভ্র ফেনা, ঘোলাটে পানি, নৌকা আর সাম্পানের কেঁ কোঁরত কেঁ কোঁরত দাঁড়টানার শব্দ, বাঁশের ভেলা সারিবদ্ধভাবে সাজানো থাকে। মাঝিরা নৌকা থেকে কাদামিশ্রিত লবণের টুকরি মাথায় নিয়ে ফিরছে। পাশে তুষের মিল, কুণ্ডলী পাকিয়ে শুভ্র ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। পটিয়া বাইপাস চত্বরের ইন্দ্রপুল ব্রিজের উত্তর পাশ দিয়ে এবং মুন্সেফবাজারের উত্তর পাশ দিয়ে সুচক্রদণ্ড গ্রামে যাওয়া যায়। প্রয়াত জমিদার সারদা চৌধুরীর ছেলে ইন্দ্র চৌধুরীর নামে ইন্দ্রপুলের নামকরণ হয়।
সুচক্রদণ্ডী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চানখালী খাল। খালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লবণ শিল্প। নারিকেল বাগান, খেজুর গাছ, সবুজ শ্যামল পাখি ডাকা, ছায়া ঘেরা ছবির মতো সুচক্রদণ্ডী গ্রাম। বাবুই পাখির বাসা দোলে নারিকেল গাছে। পাশে কাদাযুক্ত লবণের মাঠ। ছোটোবেলায় লবণ মাঠের কাদা মেখে জীবন্ত মূর্তি হয়ে যেতাম। গ্রামের মনোমুগ্ধকর সবুজ পরিবেশ দেখলে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে।
চানখালীর পাশে এক সময় ষষ্ঠী বৈদ্যর হাট বসত। কালের বিবর্তনে হাটটি হারিয়ে গেছে। উপমহাদেশবরেণ্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের স্মৃতিবিজড়িত সুচক্রদণ্ডী গ্রাম। তাঁরই আপন ভাতিজা জ্ঞানতাপস মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের অন্যতম গবেষক শিক্ষাবিদ ড. আহমেদ শরীফ, ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর, শিক্ষাবিদ শামসুল আলম, অধ্যাপক ড. নেহাল করিমসহ আরো অনেক গুণিজনের জন্মভূমি।
সুচক্রদণ্ডী গ্রামের আদি জমিদার ছিলেন ষষ্ঠীচরণ মজুমদার। ইতিহাস জানতে গিয়ে দেখা যায়, ষষ্ঠীচরণ রায় মজুমদার ১৮৩৫ খ্রি. জন্ম এবং মৃত্যু ১৮৮৯ খ্রি. বর্তমানে বারাণসীতে। তাঁর পিতা কালীদাশ, মাতা প্রিয়বতী। ষষ্ঠীচরণ মজুমদার ছিলেন বাবা মায়ের জ্যেষ্ঠ সন্তান। বাবা ছিলেন কবিরাজি চিকিৎসক সেই সুবাদে বৈদ্যালী উপাধি। ষষ্ঠী বৈদ্যা নামে সুপরিচিত। ইন্দ্রপুলের উত্তর পাশে চানখালী পাড়ে ষষ্ঠী বৈদ্যার হাটও বসত। ষষ্ঠীচরণ মজুমদারের পুত্র হরিরঞ্জন মজুমদার ও আশুতোষ মজুমদার নয়াদিল্লিতে আয়ুর্বেদ কলেজ স্থাপন করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরিরা দিল্লিতে বসবাস করেন। আশুতোষ মজুমদার ভারতের রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত চিকিৎসকও ছিলেন। কবিরাজদের আর্থিক অবস্থা সে সময় খুব একটা সচ্ছল ছিল না। ষষ্ঠীচরণ মজুমদারের পরিবারে এক সময় অভাব অনটন দেখে। কথিত আছে, এক রাতে স্নান করার জন্য পিতলের তৈরি বদনা হাতে বেরিয়ে যান। একেবারে দেশান্তরী হয়ে গেলেন। তিনি নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এক সময় কাশ্মীর গিয়ে পৌঁছেন। কাশ্মীরের নরপতি রণবীর সিংহের অসুস্থ বিমাতাকে তার কবিরাজি ঔষধ দিয়ে সুস্থ করেন ষষ্ঠীচরণ মজুমদার। সেই থেকে মহারাজের গৃহ চিকিৎসক হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। শুরু হলো দিনবদলের পালা। এক সময় রণবীর সিংহের পরিবার থেকে তাঁকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও উপহার দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি সুচক্রদণ্ডী গ্রামে ফিরে রাজপ্রাসাদ, দিঘি, মন্দির, পুকুর রাস্তাঘাট এসব নির্মাণ করেন। বাড়ির চারপাশে নানা বৃক্ষরাজি রোপণ করেন। সুচক্রদণ্ডী গ্রামের প্রথম জমিদার বাড়ি এটি বাড়িটি এত সুন্দর ছিল বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে এক পলক তাকিয়ে থাকতেন। জমিদার বাড়ির পাশে পুরানো জালাকুমারীর মন্দিরের গায়ে শ্যাওলা লতাপাতায় ঢেকে আছে। বটবৃক্ষের শিকড় ছড়িয়েছে একেবারের অক্টোপাসের মতো। জমিদার বাড়ির সামনে দুটি পুরানো মিনার। জমিদার বাড়ির ফটকের খুব কাছে গিয়ে অবাক হলাম এত সুন্দর এই পুরানো বাড়ির দালান। পঞ্চদেবতার মন্দিরটি ভারতের কালিদাস নির্মিত মন্দিরের পূর্ণাঙ্গরূপ বলা যায়। মন্দিরের পেছনে বর্ষীয়ান অশ্বত্থ গাছটি কালিদাসের নির্মিত মন্দিরের সমসাময়িক। ষষ্ঠীচরণ মজুমদারের নয়নাভিরাম বৈদ্যার দিঘি। শানবাঁধানো ঘাটের ভগ্নাবশেষ। এ ধরনের কিছু বাড়ি দেখেছিলাম সোনারগাঁয়ে। এ যেন এক পুরানো স্থাপত্যশিল্প। আদিকালের এ ধরনের স্থাপত্য নিদর্শন খুব একটা নেই বললে চলে। বাড়ির দেওয়ালগুলো বিশ ইঞ্চি চওড়া, ছাদের খিলান তৈরি হয়েছে লোহা দিয়ে। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখি এক অন্দরমহল দেখলে বুঝা যায় এখানে জলসার আসর বসত। ভিতরে বিশাল মাটির তৈরি মটকাও চোখে পড়ল। জনমানবশূন্য বাড়িতে ভয়ে গা ছমছম করছে অনেকটা জিন ভূতের আস্তানার মতো। জরাজীর্ণ জমিদার বাড়িটি এক প্রাচীন নিদর্শন। ২০১৮ সালে বাড়িটির নামও পরিবর্তন হয়েছে। ষষ্ঠীচরণ মজুমদারের নাম পরিবর্তন হয়ে সাধু বাবার বাড়ি হয়ে যায়। এটি মানুষের কাছে কৌতূহল রয়ে গেছে। বাড়িতে বসবাস করতেন গীতা মজুমদার ও বাউন্ডুলে অনুপম বিশ্বাস। ষষ্ঠীচরণ মজুমদারের প্রজন্মরা সবাই ভারতে বসবাস করেন গ্রামে আসেন না। এ বাড়িতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নাট্যকার বন্ধু আশুতোষ সুজনের রচনা তক্ষক নাটকের শুটিং হয়েছিল। জমিদার বাড়িতে পহেলা বৈশাখে চড়কপূজা ও মেলার আয়োজন হতো। বৈদ্যের মেলা নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে জমিদার বাড়িতে গড়ে উঠেছে নাহার এগ্রো পার্ক। কালের বিবর্তনে ৩৫০ বছরের আদি বাড়িটি বিলুপ্তির পথে।